আজও আছে গোপন ।। মৌমিতা বিশ্বাস




ব্ল্যাকবোর্ডে প্রোটিনের সেকেন্ডারি স্ট্রাকচারটা এঁকেই চলেছেন বি ডি আর। কতক্ষণ হয়ে গেলো। পিছনের সীট থেকে রুমেল আর প্রাঞ্জলের ফিসফিসানি কানে আসছে। সেই ক্রিকেট নিয়ে ভ্যাজর ভ্যাজর করে চলেছে যথারীতি। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল গার্গী। মেঘলা করে এসেছে, বিকেলে ঝড় হবে নির্ঘাত। তাহলে আজকে হেদোতে বেশী লোকজন থাকবে না। গাদা গাদা লোকের মাঝে ছাতার আড়ালে মুখ গুঁজে গুজগুজ করতে একটুও ভালো লাগে না ওর। অনেকবার বলেছে কৌশিককে।

আঁকা শেষ, এবার বোঝাচ্ছেন। ক্লাসে মন দিলো গার্গী। হঠাৎ পিঠে একটা কাগজের গোল্লা এসে পড়লো। থতমত খেয়ে কুড়িয়ে নিয়ে দেখে রুল টানা খাতার পাতার একটা টুকরো। দলামোচড়া কাগজটা বি ডি আরের চারচোখের শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে খুলে দেখে, তাতে লেখা, "আজ হবে না, তুই একা চলে যাস। এম কে এস আজকে সাজেশন দেবেন বাড়ীতে। আমি বেরোলাম।"

যাক, বাঁচা গেলো।

এটাই শেষ ক্লাস। কলেজ থেকে বেরিয়ে মনের সুখে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একলা হাঁটতে থাকে গার্গী। আচমকা পেছন থেকে বিনুনিতে এক টান পড়তে চমকে ঘুরে দাঁড়ায়। আরে ! দেবাংশু, এখন ! ওদের তো পাসের ক্লাস থাকার কথা এখন। "কীরে, এরকম ভ্যাবলার মতন দেখছিস কি। ভিজছিস কেন, চল ট্রামে উঠি।"

"তুমি ক্লাস না করে এখানে কি করছ দেবাংশু-দা? ট্রামে উঠবো না। হেঁটে যাবো শ্যামবাজার। বাবার একটা ওষুধ কিনে নিয়ে যেতে হবে হাতিবাগান থেকে।"

মাথায় একটা চাঁটি মেরে দেবাংশু বলে,"বাঃ, গ্র্যান্ড। চল, আমিও হেঁটেই যাবো ভাবছিলাম।"

কী একটা বলতে যায় গার্গী কিন্তু তার আগেই মাটি ফুঁড়ে যেন উঠে আসে কৌশিক। একদম মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে গার্গীর দিকে না, দেবাংশুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কেটে কেটে বলে, "বাহ, হাতেনাতে ধরলাম। যা শুনছি মিথ্যে নয় তাহলে। কতদিন চালাচ্ছিস তোরা?" হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে গার্গী বলে ওঠে, "কী আশ্চর্য! আমি তো তোমার চিরকুট পেয়ে একলাই বাড়ী ফিরছিলাম। দেবাংশুদার সঙ্গে রাস্তায় হঠাৎ দেখা। তুমি স্যারের বাড়ী যাওনি?"
অদ্ভুত তেরছা হেসে জবাব দেয় কৌশিক,"নাহ, এখনও যাইনি, কি ভাগ্যিস। নাহলে এটা মিস করে যেতাম। যাক, ভালো থাকিস দুজনে। গার্গী, আমাকে আর ফোন করিস না, জানিসই, আমি তুলব না।"

বলেই আর কোন সুযোগ না দিয়ে হনহন করে হেঁটে বিবেকানন্দ রোডের দিকে চলে গেলো কৌশিক।

বৃষ্টিটা নামল আরও ঝেঁপে, দেবাংশু আর গার্গী পরস্পরের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও পারছিল না। একটা সামান্য ব্যাপারের এমন কদর্য মানে করবে জানলে গার্গী একলা বেরত না আজকে। পৃথা, সুমেধাদের জন্যে অপেক্ষা করত। দেবাংশুর সব ঠিক আছে, শুধু এই ফাজলামি স্বভাবের জন্যেই ওকে একটু এড়িয়ে চলে গার্গী। জানে তো কৌশিক কিরকম সন্দেহবাতিক চরিত্রের। অথচ ওর মাধ্যমেই আলাপ দেবাংশুর সাথে। একদিন হেদোতে বসবে বলে কৌশিক - গার্গী হাঁটছিল ফুটপাথ ধরে। সামনের পানগুমটিতে একটা ঢ্যাঙ্গা, উষ্কখুষ্ক চুলের ছেলেকে উদাস মুখে এক হাতে আলুকাবলি আরেক হাতে সিগারেট নিয়ে পর্যায়ক্রমে খেতে দেখে কৌশিকই এগিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল গার্গীর সঙ্গে। "এই যে আমাদের দেবা। আর দেবা, এই হল আমার গার্গী।"

ওমনি ফিচেল হেসে দেবাংশু বলেছিল, "পেন্নাম হই বউঠাকুরানী। এই নিন, আলুকাবলি খান। মিষ্টিটা পাওনা রইল। কোন ইয়ার? স্কটিশ তো?" বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল এই সহজ সরল ছেলেটিকে গার্গীর।  কৌশিক মানিকতলার মেসে থাকত, আর দেবাংশুর বাড়ী ডানলপ। গার্গীরা থাকত সিঁথির মোড়ে। আসতে-যেতে রাস্তায় মাঝে মধ্যেই দেবাংশুর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতো, আর টুকটাক গল্পগাছা করতে করতে বাস স্টপ অব্ধি যেতো দুজনে। এই সাধারণ ব্যাপারটা অতিরঞ্জিত হয়ে কৌশিকের কানে পৌঁছেছে কিম্বা ও নিজেই ব্যাপারটা অতিরিক্ত ঝাল মশলা সহযোগে গ্রহণ করে আর হজম করতে পারেনি। বিরক্ত হয়ে ওকে আর সত্যিটা জানায়নি গার্গী,  যোগাযোগও আর করেনি।
যে ক'দিন কলেজে ছিল, কেউ কারুর প্রায় মুখদর্শন করেনি আর। তারপর ফাইনাল ইয়ারের চাপে, আর কে কার খোজ রাখতে পারে। শুনেছিল ডিফেন্সের চাকরী নিয়ে কৌশিক চলে গেছে লাদাখ। গার্গী নিজেও কেরিয়ার নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। পরপর কতকগুলো পরীক্ষা, বিদেশে পিএইচডি, বাবার মৃত্যু। একলা মা'কে দেখাশোনা করতে ওকে ফিরতে হল কলকাতাতেই। পুরনো বন্ধুদের কয়েকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হল। এক-দুবার ইউনিভারসিটি রিইয়ুনিওনেও গেছে। তারপর আবার নিজের জগত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যথারীতি। 

এর পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। বিয়ে হয়েছে, দুই ছেলেমেয়ের মা। নিজের পুরনো কলেজ স্কটিশেই প্রফেসার এখন গার্গী।

আডমিশানের সময় চলছে। রোজ সকালবেলার অনেকটা কেটে যায় ফর্ম ঝাড়াই-বাছাই করতে । এরকমই সকালে নিজের ঘরে বসে ফর্ম দেখছিল গার্গী। একটা মেয়ের নামে এসে আটকে গেলো। কৌশানি নায়ার। বাঙালী নাম, দক্ষিণী পদবী। এরকম একজনকেই চিনত ও। যেন মনে হয় গত জন্মের কথা। তার সঙ্গে এক যুগ আগে শেষ দেখা হয়েছিল। কৌশিকের বাবা জন্মসূত্রে কেরালার নায়ার বংশের হলেও কর্মসূত্রে বাংলায়। পাস করে বেরিয়েই এখানে প্রথম সরকারি চাকরী, তারপর কলকাতায় থেকে যাওয়া। বিয়ে করেছিলেন বাঙালী মেয়েকে। মনে পরানে বাঙালী এই মানুষটি ছেলের নামও তাই বাংলায় রেখেছিলেন।

কিন্তু, এতোটা সমপাতন কি সম্ভব?



মেয়েটার নম্বর ভালো ছিল। ভর্তি হয়ে গেলো গার্গীরই ডিপার্টমেন্টে। তারপর সেদিন, গার্গীও বেরোচ্ছে আর কলেজও ছুটি হয়ে গেছে। ড্রাইভারের জন্যে অপেক্ষা করছে গার্গী, দেখল কৌশানি এক দল বন্ধুর সাথে কলকল করতে করতে একটা ছেয়ে রঙের গাড়িতে গিয়ে উঠল। পিছনের সীটে একজন বসে। চোখে চশমা যোগ হলেও নিয়মিত চর্চা করা শরীরে মেদ জমেনি খুব একটা। সিগারেট ধরাতে গিয়ে অভ্যাস মতন ঘাড়টা বাঁ দিকে হেলাতেই গার্গীর সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো। চোখ নামিয়ে নিতে গিয়েও পারল না গার্গী। সিগারেটটা ঠিক সেই পঁচিশ বছর আগের মতন দাঁতে কামড়ে ধরেছে কৌশিক আর ডান হাতের কড়ে আঙ্গুলে এখনও লম্বা নখ রাখে।


ভ্রু কোঁচকাল কয়েক সেকেন্ড। তারপরেই নেমে এলো গাড়ি থেকে, "তুই !! আমাকে চিনতে পেরেছিস? এখানে কি করছিস? আমার মেয়ে এখানে পড়ে, ওকে নিতে এলাম আজকে"

"আমি এখানে পড়াই কৌশিক-দা, কেমন আছ?"

"ওহ, এখানে পড়াস? মানে প্রফেসার ! বাঃ খুব ভালো। সেই পড়ুয়াই থেকে গেলি। এইজন্যেই এতো মুটিয়ে গেছিস নাকি ! দিনরাত বই মুখে বসে থাকিস আগের মতন?"

হেসে ফেলল গার্গী। "তুমি অনেকটা ওরকমই আছ। কলকাতা কবে শিফট করলে?"

একটু ম্লান হেসে কৌশিক বলল, "এই যে কৌশানির মা খুব অসুস্থ হয়ে গেছিলো। ব্রেস্ট ক্যান্সার। বাঁচাতে পারিনি। সাত বছর হল চলে গেছে। ওর বাবা চোখে দেখেন না একদম, হাই সুগার। এখানেই আছি সেই থেকে।"

কৌশিকের মেয়ে আর তার দু-একজন বন্ধু যারা তখনও বাস পায়নি হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিল ওদের। কৌশিকের কথা শুনে মনেই হচ্ছিল না যেন কোনদিন কিছু হয়েছিলো ওদের মধ্যে। যেন এক সপ্তাহ পর দেখা হয়েছে মাত্র, এমনভাবে আলাপচারীতা করছিল।

"আমার কথা ছাড়। তুই কথায় থাকিস? ফোন নম্বরটা দে। বিয়ে-থা করেছিস তো নাকি শুধু পড়াশোনা। মাসিমা মেশমশাই কেমন আছেন?"

প্রশ্নের তোড়ে ভেসে যাচ্ছিল গার্গী। এবার বলল, "অত কথা কি রাস্তায় হয়? একদিন বাড়ীতে এসো। বাবা মারা গেছেন অনেক বছর হল। বিয়ে করেছি। আলাপ করিয়ে দেবো ওর সাথে। এই আমার ঠিকানা। রোববারেই চলে এসো তাহলে?"

"বেশ বইপোকা, দেখব কীরকম সংসার করছিস তুই । রবিবারে দেখা হচ্ছে"


ঘরদোর শেষবারের মতন ফিটফাট করে নিচ্ছিল গার্গী, সবসময়ের কাজের মেয়েটার সাথে হাত মিলিয়ে। জলখাবারের জোগাড় আগেই করা হয়ে গেছে। রাতের রান্না আজ পুরোটা নিজের হাতেই করেছে গার্গী। ছেলে-মেয়ে তার রকম দেখে হেসেই সারা। মেয়ে বড় আর মায়ের সাথে খুব বন্ধুত্ব। সে বললে, "মা এমন করছ যেন তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ড না, আমাকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসছে। এবার থামো, অনেক গুছিয়েছ। যথেষ্ট ঠিকঠাক লাগছে বাড়ী। একটু স্থির হয়ে বোসো ।" তার বাবা আবার এক কাঠি এগিয়ে বলে দিলো, "করতে দে মোম, তোদের মা হয়ত সেই পঁচিশ বছর আগের না করতে পারা সংসারটা এভাবেই একটু মেরামত করে নিচ্ছে। কি গো, জবাবদিহির ব্যাপার আছে নাকি কোনও?" গার্গী এবারে রেগে যায়, "তোমরা একটু থামো তো। সব ব্যাপারে ফাজলামি ভালো লাগেনা।"

এমন সময়ে ডোরবেল বেজে উঠল। মোম দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। দরজায় দাঁড়িয়ে কৌশিক, হাতে এক বাক্স মিষ্টি আর একটা ফুলের তোড়া, হলদে গোলাপের। গার্গীর প্রিয়, এখনও মনে রেখেছে। গোলাপ দেখেই যা বোঝার বুঝে নিলো মোম, "এসো এসো আঙ্কল, তোমার জন্যেই বসে আছি আমরা।" তারপর গলা একটু তুলে ডাকল, " মা, দেখো কে এসেছে।"

বাইরের ঘরে বেরিয়ে আসে গার্গী। ধীর পায়ে তার পেছনে এসে দাঁড়ায় মোমের বাবা। মুখে মৃদু হাসি। কৌশিকের প্রচণ্ড চমকে যাওয়া লক্ষ্য করে মোম বলে, "পাপা, তোমরা একে অন্যকে চেন নাকি!!"
দেবাংশু বলে,"হ্যাঁ রে মা। অনেকদিনের পরিচিত আমরা। কীরে কৌশিক। ভেতরে আয়, বোস। চেহারাটা তো দিব্যি টনটনে রেখেছিস। খুব একটা পালটাসনি।"

"দেবাংশু তুই !! গার্গী তুই তো কিছুই বলিসনি সেদিন"

"বললে কি করতে? আসতে না? আমি কেমন সংসার করছি জানতে চেয়েছিলে, জানলে এবার?"

এবার দেবাংশু বলে,"তুই তো কোন লাদাখ না কার্গিল পালিয়ে গেলি।  কারোর সাথে আর যোগাযোগই রাখলি না। ইউনিভারসিটি রিইউনিওনে গিয়ে দেখি এই মক্কেলও হাজির। ব্যাস, আর কি। লেগে পড়লাম। অত সহজে কি আর পাত্তা দেয়, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হল। আমাকে যে একেবারে ভাসুর ঠাকুরের জায়গায় বসিয়ে রেখেছিল রে।"
ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে দেবাংশু।। অনেকদিন পরে কলেজের সেই কিশোরীর মতন চপল হেসে ফেলে গার্গী। কিছুক্ষণ ছুপ কড়ে থাকার পর কৌশিকের ঠোঁটেও দেখা দেয় এক চিলতে হাসি। গার্গীর মাথায় একটা টোকা মেরে বলে, "নে, এবার জমিয়ে এক কাপ কফি কর দেখি, কেমন রান্না শিখেছিস" ।

SHARE THIS

Author: