আজ পর্যন্ত কোনো চিঠিই তোকে লেখা হয়নি। অথচ দেখ, কতদিন
হয়ে গেছে তোকে ছেড়ে চলে এসেছি। ভেবেছিলাম,
ছেড়ে আসার আগে তোকে জানিয়ে আসব। অন্তত একটা চিঠি লিখে তোর
ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবো। তা আর হল কই! আজ বারবার মনে হচ্ছে, কোনো
দিনও তোকে কোনো চিঠি লিখিনি কেন? আমরা দুজন কখনো চিঠিই
লিখিনি পরস্পরকে! কোনো চিঠি লেখার প্রয়োজনই হয়নি! কী আশ্চর্য আজ আমি তোকে চিঠি
লিখছি তুতান। তবে পোস্ট করব কিনা জানি না।
দিন কয়েক হল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি। কী হয়েছিল? নাইবা জানলি।
কেউ আমাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেনি। ওখান থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে
সোজা বাড়িতে। এখানেও কেউ রিসিভ করেনি। কেউ বলেনি- চিন্তা করিস না, ভালো হয়ে যাবি। তখন তোর কথা বারবার মনে হয়েছে। খুব শূন্য শূন্য নিঝুম
শূন্যতা আমাকে গ্রাস করল। মন ছুটতে শুরু করল পেছনের পথে। এর কোনো মানে হয় বল?
দুজনেই কবিতা লিখতাম, হয়তো এখনো লিখি। আমার কবিতাগুলো দেখা
যায় না। তোর লেখা মাঝে মাঝে অনলাইনে দেখি, পড়িও। আমার তো
কেবল নতুন লেখা কবিতা পড়তে ইচ্ছা করত। এখনো করে। ঠিক ঠিক তোর লেখা খুঁজে বের করে
পড়েও ফেলি, তুই জানিসও না। যেন আমরা কোনোদিনও কেউ ছিলাম
না, যেন কোনদিনই কোনকিছু ঘটেনি আমাদের দুজনার পৃথিবীতে!
তোর কোনো খবর আমাকে কেউ দেয় না। কিন্তু আমি জেনে যাই, তুই
বেঁচে আছিস। সবাই হয়তো ধরেই নিয়েছে আমি আর
তোর জীবনে নেই। তুইও কি তাই ভাবিস তুতান?
এখন রাত ২টো। বাইরে বরফ পড়ছে। জানিস একটা অ্যাম্বুলেন্স
একটানা টুঁ-উ টুঁ-উ শব্দ করে চলে গেল বরফ কাঁপিয়ে, শুনতে পেলি? তোর তো এখন দুপুর। তাই না রে? খুব ব্যস্ত?
আর দেখ, আমার চোখে ঘুম নেই। এইরকম বরফ
পড়লেই তোর উষ্ণতার কথা মনে পড়ে। চল, যাবি একবার বরফে?
আমি ঠাণ্ডাকে খুব ভয় পেতাম। তোকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা খুঁজতে
চাইতাম। পারতাম না, কেউ দেখে ফেলবে এই ভয়ে। এখানে আরো
অনেক বেশি ঠাণ্ডা। তা বলে আমি আর এখন তাকে ভয় পাই না। কেমন করে বদলে গেল অন্তর্গত
প্রকৃতি! এখন প্রতিদিন বরফ মাড়িয়ে কাজে যাই, ফিরি,
আরো কত্তো কী! জানলে হয়তো অবাকও হতে পারিস।
হঠাৎ হঠাৎ অবাক করে দেবার স্বভাব আমার, এখনো খানিকটা
বেঁচে আছে মনে হয়। কত কিছু মনে পড়ছে তুতান...।
ধুলোভরা রাস্তাগুলোর কথা ভুলে যায়নি। জানিস, এখানে
একফোঁটাও ধুলো নেই, কাদা নেই। সব রাস্তা পরিষ্কার,
ইচ্ছে করলে রাস্তার ওপর শুয়ে পড়া যায়। কিন্তু আমার আর সে-ইচ্ছে
করে না। তোর মনে আছে, কতবার আমি চাইতাম ধুলোর রাস্তায়
শুয়ে পড়তে। তুই আপত্তি জানাতিস। বসলেও উঠিয়ে দিতিস। নোংরা ঝেড়ে দিতিস পোশাক থেকে।
আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করতাম- তুই কবিতা লিখিস কী করে রে?
সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই একটা গান কেবলই গুনগুন করে
যাচ্ছি—কে বলে ‘যাও যাও’– আমার যাওয়া তো নয় যাওয়া। এই গানটাই, তুতান, এই গানটাই আমি সেদিন, বাংলা অ্যাকাডেমির সামনে
দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গলা খুলে গাইছিলাম। তুই আমার মুখ চেপে ধরেছিলি। গাইতে দিসনি।
তোর চোখে কি জল এসে গিয়েছিল? কেন এসেছিল? আমাকে তুই যেতে দিতে চাসনি, তাই না? কিন্তু ধরেও তো রাখতে পারলি না। বেরিয়ে পড়লাম পৃথিবীর পথে। এক আশ্চর্য
কিছুর সন্ধানে বুকের ভেতরটা ফাঁকা করে বেরিয়ে পড়লাম।
আমি এখন একা একা ঘুরে বেড়াই। যখন যেখানেই যাই, তোকে মনে পড়ে।
নানান দেশ দেখি আর ভাবি, তুই সঙ্গে থাকলে কেমন করতিস,
কী বলতিস। বিশ্বাস কর, তোর সঙ্গে আজও
আমার ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে করে, ভোরের শিশির কুড়াতে ইচ্ছে
করে, নেমে আসা সন্ধ্যায় পাশাপাশি ছুঁয়ে থাকতেও...। কত
কিছু যে শেষ হয়েও, নিঃশেষ হয় না! কেন হয় না, বলতে পারিস?
তুই কি এখন অনেক থিতু হয়েছিস? স্বস্তির
নিঃশ্বাস ফেলে ছায়া-মায়া ভালোবাসায় ডুবে থাকিস? আমি
কিন্তু পারিনি, ইচ্ছে করেই বলতে পারিস। জীবনের সঙ্গে
জীবনের বোঝাপড়ার যুদ্ধটা করতে আজও আমার ভালো লাগছে। তুই বিরক্ত হতিস, আর আমি হো হো হাসিতে তোর সব গতানুগতিক চাওয়াগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে
চাইতাম। সম্পর্ক নিয়ে তোকে বড়ো হিসেবি, বড়ো অস্থির মনে
হতো। অথচ দুজনেই কেমন কবিতা প্রবণ। তারপরও কত দূরের, আবার
কত কাছের। ভেতরে ভেতরে কত আলো আঁধারের চুপিচুপি খেলা ছিল। ভাবা যায়!
আগামী কিছুদিনের মধ্যে এই শহর ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি আরো
দূরে। যেখানে কোনো চেনাজানা মানুষ থাকবে না, যে শহরের পথঘাট অলিগলি আমার এক্কেবারে
অজানা। তেমনই একটি ছোটো শহরে মুভ করে যাচ্ছি। অনেকটা ইচ্ছে করেই। বড়ো শহর আমার আর
ভালো লাগছে না। যাবার আগে খুব ইচ্ছে হল তোকে জানাই। এখানে আসার সময় তো তোকে জানিয়ে
আসতে পারিনি, এবার এখান থেকে চলে যাবার সময় না-হয় জানিয়ে
যাই। আসলেই কি তুই জানবি...
আর না। আর কিছু লিখব
না। তুই ভালো থাকিস। ভালো থাকিস আমার তুতান। অনেক আদর পাঠালাম, অনেক চুমু।