সর্বগ্রাসী বন্যার আগে ।। বিফোর দ্য ফ্লাড ।। লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও'র পরিবেশবাদী চিন্তা ।। সুজন ভট্টাচার্য

শিল্পের সময়
এক ফ্রেমে পাশাপাশি তিনটি ছবি। লিওনার্দো বলতে থাকেন তাঁর ফেলে আসা ছেলেবেলার কথা। স্বর্গের উদ্যান। প্রথম ছবিতে এডাম আর ইভের প্রণয়। অপূর্ব সুন্দর পরিবেশ। দ্বিতীয় ছবিতে সেই সুন্দর উদ্যানে মানুষের ভীর! যুদ্ধ, মহামারী। তৃতীয় ছবিতে সেই সুন্দর উদ্যানে অন্ধকার ছায়া নেমেছে। মানুষ নিজের আপন আবাসকে ধ্বংস করে ফেলছে! শৈশবে দেখা এই অদ্ভুত চিত্রশিল্পটি মাঝ বয়সের লিওনার্দো এখনো সংগ্রহে রেখে দিয়েছেন। এই ছবিগুলোই তাঁকে প্রকৃতির প্রতি এক গভীরতম দায়বদ্ধতাই বেঁধে ফেলে। লিওনার্দো পেয়েছিলেন সুন্দর উত্তরাধিকার। আন্ডারগ্রাউন্ড কমিক ডিস্ট্রিবিউটর পিতার উত্তরাধিকার। সেই ছোটবেলায় বাউণ্ডুলে বাবার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন রাস্তার পর রাস্তা। পরিচয় হয়েছিলো তৎকালীন অসামান্য সব চিত্রশিল্পীদের সাথে। চিনেছিলেন ডোডো পাখির মতো আরো অনেক পাখি। মা,বাবা নাম রেখেছিলেন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির নামের সাথে মিল রেখে। শিল্পের সময় এবং প্রকৃতি সেই বিশ বছর বয়স থেকেই লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওকে পরিবেশবাদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত করে। ব্যক্তি হিসেবে বিভিন্ন অভিজ্ঞতায়, প্রায় ধ্বংসের কাছাকাছি চলে যাওয়া পৃথিবী নিয়ে লিওনার্দোর একধরণের নৈরাশ্যবাদী ফিলজফিক্যাল ডিলেমা তৈরি হয়। অস্কার জয়ের পরবর্তীতে তাঁকে যখন জাতিসংঘ শান্তিদূত মনোনীত করে তখনি এটি স্পষ্ট হয়। মহাসচিব বান-কি মুনের সাথে দেখা করে লিওনার্দো তখন ভবন থেকে বেরিয়ে আসছেন এবং বারবার বলছেন, 'ওরা এই মহত্তম কাজের জন্য ভুল মানুষকে বেছে নিয়েছে'....

ভুল মানুষের আখ্যান নাকি মৃতপ্রায় বিশ্বের জন্য গভীর ভালোবাসা...
ক্লাইমেট চেঞ্জ হচ্ছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এই শতকের পরিচিত শব্দ এবং তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হলো এটি ফ্যাক্ট। বিজ্ঞান সাময়িকী বলছে এই বছরের জুলাই ছিলো বিশ্বের ইতিহাসের উষ্ণতম মাস। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং বরফ গলে যাচ্ছে মেরুবলয়ে! প্রতিকূল আবহাওয়া এখন নিয়মিত বিষয়। পশ্চিমে ত্রাস সঞ্চার করছে প্রলয়ের মতো টর্নেডো কিংবা হারিকেন। যে ইউরোপ বন্যা কি জানতো না, তারাই গত কয়েকবছর এর মুখোমুখি! কোথাও ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হচ্ছে তো কোথাও উষ্ণ মরু রুক্ষতা চলছে। প্রশ্ন হলো এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে পৃথিবীতে আসলেই কি হচ্ছে? রাজনীতির গতিপথটাই বা কী? কর্পোরেট বাণিজ্য নাকি মানুষের স্বাভাবিক বেঁচে থাকা? কোনটা প্রয়োজনীয়? এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতেই যেনো নির্মাণ করা হলো 'বিফোর দ্য ফ্লাড'। অস্কার জয়ী পরিচালক ফিশার স্টিভেনস এবং অস্কার জয়ী অভিনেতা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও যৌথভাবে নির্মাণ করলেন এই ডকুমেন্টারিটি। এটি শিক্ষণীয় এবং এডভোকেসি ধারণার সাথে সম্পৃক্ত। বলা যেতে পারে এই পৃথিবীতে কি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কি পরিণতি অপেক্ষা করছে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল 'বিফোর দ্য ফ্লাড'। এই ডকুমেন্টারিটি দেখতে অনেক প্রশ্ন জাগতে পারে..! প্রথম প্রশ্নটাই আমরা এভাবে করে ফেলতে পারি..দ্য ফার্স্ট কোয়েশ্চেন উই আর প্রোবাবলি আস্কিং ইজ হোয়াট দি হেল ইজ লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও ডুইং মেকিং আ ডকুমেন্টারি এবাউট ক্লাইমেট চেঞ্জ?....

প্রশ্নের উত্তর এবং বিফোর দ্য ফ্লাড
এই প্রশ্নটাই ডকুমেন্টারিটির শুরুতেই প্রকাশ করা হয় যখন অভিনেতা লিওনার্দো জাতিসংঘের দূত নিযুক্ত হন। মার্কিন কর্পোরেট মিডিয়া (ফক্স, এবিসি, সিএনএন) লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে! লিও কী এই ক্লাইমেট চেঞ্জ নামের বিষয়টি অনুধাবন করার যোগ্য? যে মানুষ বিজ্ঞান জানেনা, ক্লাইমেট চেঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সে কী বুঝবে? মার্কিন সংবাদ মাধ্যমগুলো অস্কার জয়ী অভিনেতাকে নিয়ে ট্রল করতে থাকে। বিনয়ী ডিক্যাপ্রিও স্বীকার করেই ফেলেন। তিনি বিজ্ঞানের অনেক বিষয়ের সাথেই পরিচিত নন কিন্তু বৈশ্বিক পরিবেশের বিপন্নতা এবং মানুষের অসহায়ত্বকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন। লিওনার্দো ক্লাইমেট চেঞ্জ নামের বিষয়টির সাথে যুক্ত হতে থাকেন গভীরভাবে যখন তাঁর বয়স মাত্র বিশ! সেই সময় বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে তরুণ ডিক্যাপ্রিও প্রথম বক্তব্য রাখেন এবং সাক্ষাৎ করেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উইলিয়াম রডহেম ক্লিনটনের সাথে। ক্লিনটন সহ মার্কিন সিনেটের কর্তারা ক্লাইমেট চেঞ্জ নামের বিষয়টির সাথে পরিচিতই নন তখন!! লিও আবিষ্কার করলেন, মার্কিন কর্পোরেশনগুলো বিরাট অর্থ বিনিয়োগ করেছে মার্কিন সিনেটে। বাঘা বাঘা সিনেটরকে কিনে ফেলেছে তারা যাতে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তাঁরা টু-শব্দটি না করে! এমন অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কিভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা যায়? লিওনার্দো ডি ক্যাপ যেনো পেয়ে গেলেন সেই উত্তর!

এফ.বি.আই, কর্পোরেশন এবং বিজ্ঞানীরা
সারা বিশ্বজুড়েই জলবায়ু ইস্যুতে কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। বলা যেতে পারে, এখনো অবধি প্রায় ৯৮% বিজ্ঞানী জলবায়ু ইস্যুতে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ে একমত হয়েছেন। তাঁরা ফসিল ফিউলের অপকারীতার বিষয়ে বিভিন্ন  সভা-সেমিনারে তাঁদের রিপোর্ট পেশ করছেন। কয়লা খনি, তেলের খনি বন্ধ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। বিকল্প জ্বালানি উৎস খুঁজে নিতে বলছেন। সময় খুব দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। যদি খুব তাড়াতাড়ি রাষ্ট্রীয়ভাবে ভূমিকা রাখা না হয় তবে ধ্বংস অনিবার্য। বর্তমান দুনিয়ায় পূঁজির আগ্রাসী আচরণের বিপরীতে বিজ্ঞানীদের কথা আমলে নেওয়ার মতো কেউ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ যারা কিনা পূঁজির মালিকানার শ্রেষ্ঠত্বে পৌঁছেছে। এই দেশ একক ভাবেই যে জ্বালানি পোড়াচ্ছে তার ধারে কাছেও অন্যরা নেই। এরপরে আসে চীন। এই দুই দেশ মিলে প্রায় পুরো পৃথিবীই গিলে খাচ্ছে যেনো! মার্কিন দেশে একজন ব্যক্তি যে পরিমাণ ইলেক্ট্রিসিটি কনজিউম করে তা ভারতে ১০ ব্যক্তি মিলিতভাবেও করছেনা! আর এই বিপুল জ্বালানির উৎস হলো কয়লা এবং তেল। এর পেছনে রয়েছে দানবীয় সব কর্পোরেট হাউজ। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এদের কাছে কমিক্যাল ইস্যু! এই কর্পোরেটদের অনুগত মিডিয়া দিবারাত্র প্রচার করছে কিছু অপদার্থ বিজ্ঞানী এবং পরিবেশবিদ্যারা মিলে মানব কল্যাণ বন্ধ করতে উঠে পড়ে লেগেছে! বিদ্যুৎ ছাড়া কী দুনিয়া চলবে? লাইফ স্টাইল বলে কী একটা বিষয় নেই? বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নগুলো জবাব দেন। সহজ লভ্য বিকল্প জ্বালানীর সন্ধান দেন কিন্তু তাদের পরামর্শ কাজে লাগালে বিরাট পূঁজি দানবদের ব্যবসা লোপাট হয়ে যায়! শুধুমাত্র চার/পাঁচটি কর্পোরেশনের হাতে বন্দি হয়ে আছে সারা বিশ্বের ভাগ্য! পূঁজি রক্ষায় মাঠে নামে পূঁজির পাহারাদার এফ.বি.আই! বিজ্ঞানী আর পরিবেশবাদীদের মৃত্যু হুমকি দেওয়া হয়! তাদের ঘরে পৌঁছে যেতে থাকে পরোয়ানা... তাতে লেখা থাকে.. 'ঝুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও'!!

আমাদের বাসভূমি কিভাবে বাঁচবে?
'বিফোর দ্য ফ্লাড' বিরাট হতাশার মধ্যেও আশাবাদী হওয়ার মতো একটি তথ্যচিত্র। লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও বিশ্বের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ঘুরে বেড়ান পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। ইন্টার্ভিউ নেন বিশ্বের বড় বড় সব বিজ্ঞানীদের। কথা বলেন পরিবেশবাদীদের সাথে এবং রাষ্ট্রনায়কদের সাথে। তিনি নিজেকে এডভোকেসির মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। একজন বারাক ওবামা, শি জিং পিং অথবা পোপ এক্ষেত্রেই খুব গুরুত্বপূর্ণ যেহেতু তাদের কথা অনেক মানুষ শুনবে! এখানেই এই ডকুমেন্টারিটির কিছু ত্রুটি দেখা যায়। প্রোপাগান্ডা থেকে পুরোটা মুক্ত হতে পারেনা 'বিফোর দ্য ফ্লাড'। তবে শেষ পর্যন্ত মানুষের কথা বলতে পারেন লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও। তিনি দেখতে পান দুই মেরুর বরফ গলছে ভয়ানকভাবে। গ্রিনল্যান্ডের অর্ধেক বরফ এখন নাই হয়ে গেছে। মেরু অঞ্চলে বরফের রঙের পরিবর্তন হয়ে গেছে যা নির্দেশ করছে আসন্ন পতনের। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আলেহান্দ্রো গঞ্জালেজ ইনারিতুর সাথে 'রেভেনান্ট' সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে এই ভয়াবহতা টের পান লিওনার্দো। কানাডার আলবার্টায় শুটিং লোকেশনে বরফ দেখে গিয়েছিলেন বছরখানেক আগে কিন্তু শুটিং শুরু করতে গিয়ে দেখেন সামান্য বরফও আর অবশিষ্ট নেই সেখানে! শেষ পর্যন্ত ইনারিতুর দলবল শুটিং লোকেশন হিসেবে বেছে নেন দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি একটি জায়গা।
জলবায়ু বিষয়ক প্যারিস সামিট দিয়েই শেষ হয় 'বিফোর দ্য ফ্লাড'। লিওনার্দো শেষ বক্তা হিসেবে মঞ্চে উঠেন। অসংখ্য রাষ্ট্রনায়কদের সামনেই নিশঙ্ক চিত্তে কথা বলেন। সতর্ক করেন কর্পোরেটদের ভয়ানক লোভ নিয়ে। তিনি বলতে থাকেন, শেষবারের মতো চেষ্টা করার। আশাবাদকে বাঁচিয়ে রাখতে বলেন এবং দাবী করেন প্যারিস সামিটে উপস্থিত রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ব্যক্তিবর্গই শেষ ভরসা আক্রান্ত বিশ্বের জন্য... লিওনার্দো দ্য ক্যাপ্রিও এই ডকুমেন্টারিতেই রেখে যান অসংখ্য স্মৃতি। নিরাশাবাদের জায়গায় তিনি দেখতে পান বিশ্বের প্রথম জলবায়ু উদ্বাস্তু এবং মেক্সিকোতে পানির জন্য যুদ্ধ। অন্যদিকে আশাবাদী হওয়ার মতো বিকল্প শক্তির উৎস। স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোতে পলিউশনের হার শূন্যের কোঠাই। সোলার এনার্জি ব্যবহার করে সুইডেন বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রে স্থাপন করা হয়েছে সোলার প্যানেল উৎপাদনের গিগাফেক্টরী! এরকম আরো ১০০ টি হলেই সারা বিশ্বেই আর বিদ্যুৎ সমস্যা থাকেনা!....
র‍্যাভানেন্ট সিনেমায় আমরা দেখি মানুষকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে কিন্তু এখন আমাদের আসল যুদ্ধটা করতে হবে প্রকৃতিকে রক্ষা করার জন্য। লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও এই সত্যটা বুঝতে পারেন। এখন আমাদের বুঝার পালা। নিজ দেশে সুন্দরবন যার বড় উদাহরণ। এই বিপুল অরণ্যকে রক্ষা করতে না পারলে যে আমাদের অস্তিত্বই থাকেনা।

SHARE THIS

Author: