একটা
শিরশিরে বসন্ত নেমে যাচ্ছে অনুভূতি বেয়ে। আমার বেড়ে ওঠাতে ছিল একরাশ জলের আওয়াজ, যাকে উচ্ছ্বাস
ভেবে ভুল করা যেত। সন্ধে হলে, পাঁচিলের ওপাশে যখন জমে
উঠছে আরও একটা জনজীবন, নলিনী বাবু অফিস ফেরত কাতলার কানকো
উলটে রঙের পরিমাণ করেন, বাইরে শেতলা তলার ঘণ্টা ক্রমশ
পড়ার ঘণ্টা জানান দিতে থাকে। এক একটা অংক করতে হত, যেখানে
মিনারেটের উচ্চতা দিয়ে মাপতে হত জলে ডুবে যাওয়া কে, আর
পরীক্ষায় গোল্লা। দলছুট হতে হতেও মানুষকে কোথাও তো নোঙ্গর করতেই হয়, তাই না।
তুমি
হয়ত ভাবতে বসলে এর সাথে প্রেমের যোগাযোগ কোথায়। সে তো ওই চিলতে উঠোনে ঝোরে পরা
বটফুলের মধ্যে। আমাদের কনভেন্ট কালচারে তখন আমরা টিনএজার। সেই সময় বাড়ি থেকে
রবীন্দ্র সদন, মেট্রো, রক্সি, নিউ
এম্পায়ার, লাইট হাউস, বড়া দিন,
আমিনিয়া আর সেই এখনকার বন্ধ অবসন্ন হয়ে যাওয়া তখনকার ঝকঝকে শ্রী
রাম। প্রথমবার ঢুকে মনে হয়েছিল, অ্যালিস ইন
ওয়ান্ডারল্যান্ড। ওই ছোটখাটো ঝর্না, পাথরকুচি যেন আমার
সমস্ত বিস্ময়ের ঘাড় ধরে ঝাঁকাচ্ছে আর ক্রমশ বাধ্য করছে আমাকে বড় হয়ে উঠতে। সে
ওয়ান্ডারল্যান্ডে কখন টু করো টুকরো জীবন যাত্রারা ভিড় ক’রে,
ইট পেতে, কনক্রিট ঢেলে বাংলো বানিয়েছে,
চাষ বাস ক’রে সম্পদশালী হয়ে উঠেছে আর
সমাজ ভাগ হয়েছে ধনবান এবং সৈন্য সামন্তে, বলরুম এবং
যুদ্ধক্ষেত্রে তার হিসেব করতে গিয়ে দেখি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার ওই
কল্পরাজ্যে তোমার প্রবেশ অবারিত।
একটা
১২০০ বছর আগের মন্দির। বছরভর ঋতু বৈচিত্র্যকে উপেক্ষা করে বসন্ত লেগে থাকে তার
কারুকার্যে। কয়েকটা শাল,
শিমুল,পলাশ আর বর্ণান্ধ ক’রে দেওয়া কুসুম গাছের মধ্যে দিয়ে নিষ্ক্রিয় জলশূন্য নদীর গতিপথ। চিৎ
হয়ে শুয়ে থাকা যায় তার কলে। হারিয়া খোঁজ করতে করতে পথ হারিয়েছে মানুষ, আর ওই কুসুম গাছের তলার যে বুড়ি দু বছর আগেও হারিয়ার হাঁড়ি দিয়ে পসরা
সাজাতো তাকে আর কেউ কখনো দেখতে পায়নি। এদেশে সব রাতের নামই পূর্ণিমা। চাঁদ আলো
উপুড় ক’রে দিলে হাঙ্গেরির মানুষ এখানে কাঠের জ্বালে
বনমোরগের মাংস ঝলসে খায় । ওই জলের উপশমের ভেতর মোলাকাত হয় ছোট্ট খরগোশের সাথে,
আমার এক বন্ধু বলেছিল একবার, সেক্সের
সময় রাগ সঙ্গীত বাজিয়ে রাখতে। শহরে এখন বসন্তের উসখুস, সমস্ত
রাগ সঙ্গীত যেন ওই ফেলে আসা নদীর সরসর শব্দ আর যত চাঁদের আলো, সব শ্লিপ করছে পাথরের গায়ে। অনেক দূরে রাজপ্রাসাদে ঘণ্টা বাজল বলে।
এখানে নরবলির কোনও ইতিহাস লেখা নেই, শুধু আদিম সময়ে
কাঁচুলি গায়ে জড়িয়ে যারা মিলিত হত এই মন্দিরের চাতালে, তাদের
রাজরক্ত এখনো সে গল্পের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। সন্ধে হলে সংলগ্ন গ্রামে বউরা রুটি
সেঁকে তুলে রাখে। আতপের গন্ধে ম ম করছে মহুয়ার বাগান। কোথাও দাবানলের গল্প শোনা
যায় হে শেরী, তবুও তো কয়েক মিল দুরেই আমাদের রেলপথ। দুটো
কি একটা রাতের জার্নি জমা হয় লোয়ার বার্থে। চক্রধরপুর গামী যেকোনো ট্রেনে চেপে ভোর
বেলা একটা ভাঁড়ের চা। এই নদীতীর অনায়াসে প্রাইভেট বিচ হতে পারত। এখানেও মাদল বাজে।
ঘুমের মধ্যে দুরের পাহাড়গুলো লাল পোশাক পরিহিত পাহারাদারের সজাগ এড়িয়ে ঢুকে পরে
স্বপ্নে।
প্রিয়
বসন্ত
ঋতুবদল হয়ে গেলে শহরের
গায়ে লেগে থাকে অলিভ গাছ। আমাদের ভালোলাগার শব্দগুলো বয়ে বেড়ায় কানে কানে। শেরীর
মদকতায় ফুল ফোটে। আমার বাউন্ডারির ভেতর গোটা একটা কোলকাতা শহরকে বার বার বড় হতে
দেখি, আর
ইচ্ছা করে ছোটবেলার গল্পের ঝুড়ি খুলে বসতে। সেই গল্পের সাথে এখনকার গল্পগুলো সব
মিলে যাচ্ছে। অথচ, এরপর আর কিছুই বলবার থাকে না। শুধু
গোটা রাস্তাঘাট জুড়ে শুধু ওই জোর সংখ্যার পাতাওয়ালা গাছ আমাকে পাগল করতে থাকে।
শীতের ছুটি সেই কবেই ফুরিয়ে গেছে বলে ক্যালেন্ডার দেখি নতুন নতুন ছুটির অপেক্ষায়,
যেখানে মাঠ আদিগন্ত হয়ে ওঠে রোজ, নতুন ক’রে হাঁটার জন্য পথ তৈরি করে কারা যেন। আর প্রিয় বসন্ত, ঘুরে ফিরে আসে আমার ক্লাসরুম, বইয়ের পাতা,
কম্পুটার টেবিলে, জেদ ধরে বসে থাকে তার
সমস্ত রঙের সম্ভার নিয়ে।