ডিসেম্বর মাস।
তীব্র শীতে জনজীবন বিপর্যস্ত। গ্রামীণ
জীবনে একটু বেশি সংক্রমণ
হয়। তবুও
মানুষ এই ঋতুর জন্যই
পাগল থাকে। বাহারি
ধরনের পিঠা পুলি আর
তাজা সবজির মহনীয় সুবাসে
ভরে উঠে রূপসী বাংলা। আর
এই মাস আসলেই কেমন
জানি আনন্দময় হয়ে উঠে বিশেষ
করে পড়ুয়া ছাত্র - ছাত্রীদের। বার্ষিক
পরীক্ষা শেষে সবাই ভ্রমণ
আনন্দে মেতে উঠে।
উঠতি বয়সী বালক বালিকাদের
আনন্দ হয়ে
উঠে আগ্রাসী। শাসনের
জিঞ্জির থেকে কিছু দিনের
জন্য ওরা সদ্য কারা
মুক্ত। নাটাই
হাতে রেখে সূতা লম্বা
করে পিতা মাতাও ছাড়
দেন কিছুদিনের জন্য ঘুড়ি
গুলোকে মুক্ত আকাশে
বিচরণ করতে। নতুন
বছরের শুরুতেই আবার আকাশের সীমানা
ছোট হয়ে উঠে।
রিনির আকাশও কিন্তু ভীষণ
বড় এই সময়ে ।
ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। আগ্রাসী
আনন্দধারা বহমান সারাদিন।
রিনির জীবনের নব অধ্যায়ের
হাতছানির ডাক পড়ে ।
আগামী ৩০ শে ডিসেম্বর
রিনির বিয়ে। বরের
নাম ধ্রুব। থাকে
কানাডায়। পেশায় সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। বাড়ী
ঢাকাতেই , রিনিদের বনানীর বাসা থেকে
বেশি দূর নয়।
বাংলার সংস্কৃতির আভিজাত্য নিয়মেই বিয়ে সম্পন্ন
হলো। নব
জীবনের প্রতি মূহর্তের মূল্যায়ন
কেবল একজন প্রেমিক ই
করতে পারেন। রিনি
ও ধ্রুব বিয়ে পূর্ব
জীবনে কোন সম্পর্কে জড়ায়নি। বিয়ের
পরও দুজন দুজনকে প্রেমিক
ও প্রেমিকার মতো লাগছে।
লাজুক ভাব , খুনসুটি, মেকি
ঝগড়া , আবার রাগ থেকে
অনুরাগ নিত্য দিনের ব্যাপার
হয়ে উঠে। ধীরে
ধীরে দুজনের একে অপরের
প্রতি বিশ্বাস ভালোবাসা আর বুঝাপড়া গভীর
হতে থাকে।
রিনি আর স্বামী স্ত্রী
হয়েও দিন দিন দুজন
দুজন কে জানার আগ্রহের
অন্ত নেই। প্রত্যহই
তাদের জন্য এক নতুন
দিনের নতুন প্রেমের গল্পের
মতো।
ধ্রুব স্থির করলো রিনিকে
নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে। শুরু
হলো হানিমুন পর্ব। সিলেট
, চট্টগাম , কক্সবাজার ও বান্দরবন ঘুরে
বেড়ানো হলো মুক্ত বিহঙের
মতো। জীবনের
স্মরণীয় ও বর্ণালী সময়ে
নতুন অধ্যায়ের পাতায় স্মৃতিময়
হয়ে থাকবে প্রেমিক যুগলের
এই সময়গুলো। মানুষের
জীবনের বিভিন্ন আনন্দের মুহূর্ত আসে তবে এই
ধরনের মূহুর্ত শুধু একবারই আসে। দুজনই
কৃপণহীন ভাবে সময়ের সু-ব্যবহার করে চলেছে।
প্রেমময় হয়ে উঠে সর্বক্ষণ।
ধ্রুব ও রিনির মন
খারাপ । এ
যেন জোছনা রাতকে হঠাৎ
কালো মেঘ ঘিরে রেখেছে
আর চাঁদ মাঝে মাঝে
মেঘের কালো ছায়া ভেদ
করে জোছনা ছড়াতে গিয়েও
ব্যর্থ ।
ধ্রুবের ছুটি শেষ দেশান্তরী
হওয়ার সময় হয়ে এলো। রিনির
মনটা একটু বেশি রকমের
খারাপ। যাওয়ার
বেলায় রিনির আঁখি জল
ধ্রুব স্পর্শ করে বলে
এমন করে কাঁদার কোন
মানে নেই। তোমার
স্বামী কোথাও হারিয়েও যাচ্ছেনা
আর অন্য কোন মেয়ের
এমন ক্ষমতা হয়নি যে
তোমার মতো ভালোবেসে আমাকে
নিয়ে যাবে। ধ্রুবের
ও মন খারাপ তবুও
রিনিকে হাল্কা করার জন্য
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো।
ধ্রুব কানাডায় এসে পৌঁছলো।
ধ্রুব ও রিনির বিরহী
জীবনের প্রারম্ভিক হয়ে যায়।
প্রত্যহ দুজনেরই প্রযুক্তির বিপ্লবীর মাধ্যমে ভিডিও চ্যাট হয়। তবুও
মন ভরেনা। স্বর্ণালী
সময়ের চাহিদা
ভিন্ন কিছু থাকে।
আর ভৌগলিক দূরত্ব রেখে
সম্ভব নয়। এ ভাবে কেটে
যায় পাঁচ মাস।
ধ্রুব আর পারছেনা ।
তার আর রিনির ভৌগলিক
দূরত্বের অবসান করতে হবে। এই
ভেবে অফিসের বসের নিকট
গেলো ছুটির জন্য অনুরোধ
করতে। বস
সহজে রাজি হলোনা।
জগতের কোন বসই মনে
হয় প্রেমিক হতে পারেনি।
কেবল হতে পেরেছে মন
অত্যাচারী শাসক। বহু
মিনতি করে বসের মন
গলাতে সক্ষম হলো ধ্রুব।
রিনির খুশির অন্ত নেই। ধ্রুব
এখন টরোন্ট বিমান বন্দরে
বসে আছে। রিনি
ও ধ্রুব ফেইসবুকে চ্যাট
রুমে এসে চ্যাট করতে
লাগলো। দীর্ঘ
১২ ঘণ্টার ফ্লাইট পর্যন্ত
অপেক্ষাও অনেক অসহনীয়।
রিনি জিজ্ঞাসা করলো তোমার কেমন
লাগছে এখন ? প্লিজ তোমার
অনুভূতি একটু বলো।
ধ্রুব বলল দশমিনিট পর
বলবো। রিনির
জিজ্ঞাসা কেন? তুমি কি
ধার করে অনুভূতি জানাবে
নাকি? ধ্রুব হাসে আর
বলল ধার থেকেও ভয়ংকর
হবে। তুমি
জাস্ট ১০ মিনিট সময়
দাও আমায়। রিনি
রাজি হলো।
ধ্রুব যখনই অতি আবেগী
হয় যায় তখন সে
কবিতা লিখে তা প্রকাশ
করে। এই
ব্যাপারটা ধ্রুব ইচ্ছা করেই
রিনিকে কখনো বলেনি।
কারণ যখনই ধ্রুব আবেগী
হয়ে উঠে তখনই সে
রিনিকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লিখে। ধ্রুবের
কবিতার লিখার ব্যাপারে ভীষণ
ক্ষমতা হলো সে উপস্থিত
কবিতা যে কোন বিষয়কে
কেন্দ্র করে লিখতে পারে।
ধ্রুব দ্রুত মোবাইলের নোট
প্যাডে কবিতা লিখা শুরু
করলো :-
প্রিয়তমা রিনি
তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য
কতটুকু ব্যাকুল আমি তা আমি
সহজ ভাষায় ব্যক্ত করতে
অক্ষম। তবে
আমি না বললেও তুমি
আমার চোখের দিকে তাকিয়েই
বুঝে নিবে সেই বিশ্বাস
আমার আছে। আমার
এই ক্ষুদ্র নিবেদন আমার রিনির
জন্য
--
"তোমার আমার দূরত্ব ভৌগলিক
আমার সকল সত্ত্বায়
তোমার দেওয়া আদরের ছাপ
কবে কখন আবার বিলীন হবো তোমার স্বর্গে
পুরনো বাস্তবতা আজ স্বপ্নচারী অলীক।
প্রবল ইচ্ছা আমার অবগাহনের
গিরিপথের স্বর্গীয় অনর্ঘ
উষ্ণ অধরে পরিশ্রমী চাষির ঝরা গামের ঝাঁঝালো গন্ধ
উন্মাদ হতে চাই আবার।
নিত্য স্পর্শ তোমায়
তবুও সে তো নহলী
নব জীবনের হাতছানি দেয় নিষিদ্ধ কপাট
জোছনার আলো লজ্জায় অবনত
ঘোর আঁধার , এ তো প্রণয়ের ললাট।
দ্বিতীয় ধরা তুমি আমার
বাকি সব আজ নিলামে
নিয়মের পৃথিবী তুচ্ছ আমার
তোমার সর্ব শব আমার পৃথিবী
তোমার নি:শ্বাসেই আমার প্রাণ
বলো হে প্রিয়া " ভালোবাসাই মহান"
ধ্রুব কবিতা লিখা শেষ
করে রিনিকে মেসেঞ্জারে দেয়। রিনি
কবিতা পড়ে চুপ হয়ে
যায়। ধ্রুব
জিজ্ঞাসা করলো কি ব্যাপার
রিনি তুমি যে চুপ?
রিনি বলে আমার তো
বলা তুমি শেষ করে
দিয়েছো। কি
আর বলবো কবিতার বাস্তবতা
দেখবো সেই অপেক্ষার প্রহরে।
দীর্ঘ ১২ ঘণ্টার বিমান
ভ্রমণ শেষে ধ্রুব বাসায়
পৌঁছে। মা
বাবা ভাই বোন সবাই
সবাই দেখতে এলো কিন্তু
রিনি এলোনা। বাঙালী
নারীদের প্রথম দিন আর
প্রথম রাতে লজ্জা বোধ
হয় একটু বেশিই হয়। দ্বিতীয়
দিন থেকে সকল লজ্জা
স্থান পায় গংঙার জলে। না
রিনির লজ্জা আর গংঙার
জলে দেওয়ার দরকার হবেনা। রিনি
এক গ্লাস শরবত নিয়ে
ধ্রুব কে দিলো।
ধ্রুবের দুই নয়ন কেবল
রিনির মায়াময় বদনেই সীমাবদ্ধ। দীর্ঘ
ভ্রমণের ক্লান্তি নিমিষেই প্রশান্তিতে রুপায়ন।
দিন গড়িয়ে মাস শেষ
হলো। আবারও
ধ্রুবের দেশান্তরী হওয়ার পালা।
দুজনার বিরহী অধ্যায় শেষ
কবে হবে বোধহয় আল্লাহ
মালুম। অন্নের
দায়ে ধ্রুব আর রিনির
জোছনা হয় গৃহত্যাগী।
এবার রিনি থেকে ধ্রুবই
বেশি মন খারাপ করে
আছে। এক
রকম যেতেই মন চাইছেনা
তার। ঝলসানো
রুটি দিয়েও তো প্রণয়ীর
সাথে জোছনা উপভোগ্য হয়না। সৃষ্টি
কর্তার অন্য রকম লীলা
খেলা এক দেশের মানুষের
রুটি আসে লক্ষ মাইল
দূর থেকে। অথচ
এই দেশেও অন্নের যোগান
হয়। তাই
ধ্রুব এই বিলাসী জীবনকেও
ধূসরই মনে করে।
ধ্রুব যাওয়ার বেলায় এবার
আর কান্না গোপন করতে
পারেনি। মা
বললেন কি রে বাপু
পুরুষ মানুষ আবার কাঁদে?
আরো শক্ত হতে হবে
বাপ। রিনি
ধ্রুবকে সহজ করার জন্য
বলল - তোমার বৌ তো
কোথায় হারিয়ে যাচ্ছেনা ।
তুমি আবার আসলেও আমাকে
পাবে। বেদনার
মূহুর্তে ও সবাই অট্ট
হাসির রোল পড়লো।
ধ্রুবের প্রস্থান। রিনির
জন্য জোছনার গৃহত্যাগ।
আবার সেই প্রযুক্তির উপর
যতটুকু নির্ভর করা যায়। এ
ভাবে চলে যুগলের প্রণয়
অধ্যায়।
কেটে যায় মাস দুয়েক। মিশ্র
প্রকৃতি। কখনো
উষ্ণ , কখনো শীতল।
প্রকৃতির এই একাধিপত্যের কাছে
মানবকুল অসহায়। বিশ্বায়ন
ও প্রযুক্তির মহা বিপ্লবী যুগেও
মানবজাতি প্রকৃতির অদৃশ্য শক্তির নিকট
অতি নস্যি।
বিকেলের সূর্য ক্লান্ত হয়ে
শশীর ছায়া তলে হারোনার
সময় হয়ে এলো।
পূব আকাশে উদিত হওয়া
সেই সূর্য এখন পশ্চিমে
লাল আভার রূপ ধারণ
করেছে।
না আজ চাঁদ দেখা
যাচ্ছেনা। সূর্য
তার ওয়াদা পূর্ণ করেছে। সে
তার সময়ের বেশি পৃথিবীতে
আলো ছড়ায়নি। তবে
কেন আজ চাঁদ মায়াহীন
হয়ে গেলো। পৃথিবীর
বুকে কেন ছড়ায়না শীতল
আলো?
খবর এলো কোন এক
নক্ষত্রের পতন হয়েছে।
তাই আজ চাঁদ গভীর
অমানিশার রূপ ধারণ করেছে। নিস্তব্ধ
আর অন্ধকার পৃথিবীর মাঝে বেঁচে থাকার
অভিজ্ঞতা সৃষ্টি কর্তা কতজনের
জন্য লিপিবদ্ধ করেছেন জানা থাকলে
ধ্রুব প্রত্যেকেই গিয়ে বলতো " হে
মানব আরো একটা অন্ধকার
পৃথিবী অপেক্ষমাণ" । আমার
জন্য এতো হতাশ হয়োনা। নিজের
অনাগত দিনগুলি গণনা করে প্রথম
অধ্যায়ের কল্পপূরীর কথা না ভেবে
দ্বিতীয় অধ্যায়ের স্বপ্নপূরীর
জন্য ভাবাই জ্ঞানের পরিচয়।
কল্পলোকের মায়ার গল্পের সমাপনী
করতে কারো অনুমতির দরকার
হয়না। সব
হয়ে যায় চোখের পলকে
অদৃশ্যকরণ জাদুতে। সবার
জন্যই তা প্রযোজ্য।
ধ্রুব এখনো কল্পলোকের
স্বপ্নের সলিল সমাধির নিকট
দাঁড়িয়ে আছে ভয়হীন চিত্তে। সময়
এলে ধ্রুব ও যাবো
তার মতো সেই বৃত্তে।
১৫ মার্চ । আজ
ধ্রুব"র স্ত্রীর চতুর্থ
মৃত্যু বার্ষিকী।
অকাল প্রয়াণে
ধ্রুবের না বলা সকল
ভালোবাসার কথা গুলো আজ
কাব্যে পরিণত। ধ্রুব"র জমা
আছে অনেক না বলা
কথা। সেই
সব কথা দিয়ে রচিত
হবে মহাকাব্য "কল্পলোকের গল্প "