ভূমিকা: শিল্প প্রকাশের যত মাধ্যম আছে, স্থাপত্য শিল্পকে
কেউ কেউ ইউনিক বলেন এই অর্থে যে অন্যান্য শিল্প, মাধ্যম অনুযায়ী
দেখা যায়, শোনা যায়, স্পর্শ করা যায়
, শধু স্থাপত্যের
অন্দরেই অবস্থান করা যায়।
আমার সহোদর সাব্বির
পারভেজ সোহানের কাছে শুনেছি চলচ্চিত্রকারদের
নাকি ক্যামেরাওয়ালা কবি বলা হয়। স্থাপত্যের চেয়েও
চলচ্চিত্রের অনন্যতা হচ্ছে পরিচালক আমাদের
চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আরো বিস্তৃত পরিসরে ভ্রমণ করান। বিচিত্র
মানুষের অন্তরে এমন কি আমাদের নিজের অন্তরেও
ভ্রমণ করান।
স্থাপত্য সংশ্লিষ্ট
কাজের কর্মী হিসাবে অনুভব করি,মানুষের ঘুমানো খাওয়া বিপাক ও বিনোদন কাজের পরিসর
তৈরির চেয়ে কলমের দ্বারা চিত্ত পরিসর গঠন অনেক মুল্যবান ও কঠিন কর্ম ।
মহৎ লেখকদের এই
বজ্রকঠিন কাজ বিমোহিত পাঠক হয়ে পড়তে গিয়ে মনে হয় লেখা খুব সহজ কাজ। আদতে সবচেয়ে
কঠিন কাজ। লিখে মহৎ সৃষ্টি করা প্রসব বেদনার মতই যন্ত্রণাদায়ক।
দার্শনিকেরা বলেন
প্রথম যে মানুষটা আগুন জ্বালাতে শিখেছিল, বীজ বুনতে শিখেছিল, কাচা মাংস রান্না
করতে হয় বা মাংসে পেঁয়াজ দিলে সুস্বাদু হয় বুঝেছিল- এইসব মানুষদের আবিষ্কারের কৃতিত্ব
মহান বিজ্ঞানীদের সমতুল্য।
আমার এই গল্প লেখার
প্রয়াস উৎসর্গ করা হল ইংল্যান্ডের লিড্সের জোসেফ আসপ্ডিন নামের একজন রাজমিস্ত্রি
কে যিনি ১৮২৪ সনে চুনাপাথর পুড়িয়ে সিমেন্ট আবিস্কার করে স্থাপত্য শিল্পে যুগান্তরের
পরিবর্তনে ভুমিকা রেখেছেন।
শেখপাড়া বাজারে আজ হাটের দিন। কুষ্টিয়া
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এই বাজারে মহাসড়কের ধার ঘেঁষে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে
বড় ও মাঝারি অসংখ্য ট্রাক। পড়ন্ত বিকেলে ফড়িয়া , পাইকার , আর প্রান্তিক চাষিদের
প্রান্তিক মাত্রার দরকষাকষি ও সবজিপন্যের হাতবদলে বাজার সরগরম। হাটের নিয়মিত
শ্রমিকেরা এক একটি ট্রাকে নানান সবজি লোড করে দিচ্ছে । চটের বস্তায় স্তূপীকৃত
প্রায় একই সাইজের সুদৃশ্য সবুজ চালকুমড়োগুলো ট্রাকের ওপর ছুড়ে দিচ্ছে এক
শ্রমিক,গোলরক্ষকের মত দক্ষতায় তা লুফে নিচ্ছে ট্রাকের ওপর দাঁড়ানো অপর শ্রমিক, সে
চালান করে দিচ্ছে আরেক শ্রমিকের হাতে যে কিনা কুমড়োগুলো থরে থরে সাজিয়ে রাখছে।
পাইকারি টাকা পয়সার লেনদেন শেষ হলে প্রান্তিক চাষি নাখোশ নিরুপায় মনে যে টাকা পেলো
সব্জি বেঁচে তাই নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় তেল সাবান ওষুধ আর ফ্লেক্সিলোড
কিনে।
একটি ট্রাকের পাশের চায়ের টং এর মাচায় বসে
নিবিষ্ট মনে এসব তৎপরতা দেখছিলো সত্তোরোর্ধ বৃদ্ধ রমিজ মিস্ত্রী আর তার ১১ বছরের
নাতি রেজাউল। সবজি লোড হলে তার ওপর ত্রিপল দিয়ে আবৃত করে মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধাই হবে
। দাদা-নাতি ঐ ট্রাকের ত্রিপলের ওপর চড়ে বসবে। ট্রাকের মত তাদেরও গন্তব্য রাজধানীর
কাওরানবাজার। চেয়ারকোচে টিকেট কেটে ঢাকা যাওয়ার সামর্থ্য রমিজ মিস্ত্রীর কোনোকালেই
ছিলোনা। যখন রাজমিস্ত্রির কাজে যেত তখনো কুষ্টিয়া থেকে ট্রেনে গোয়ালন্দ, ফেরী করে
আরিচা, আরিচা থেকে লোকাল বাসে ঢাকা যেতো। এলাকায় রাজমস্ত্রির কাজের পুরোনো সুনাম
এখনো আছে তার যদিও কাজটা ছেড়েছে বেশ আগেই।
সেই আইয়ুব খানের আমলে ২১ বছর বয়সে রমিজ ঢাকা
শহরে প্রথম গিয়েছিলো। নিজের এলাকার আব্দালপুরের এক লেবার সর্দারের অধীনে যোগালির
কাজ শুরু করে মতিঝিলের এক সরকারী ভবনে। রোদ ঝড় বৃষ্টিতে হাড়ভাঙা খাটুনির সেই
দিনগুলিতে মাটি কাটা, গর্তে নেমে কাঁদা পানি নিষ্কাশন করা, ঢালাই ও গাঁথুনির মশলা
যোগান দেওয়া এমন কত কাজ করতে করতেই পাকা মিস্ত্রি হয়ে উঠেছিলো রমিজ । দেশ
স্বাধীনের পর বিয়ে, সন্তানের বাবা হওয়া। বয়সের কারনে মিস্ত্রির কাজ ছাড়তে হয় তাকে,
ততদিনে ছেলে শহিদুল বড় হয়েছে। ছেলেকেও রাজমিস্ত্রির কাজ শিখিয়েছিলো রমিজ। নিজে
শান্তিডাঙ্গার গ্রামে এসে সামান্য জমি চাষাবাদে লেগে যায় আর শহিদুল তখন ঢাকায়
মিস্ত্রির কাজ করে সংসার ভালোই চলতো।
বছর
সাতেক আগে মোবাইল ফোনে খবর আসে ৮ তালার ঝুলন্ত মাচায় বাহিরের দেওয়ালে প্লাস্টার
করার সময় মাচা ভেঙ্গে রাস্তায় পরে মরেছে শহিদুল। শহিদুলের লাশ নিয়ে শান্তিডাঙ্গার
গ্রামের বাড়িতে আসে ফরিদ ঠিকাদার। পুরাতন বাঁশ দড়ির মাচা, বিধি মোতাবেক সুরক্ষা
নিরাপত্তার অভাব এসব দুর্বলতা গোপন করে সবই আল্লাহর ইচ্ছা বলে রমিজকে সান্ত্বনা আর
বিশ হাজার টাকার বান্ডিল দেয় ফরিদ। ঘুষ তদবিরে পুলিশ প্রশাসন ম্যানেজ করে শহিদুলের বডিতে ময়নাতদন্তের কোনো কাটা ছেড়া না
করার বোনাসটুকুও ফরিদের মেলা খরচে প্রদানকৃত, এই মুল্যবান তথ্য লাশ দেখতে ভিড় করা
গ্রামবাসী ফরিদের উচ্চকণ্ঠে জানতে পারে। ঠিকাদার আশ্বাস দিয়ে যায় রমিজের নাতি বড়
হলে লেখাপড়ার খরচ দেবে সে।
নাতিকে সে লেখাপড়া শেখাচ্ছে । এবার ৫ম
শ্রেণীতে উঠলো। আগামীকাল শহিদুলের মাচা থেকে পরে মৃত্যু দিবস। রেজাউল বায়না করছে
ঢাকা যাবে তার আব্বার মৃত্যুর দালান দেখবে। যে রাস্তায় তার আব্বার দেহ বিধ্বস্ত
হয়েছিলো নিজের চোখে একবার দেখতে চায়। আবার রমিজ নিজেও গল্পে গল্পে তার যৌবনে দেশের
নামকরা অনেক ভবন যে তার হাতে তৈরি এই গল্প শুনিয়েছে নাতিকে । তারও ইচ্ছা নিজের
নাইমামা জীবনের সোনামামা দালানগুলো নাতিকে একবার স্বচক্ষে দেখিয়ে আত্মতৃপ্তি
পাওয়া। গ্রামবাসীর সামনে সাতবছর আগে দেওয়া মৌখিক আশ্বাস সত্যি ছিল কিনা জানেনা,
তবে রমিজ এই সুযোগে নাতিকে নিয়ে ফরিদ ঠিকাদারের কাছেও যাবে যদি কিছু পাওয়া যায়। দিয়ে
যাওয়া ফোন নাম্বার এ কল করে ফরিদের বাসার ঠিকানা নিয়েছে রমিজ।
পাইকার
মোজাম মণ্ডলকে ধরে ট্রাকের কোনায় তারা
দাদা-নাতি জায়গা করে নিয়েছে। এই ট্রাকেই আবার ফিরবে তারা। গ্রামের বাহিরে
এই প্রথম দূরে কোথাও নাতি রেজাউলের ভ্রমন অভিজ্ঞতা। তাও আবার একেবারে রাজধানীতে।
বালক রেজাউলের চোখে বিস্ময় ও আনন্দ মাখামাখি, এগিয়ে চলা ট্রাকের পেছনে তীব্র বাতাস
গায়ে মেখে নতুন অভিজ্ঞতা যাপন করতে করতে দাদার কোল ঘেঁষে বসে ঢাকা যাচ্ছে। লালন
শাহ সেতু অতিক্রমের সময় সান্ধ্যকালীন প্রজ্জলিত বৈদ্যুতিক সোনালী আলো, সেতু পেরিয়ে
ইশ্বরদী মহাসড়কের দু’ধারে
বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে থোকায় থোকায় গাছে
ঝুলে থাকা লালাভ বর্ণের লিচুফল সবই তার চোখে নতুন।
ইশ্বরদী ছাড়িয়ে বনপাড়া-নলকা-হাটিকুমরুল
বাইপাস দিয়ে যমুনা সেতু পেরিয়ে এলেঙ্গা, টাঙ্গাইল বাইপাস, কালিয়াকৌর, বাইপাইল,
আশুলিয়া, টঙ্গী , আব্দুল্লাপুর, এয়ারপোর্ট, মহাখালী, ফার্মগেট রুট দিয়ে দাদা
নাতীকে নিয়ে সব্জির ট্রাক চলে আসে কাওরানবাজার সব্জির আড়তে। রাত তখন বারোটা।
রাত বারোটার পর কাওরানবাজারের আড়তে
গ্রাম থেকে নিয়ে আসা সব্জি জমা হতে থাকে, আর মিডিয়া হাউসগুলোর টক শো-এর কথা অমৃত
কাওরানবাজার থেকে থরে বিথরে শব্দতরঙ্গে
ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এমনই এক রাত বারোটায় নাতি রেজাউল তার দাদা
রমিজ রাজমিস্ত্রির হাত ধরে প্রথমবার রাজধানীর বুকে পা রাখলো। রাজধানীর সেই
কাওরানবাজারে, যেখানে মাটি আঁকড়ে রাখে অসংখ্য গগনমুখী ভবন, ভবনগুলো ধারণ করে আছে
কর্পোরেট বাকপ্রকাশের গনমাধ্যম। গভীর রাতের কাওরানবাজারে গগনমুখী ভবনগুলোর সামনের
ফুটপাথ পরম মমতায় ধরে রাখে সবজি বহন করার বড় টুকরিতে ঘুমানো উত্তর ও দক্ষিন বঙ্গের
গ্রাম থেকে আসা সব্জিবহনকারী শ্রমিকদের।
রমিজের বোনের ছেলে মন্টু বাপেক্স ভবনের
উল্টো দিকের ফুটপাথে চা-নাস্তার ঝুপড়ি দোকান চালায়। ভাগ্নে মন্টুর দোকানে আজ রাতে
তারা থাকবে। সস্তায় ডাল সবজি আর ডিমের ঝোল দিয়ে এখানে ভাত খেতে আসে সবজি
শ্রমিকেরা, রিকশাওয়ালা আর ছোট দোকানের কর্মচারীরা। হাত মুখ ধুয়ে দাদা নাতি ডাল আর
অর্ধেকটা করে ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত খেলো। মন্টুর কর্মচারী রেজাউলেরই বয়সী আকবর। একটা
কুকুরও দোকানের পাশে পাশে থাকে সবসময়। উচ্ছিষ্ট খায়, দোকানের সামনে সারারাত জেগে
থাকে। মন্টূ ঝুপড়ির ঝাপ ফেলে মেসে ঘুমাতে যাওয়ার সময় কুকুরটা ওকে এগিয়ে দিয়ে এসে
আবার দোকানের সামনে ঘোরাঘুরি করে। পুবদিকে পাঁচ তারকা হোটেল সোনারগাঁয়ে রাতের
বিভিন্ন সময় জ্বালানো আলো কোনো কোনো জানালার কাঁচ ভেদ করে কুকুরটার চোখে বিধলেই
স্বভাবসুলভ আওয়াজ করে ওঠে। রাতের আঁধারে কুকুরের আওয়াজ সুউচ্চ বাপেক্স ভবনের গায়ে
প্রতিধ্বনিত হয়ে খন্ড খন্ড শব্দে ভেঙ্গে পড়ে।
মন্টু মেসে ঘুমাতে গেলে ঝুপড়ির ভেতর
থেকে ঝাপ ফেলে কর্মচারী আকবরের পাশে নাতিকে নিয়ে শুয়ে পড়ে রমিজ। পনের বছর পর ঢাকা
এলো সে। প্রথম যখন এসেছিল মতিঝিল সাইটের কাজ শেষে গেছিলো বুয়েটের একটা ভবনের
নির্মাণ কাজে। দিনে বুয়েট ক্যাম্পাস দেখাবে নাতিকে, সরাসরি দেখিয়ে আবারো বোঝাবে
এখানে ভর্তি হবার মত ভাল ছাত্র হতে হবে তাকে। রেজাউলকে সে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বানাতে
চায়। গ্রামের বাপ-মরা দরিদ্র বালকের পক্ষে বুয়েট এ সুযোগ পাওয়া খুব সহজ নয় জানে
রমিজ। এরকমটা খুব কম ঘটে বলেই পত্রিকার প্রথম পাতায় বক্স রিপোর্টে দারিদ্র জয়ের
গল্প লেখা হয়। লাখো বালকের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝড়ে যাওয়ার এন জি ও রিপোর্ট আসে
ভেতরের পাতায়। রমিজ পত্রিকা পড়েনা, পড়তে জানেনা। কিন্তু জানে তার নাতির বয়সী কত
ছেলে গ্রাম থেকে কোনো এক সকালে ঢাকা চলে আসে যোগালী হয়ে। কচি মাথার ওপর দশ বারোটা
ইট সাজিয়ে প্রায় নিজের সমান ওজন বহন করে হাঁটু কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ি বয়ে পাঁচ-সাত তলার ওপরে উঠা নামা করে
ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মিস্ত্রীর গাঁথুনির কাজে মশলা যোগান দেয়, নানান ভুল করে, ফাঁকি
দেয়, অশ্রাব্য গালমন্দ শোনে। রমিজ চায় তার নাতি যোগালী-মিস্ত্রী না হয়ে ইঞ্জিনিয়ার
হোক। ফরিদ ঠিকাদারের সাহায্য পাওয়া যাক না যাক রমিজ তার যৌবনের উপার্জনে কেনা দু’বিঘা
জমি চরম অভাব অনটনেও হাতছাড়া করেনি,করবেওনা। যদি নাতি সত্যিই বুয়েটে ভর্তির সুযোগ
পায়,সে তার দু’বিঘা জমি বিক্রি করে হলেও নাতিকে পড়াবে ।
যৌবনের উপার্জন তার দু’বিঘা
জমি। ৭৫-৭৬ সালের কথা । এই হোটেল সোনারগাঁয়ের
তখন নির্মাণ কাজ চলছে।
বশীর কনট্রাক্টর বিদেশী কোম্পানীর আন্ডারে সাব-কন্ট্রাক্ট পায়।
রমিজ তখন যোগালী থকে বছর
দুই হল মিস্ত্রী হয়েছে। ফিনিশিং কাজেও দক্ষতা দেখাতে
পারছে। প্রতিদিন ১৫ টাকা
হাজিরা থেকে খোরাকী বাবদ ৫ টাকা পেত। বাকী পাওনা জমা
হত হিসাবের খাতায়। এক
নাগাড়ে ছয় মাস কাজ করে ঈদে বাড়ি যাবার সময় বেতন
আর ওভারটাইম মিলিয়ে খাতার
হিসাবে তার পাওনা তিন হাজার টাকা। মনে পড়লে
আজও তার হাঁসি পায়। তিন
হাজার টাকা, এত টাকা! উত্তেজনায় তার হৃদস্পন্দন , রক্ত
সঞ্ছালন বেড়ে গেছিলো। এত
টাকার গরমে অস্বস্থি আর আনন্দ মিলিয়ে অদ্ভুত অনুভূতি
হচ্ছিলো।
ভয় লাগছিলো বাড়ি যাবার পথে
যদি ডাকাতি হয় বা কেউ কেঁড়ে নেয়।
সময়টাও ছিলো অরাজকতার।
অনেক ভেবে কাওরানবাজার থেকে বড় এক মিষ্টিকুমড়ো
কিনেছিলো। কূমড়োর গায়ে
চাকু দিয়ে তরমুজ বিক্রেতার মতো ত্রিকোণ আকারে টুকরো
কেটে তুলে নিয়ে সেই ফাঁকা
দিয়ে বিচি বের করে ফেলে দিয়ে টাকা ভরেছিলো। ত্রিকোণ
টুকরাটা আবার কুমড়োর গায়ে
জায়গামতো বসিয়ে চটের ব্যাগে ভরে তবেই শান্তি
লাগছিলো তার। মনে হয়েছিলো
পথে যেতে আর ভয় নেই। নির্ভার মনে টাকার কুমড়ো
নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলো। হোটেল
সোনারগাঁ থেকে উপার্জন করে তার দু’বিঘা সোনা
ফলানো চাষের জমি কিনেছিলো।
ওই জমির আয়েই টিকে আছে তার আধমরা সংসার।
এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে
যায় রমিজ।
সকালে থালা বাসনের টুং টাং
শব্দে ঘুম ভাঙ্গে রমিজের। আকবর থালা বাসন মাজছে।
উনুনে কেটলিতে পানি ফুটছে।
নাতিকে জাগিয়ে আড়তের বারোয়ারী টয়লেটে সকালের
কাজ সেরে দোকানে এসে
মন্টুকেও দেখা গেলো। দু একজন বেঞ্চিতে বসে নাশতা খাচ্ছে।
পরটা ডাল-ভাজি খেয়ে তাদের
প্রথম গন্তব্য ধানমন্ডির যে বহুতলে শহিদুলের মৃত্যু
হয়েছিলো।
বসুন্ধরা সিটির সামনে দিয়ে
পান্থপথ হয়ে ৩২ নম্বর ধরে হেঁটে যেতে থাকে দু’জন। দাদার
হাত ধরে থাকা রেজাউলের
চোখে অপার বিস্ময়। যা এতদিন গ্রামের কালাম মামুর চায়ের
দোকানে টিভিতে দেখতো, আজ
সবই সামনে। সাত মসজিদ রোডের সেই বহুতল ভবনের
সামনে যেতেই তারা ভিন্ন পরিস্থিতির
মুখোমুখি হয়।
ভবনের নিচের দিকে শপিং মল,
কয়েকটা ফ্লোর ব্যাংক বীমা অফিস, একটা মেডিকেল
ডায়াগনস্টিক সেন্টারও আছে।
৪-৫ তলা জুড়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। ৬-১০ তলা
আবাসিক এপার্টমেন্ট। ওই প্রাইভেট
ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে
‘নো-ভ্যাট’ শ্লোগান দিচ্ছে। ভবনের
নিরাপত্তা প্রহরীদের অনেক অনুনয় করেও তারা
ভেতরে যেতে পারলোনা।
রমিজের মিনতি পুরো না শুনেই কর্কশ কণ্ঠে খেই খেই করে
উঠলো। মুহূর্তেই হুইসেল
সমেত পুলিশ ভ্যান এসে হাজির। নির্বিচার লাঠিচার্জ শুরু হয়।
জলকামান ও আরমার্ড কারও
রেডি। রমিজ নাতিকে নিয়ে দ্রুত সরে আসে গলি রাস্তায়।
এ গলি সে গলি
দিয়ে ধানমন্ডি ক্রিকেট মাঠের কাছে এসে তারা শসা কিনে খায়। মাঠের
বাউন্ডারির
রেলিং এর ফাঁকা দিয়ে রেজাউল দেখে তার বয়সী ছেলেরা প্র্যাকটিস করছে,
অদূরে মায়েরা
রোদ চশমা চোখে টিফিন বাটি জলের বোতল সাথে নিয়ে ছেলেকে সাকিব
আল হাসান করে তোলার স্বপ্ন
দেখছে। আবারো পথ চলতে চলতে তারা নিউমার্কেট নীলক্ষেত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এলাকায় এসে পরে, গন্তব্য বুয়েট। শহীদ মিনারের সামনে পুলিশ তাদের সামনে যেতে না
দিয়ে ফিরে যেতে বলে। রাস্তার বড় অংশ জুড়ে
হলুদ রিবনের ঘেরাটোপে RAB পুলিশ ঘিরে
রেখেছে। মেটাল ডিটেক্টর ও কালো বেল্ট গলায় বাঁধা ডগ স্কোয়াড নিয়ে তাদের কর্মতৎপরতা
আর উৎসুক জনতার কথাবার্তায় জানা গেলো
এখানে কতিপয় দুর্বৃত্ত কাউকে কুপিয়ে গ্রেনেড ফাটিয়ে দ্রুত উধাও হয়েছে। নীলক্ষেত
ফিরে এসে দেখে জহির রায়হান রোড দিয়েও বুয়েট ক্যাম্পাসে যাবার পথ আটকে রেখেছে
পুলিশ। আইডি কার্ড দেখে স্টাফ- শিক্ষার্থীদেরই শুধু ভেতরে যেতে দিচ্ছে।
বুয়েট দেখার সাধ মেটাতে না
পেরে হাঁটতে হাঁটতে সোহরোয়ার্দি উদ্যানে এসে এক বোতল পানি কিনে একটা গাছতলায় বসে
তারা। বইয়ে পরা রেসকোর্স নিয়ে রেজাউল যতই বলে, ততই স্মৃতি এসে রমিজের চোখে ভিড় করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা হলের নির্মাণ কাজ ছলছে তখন। ছাত্ররা ঠেলাগাড়ি ভরতি বাঁশ
এনে দিয়ে গেল। সাইজ মত কেটে রাখতে বলে গেল কাল সকালে এসে নেবে। রমিজ সারারাত বাঁশ
কেটেছিল। ছাত্রদের মত অত কিছু না বুঝলেও বুঝেছিলো কাল রেসকোর্সে শেখের ভাষণের
জন্যই এত আয়োজন। পরদিন ছাত্রদের শ্লোগান দেখে সারাদিন কাজের মাঝেই রমিজ প্রায়ই
বিড়বিড় করছিলো বাঁশের লাঠি তৈরি কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। কাজে ছুটি করে বিকেলে
রেসকোর্সের মহাসমুদ্রের প্রান্তে দাঁড়িয়ে শেখের ভাষণ শুনেছিলো, সব না বুঝলেও
বুঝেছিলো সামনের লড়াই, মৃত্যুর লড়াই, মুক্তির লড়াই।
রেজাউলের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে এবার
তাদের গন্তব্য মগবাজার। শাহবাগ হয়ে শেরাটনের পাশ দিয়ে হাঁটাপথে চলে আসে ফরিদ
ঠিকাদারের বর্তমান ঠিকানা এক বড় এপার্টমেন্ট ভবনের সামনে। মগবাজারের এই ভবনের সাত
তলায় ফরিদ ঠিকাদার থাকে। গেটের দারোয়ান রমিজের আসার খবর ইন্টারকমে দেয়, ওপর থেকে
বলা হয় গেটরুমে অপেক্ষা করতে। গেটরুমে বসে রেজাউল দেখতে পায় বিশাল আকৃতির তিনটা
বিদেশী কুকুর সুবিশাল গ্যারেজের এককোনায় লোহার খুঁটির সাথে বাঁধা। তাদের গ্রামে
কোরবানির ঈদে বারোয়ারী গোশতো যে সাইজে টুকরো করা হয়, সেরকম টুকরো করা গোশতো
কুকুরগুলোকে খেতে দিচ্ছে এক চাকর। গেটে লটকানো কালো বোর্ডে সাদা রঙে লেখা ‘কুকুর
হইতে সাবধান’ বাক্যটার তাৎপর্য রেজাউল এখন কিছুটা বুঝতে পারছে।
ধানমন্ডির দু’একটা বাগানবাড়িতেও এরকম বোর্ড দেখেছে। দেড়ঘন্টা
অপেক্ষার পর ফরিদ ঠিকাদারকে দেখা গেলো গ্যারেজে রাখা কালো পাজেরোতে চড়ে বসতে। গেট
দিয়ে বের হবার মুখে পাজেরো থামিয়ে জানালার কালো গ্লাস নামিয়ে রমিজকে খুব
ব্যাস্ততার কথা বলে হাতে এক হাজার টাকার একটা নোট গুজে দিয়ে চলে গেলো। দারোয়ানের
মুখে ফরিদ স্যারের অনেক সুনাম। মাজার-মসজিদ-স্কুল
সবেতেই ফরিদ স্যার দান-ধ্যান করেন। ঈদ উৎসবে দারোয়ান মালীদের বখশিশ দেয়। গত
সিটি ইলেকশনে স্যার এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হয়েছে। কত ব্যাস্ততা এখন তার।
ভবনের বাইরে আসে তারা দুপুর পেরোনো ক্ষুধা
পেটে নিয়ে। রাস্তার বিক্রেতার কাছে কলা বনরুটি কিনে খেয়ে গলিপথ ধরে কাউরানবাজার
ফিরে আসে। মন্টুর কাছে বিদায় নিয়ে তারা মোজাম পাইকারের ট্রাকের পেছনে যেয়ে বসল।
এবার বাড়ি ফিরতে হবে।
মানিক মিয়া এভিনিউ এ আধো সন্ধ্যায়
জ্যামে আঁটকে বসে আছে ওরা। সংসদ ভবন দেখে উৎসুক উচ্ছ্বাস দেখায় রেজাউল। রমিজ কিছুটা
শান্ত চোখ মুখ নিয়ে নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে মলিন হাসে। ৭৩ এর দিকে সে কিছুদিন
জাতীয় সংসদ ভবনেরও একজন নির্মাণ শ্রমিক ছিলো। তারা শ্রমিকেরা সবাই নির্মীয়মাণ
ভবনের পাশে অস্থায়ী টিনের চালায় থাকতো। মাঝের অধিবেশন হলের কাঠামোটা তখন দাঁড়িয়ে
গেছে। অধিবেশন হলের ফ্লোরে রক্ষী বাহিনীর সৈনিকরা বেঞ্চি পেতে ঘুমায়। রমিজের
শান্তিডাঙ্গা থেকে পাঁচ মাইল দূরের কাঞ্চনপুরে বাড়ি এক রক্ষী সৈনিকের সাথে
ঘনিষ্ঠতা হয়। ঈদে বাড়ি যেতে না পেরে রক্ষী ছেলেটা রমিজের হাতে চিঠি আর টাকা
দিয়েছিলো তার কাঞ্চনপুরের বাড়িতে পৌঁছে দিতে। সেই বাড়িতে গিয়ে বৃদ্ধ বাবা মা আর
কিশোরী স্ত্রীর বেদনা-আনন্দ মিশ্রিত কান্নায় রমিজের চোখও ভিজেছিল। রক্ষীর মা জাংলা
থেকে লাউ কেটে ডিম দিয়ে রান্না করে খাইয়েছিলো। সে লাউয়ের স্বাদ কাউরানবাজারের
চালানি লাউয়ে পাওয়া যায়না। পরের বছর ঈদে ছুটি পেয়ে সেই রক্ষী তার সাথেই বাড়ি যায়,
বলে আর ফিরে আসবেনা,করবেনা এই চাকরি, কত মেহেনতের কাজ আছে, তাই করে পেট চালাবে।
পেট! কত লোকের কতভাবে চলছে।
সংসদ ভবনের জ্যাম ছেড়ে সাভার স্মৃতি
সৌধ, নবিনগর, কালিয়াকৌর হয়ে ট্রাক এখন টাঙ্গাইল বাইপাসে। সামনেই যমুনা সেতু। টোল
প্লাজায় টোল দিয়ে ট্রাক যখন সেতুর ওপরে, রেজাউল দাদাকে বলে আর কখোনো সে ঢাকা
আসবেনা। ঢাকায় নিজেকে কুকুরের চাইতেও অসহায় মনে হয়েছে তার। পুলিশের ভদ্র কুকুর,
বড়লোকের বিদেশী কুকুরগুলোর গলায় দামি চামড়ার বেল্ট বাঁধা , শুধু মন্টু মামার
পাহারাদার কুকুরটাই যা একটু স্বাধীন। দাদার কাছে তার আকুতি সে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার
হতে চায়না। ঢাকায় এসে কুকুরের মত লাঠিপেটা খেতে চায়না রেজাউল। নাতির এসব কথা
শিশুসুলভ ধরে নিয়েও একধরণের ভয় উদ্বেগ আর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় কুঁকড়ে যায়
রমিজ, নাতিকে আঁকড়ে চলমান ট্রাকে বিস্তীর্ণ যমুনার চরের মাঝে সেতু অতিক্রম করে।
সেতুর নাম বঙ্গবন্ধু বহুমুখী যমুনা সেতু।
সেতুর পূর্ব পাড়ে যমুনা রিসোর্টে আজ
সপ্তাহের শেষ কর্ম দিবসের দিবাগত রাতে অতিথি সমাগম অন্যদিনের চেয়ে বেশী।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বছর বাইশের তরুণী তামান্নাকে সঙ্গে নিয়ে সড়ক ও সেতু
মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শাফাকাত সাহেব এসেছেন অবকাশ যাপনে। শাফাকাত সাহেব জানেন
না মেয়েটার নাম আসলেই তামান্না কিনা। নামের আসল নকলে কিছুই যায় আসেনা। তারা আজ
অবকাশ যাপনের সঙ্গী এই সময়টাই বেশী সত্য। নৈশভোজের পর যমুনার তীরে আরাম চেয়ারে
আধশোয়া আরামে নদীর তাজা বাতাস উপভোগ করছে তারা। অবসাদ দূরীভূত করে এমন বিশেষ জলও
পান করছেন জনাব শাফাকাত। তিনি আজ বেশ বিহবল ও অস্থির বোধ করছেন। নেশাক্রান্ত কণ্ঠে
তাঁর আজকের সঙ্গিনীকে প্রগলভ হয়ে অনেক কথা বলছেন। ব্যক্তিগত বেদনা, ক্ষোভ, অফিস ও
সামাজিক জীবনের দৈনন্দিন পিশাচতা থেকে মুক্তি চান তিনি। তামান্না একথা সেকথায় তাকে
উতফুল্ল রাখতে চেষ্টা করছে। কিন্তু শাফাকাত আজ বিনোদিত হবেন না মনে হচ্ছে। ক্রমাগত
বলে চলেছেন- গ্রাম থেকে ঢাকা পড়তে এসে নতুন জীবন পেলেন। ছাত্র জীবনে কত স্বপ্ন
পুষতেন দেশ-দুনিয়া পাল্টে দেবেন। সেসব কবে হারিয়ে জীবন শুন্য হয়ে গেছে। কালো টাকার
গাড়ি বাড়ি কোনো কিছুই এই গ্লানিকর শুন্যতা ভরাতে পারেনা। এই যমুনা সেতুর লেবার
পেমেন্টের হিসাব কত নয় ছয় হয়েও আপটুডেট ফাইলে পারফেক্ট অডিট রিপোর্ট হয়েছে, তার মনে
ছাড়া সে ইতিহাস কোথাও লেখা নেই। যেমন লেখা নেই কত শ্রমিকের ঘাম এই যমুনার চরের বালিতে
মিশে গেছে। তামান্নার কাছে তিনি এপোলজি করতে চাইছেন- তিনি এরকম পিশাচ ছিলেন না।
তিনি জন লেননের ইমাজিন শুনতেন। কিন্তু আজ তিনি যা পেয়েছেন বিনিময়ে ত্রিশ বছর আগের
শাফাকাত কে হারিয়েছেন। অদূরে যমুনা সেতুর পাটাতনে প্রজ্বলিত সারি সারি
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চলমান যানবাহন দেখে নেশাক্রান্ত শাফাকাত গর্জে উঠলেন- নিরব
নিঃশ্চল স্থবির হে মহাসেতু! তুমি সভ্যতার ভারবাহী গাধা!
জনাব শাফাকাতের এসব অসংলগ্ন উচ্চারণে
উৎকণ্ঠা বাড়ে তরুণী তামান্নার। আজকে কি শাফাকাত সাহেব সার্ভিস নেবেন না ? না নিলে
কাল পেমেন্ট টা কি প্রপারলি দেবেন? টাকা না পেলে সেমিস্টার ফি দেওয়া হবেনা, বাবা
স্বল্প বেতনের ছাপাখানার কর্মী, মায়ের প্রতিমাসের ওষুধ কেনার খরচ তামান্না দেয়।
বাসায় জানে কলসেন্টারে পার্ট টাইম নাইট শিফটে জব করে সে। এই মাসে আয় কম হয়েছে। এই
পেমেন্টের পুরো টাকা না পেলে সামনে মাসে তাদের পরিবারের এই ঢাকাইয়া জীবনের নিত্য অনিশ্চয়তা আরো ঘনীভূত হবে। কি হবে?
দুশ্চিন্তার ডালি মাথায় নিয়ে আধা ঘুমন্ত বিড়বিড় করা শাফাকাত সাহেবের মাথায় কোমল
হাতে বিলি কাটতে কাটতে যমুনা সেতুর চলমান সভ্যতার দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে
থাকে তামান্না।
ঠিক তক্ষুনি যমুনা সেতু পার হতে হতে
দাদা-নাতি ঘুমিয়ে পড়ে। ট্রাকের পেছনে গুটি শুটি মেরে চলন্ত ট্রাকের ঝাঁকুনিতে
দুলতে দুলতে পরস্পরের কাঁধে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে তারা। জেগে আছে
ট্রাকের ড্রাইভার আর তার পাশে বসা হেল্পার। হাটিকুমরুল মোড় রেখে খানিক সামনে এগোলে
হেডলাইটের আলোয় দুই জনেই দেখতে পায় কয়েকঘন্টা আগে ঘটে যাওয়া সড়ক দুর্ঘটনার ধ্বংস
চিহ্ন এখনো রাস্তায় ছড়িয়ে আছে। চূর্ণ হয়ে যাওয়া কাঁচের গুঁড়ো, পিশে যাওয়া লাশের
থেতলানো মাথার ছিটকানো সাদা টুকরো টুকরো
মগজ, রক্তের জমাট চাপ চাপ দাগ, ভগ্ন হাড়ের টুকরো। সামান্য সামনে দেখা গেলো নাড়ি
ভুঁড়ি বের হওয়া পিশে যাওয়া কুকুর। ড্রাইভার সতর্ক চালনায় দুর্ঘটনা স্থল এড়িয়ে
বনপারা-নলকা-হাটিকুমরুল মহাসড়ক ধরে এগিয়ে চলে গন্তব্যে।
ড্রাইভার হেল্পারকে টিপস দেয়- কুহুরডার
জন্যিই এয়াকসিডেন্ট হয়ছে। যহন তহন ভরাপরা জুন্তি এহেবারে সামনে চইলে আসে। পাকা
ড্রাইভার হতি হলি তিন জুন্তির্তে সাবধান। কুহুর, গরু ছাগল মুরগি মানুষ যারি হোক
তার বাছুর, আর মুরুব্বি কিছিমির লোকজন। ভাল্লাগতেছ্না। তোর চায়না মুবাইলি এট্টা গান শুনাদিনি।
হেল্পারের আঙ্গুলের
স্পর্শে বেজে ওঠে ‘মনের মাঝে তুমি’ ছবির গান-
আকাশ ছোঁয়া ---- স্বপ্ন
আশা
চাইছে জীবন------- আজ
ভালোবাসা
জীবনের পথে,সামনে কি আছে আমরা
জানিনা।
সময়ের সাথে চলেছি ভেসে,
ঠিকানা অজানা------
ড্রাইভার ধমক দেয়- ধুরর্ ব্যাটা,
আমরা লালনের দ্যাশের লোক। এয়াকসিডেন্টের
মরাধরা দেহার পরেত্যে পরানডা কিরোম দাপাচ্চে। সাইজির গান বাজা। ইট্টু
শান্তি পাই।
হেল্পার বাজায়-
শোনায়ে লোভের বুলি।
নেবেনা কেউ কাঁধের ঝুলি ।।
ইতর আতরাফ বলি ।
দূরে ঠেলে নাহি দেবে।।
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে।।
নেবেনা কেউ কাঁধের ঝুলি ।।
ইতর আতরাফ বলি ।
দূরে ঠেলে নাহি দেবে।।
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে।।
আমির ফকির হয়ে এক ঠাই ।
সবার পাওনা পাবে সবাই ।।
আশরাফ বলিয়া রে হায়
ভবে কেহ নাহি পাবে ।
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে।।
সবার পাওনা পাবে সবাই ।।
আশরাফ বলিয়া রে হায়
ভবে কেহ নাহি পাবে ।
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে।।
ধর্ম কুল গোত্র জাতির ।
তুলবে না গো কেহ জিগির ।।
কেঁদে বলেন লালন ফকির।
কে মোরে দেখায়ে দেবে ।।
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে।।
তুলবে না গো কেহ জিগির ।।
কেঁদে বলেন লালন ফকির।
কে মোরে দেখায়ে দেবে ।।
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে।।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে।।
জাতি গোত্র নাহি রবে।
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে।।
স্থবির মহাসড়ক পেছনে ফেলে চলন্ত ট্রাক রাতের
আঁধারে হেডলাইটের আলো জ্বেলে সামনে এগিয়ে
চলে। দাদা-নাতি ঘুমোচ্ছে । ট্রাকের পেছনে
গুটি শুটি মেরে চলন্ত ট্রাকের ঝাঁকুনিতে দুলতে দুলতে পরস্পরের কাঁধে মাথা রেখে পরম
নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে তারা। ঘুমন্ত চোখে
নতুন ভোরের স্বপ্ন দুলছে।
চলন্ত ট্রাকের চাকার টায়ার
আর সড়কের পিচ মাখানো পাথর পরস্পরকে পিশে চুমু খায় আর হিস ফিস করে আলাপ করে- তুমি
আমি মিলে সভ্যতা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
চায়না মোবাইল ফোনে বেজে ওঠে পরম সুর-
এই দেশেতে এই সুখ হল
আবার কোথা যাই না জানি
পেয়েছি এক ভাঙ্গা তরী
জনম গেলো সেচতে পানি।।.........
আবার কোথা যাই না জানি
পেয়েছি এক ভাঙ্গা তরী
জনম গেলো সেচতে পানি।।.........
লেখক: সোহাগ পারভেজ
গল্পকার