নভেরা আহমেদ (মার্চ ২৯, ১৯৩৯–মে ৬, ২০১৫) ছিলেন একজন বাংলাদেশী ভাস্কর। তিনি বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের অন্যতম অগ্রদূত এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম বাংলাদেশী আধুনিক ভাস্কর।১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক প্রদান করে। তিনি প্রায় ৪৫ বছর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্যারিসে বসবাস করেন।
নভেরা আহমেদ—একজন অভিমানী শিল্পীর নাম। ভাস্কর্য শিল্পের এক উজ্জ্বল কিংবদন্তি। নিজের সময়ের চেয়ে অগ্রবর্তী শিল্পসাধনা ও অজ্ঞাতবাসের জীবন তাঁকে পরিণত করেছিল জীবন্ত কিংবদন্তিতে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অন্যতম রূপকার এই ভাস্কর স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন প্রবাসজীবন। প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই নারী জীবনের ৪৫টি বছর নীরবে-নিভৃতে কাটিয়েছেন প্যারিসে।
বাবা সৈয়দ আহমেদ সুন্দরবন অঞ্চলে কর্মরত অবস্থায় ১৯৩০ সালে জন্ম হয় নভেরা আহমেদের। তবে নভেরার পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের আসকারদিঘির উত্তর পাড়। আইন বিষয়ে পড়তে ১৯৫১ সালে নভেরা আহমেদকে পরিবারের পক্ষ থেকে লন্ডনে পাঠানো হয়। ভাস্কর হওয়ার অদম্য স্পৃহায় নভেরা যোগ দেন সিটি অ্যাওয়ার্ড গিল্ড স্টোন কার্ভিং ক্লাসে। পাঁচ বছর পড়াশোনার পর ন্যাশনাল ডিপ্লোমা পেয়ে দুই বছরের জন্য তিনি ফ্লোরেন্সে যান। সেখানে প্রাচীন কয়েকজন শিল্পীর কাজের সঙ্গে পরিচিত হন এবং কাজ শেখেন।

একজন ভাস্কর্য্য শিল্পী হিসেবে নভেরা আহমেদের মূল প্রবণতা ফিগারেটিভ এক্সপ্রেশন। তার কাজের প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে নারী প্রতিমূর্তি। তবে নারী প্রতিমূর্তি নির্মাণে তিনি বিমূর্ততার দিকে ঝুঁকেছেন। কাজেরে স্টাইলের দিক থেকে তিনি ব্রিটিশ ভাস্কর হেনরী মূর (১৮৯৮ - ১৯৮৬ খ্রি.) অনুবর্তী। পরবর্তী কালে আরো একজন ভাস্কর একইভাবে হেনরী মূর দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছেন তিনি হলেন জুলিয়া কেইক (১৯৭৩ - )। নভেরা আহমেদ এবং জুলিয়া কেইক-এর কাজের মধ্যে আশ্চর্যজনক সমিলতা রয়েছে।
নভেরার বেশকিছু ভাস্কর্যে আবহমান বাংলার লোকজ আঙ্গিকের আভাস মেলে। লোকজ ফর্মের সাথে সেখানে সমন্বয় ঘটেছে পাশ্চাত্য শিক্ষার। লোকজ টেপা পুতুলের ফর্মকে সরলীকৃত করে তাকে দক্ষতার সাথে বিশেষায়িত করেছেন তিনি। ঐতিহ্যের সাথে পাশ্চাত্য শিক্ষার সার্থক উপস্থাপনের চেষ্টা তাঁর আধুনিক চিন্তার পরিচায়ক। তাঁর ভাস্কর্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—তিন কোণা আদল, ছিদ্র চোখ, লম্বা গ্রীবা। তাঁর কাজের প্রধান দিক হচ্ছে—নারীদের প্রতিমূর্তি। সমসাময়িক পুরুষ শিল্পীদের নির্মিত নারীদেহের রোমান্টিক ইমেজের বিপরীতে তিনি নারীকে দেখেছেন সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে। তাঁর কাজে নর-নারীর কম্পোজিশন একটি ঐক্য গঠন করে। তিনি তাঁর ফর্মগুলোকে সরল, অর্থপূর্ণ, স্বকীতায় সমৃদ্ধ করেছেন। উন্মোচন করেছেন সব ধরনের বিচলিত, আবেগমথিত, সত্যিকারের নারীর রূপকে। মা শক্তিদায়িনী, সংকল্পবদ্ধ, অকপট, মৌন আকর্ষণরূপে উদ্ভাসিত। তাঁর মায়েরা সুন্দরী নয়, কিন্তু শক্তিময়ী ও সংগ্রামী। কখনো কখনো তারা মানবিকতার প্রতীক।
সে সময় ভাস্কর হিসেবে নিজের একটা দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন নভেরা।
সমসাময়িক পুরুষ শিল্পীরা ইউরোপীয় ইন্দ্রিয় সুখাবহ নারীদেহে একটি রোমান্টিক ইমেজ দেবার চেষ্ট করেন। এমনকি জয়নুল, কামরুলরা নারীকে মাতা, কন্যা, স্ত্রী এবং অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখালেও নারীদের যথার্থ কর্মময় জীবন উহ্যই ছিল। নভেরা আহমেদ নারীকে দেখেছেন সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে, পুরুষ শিল্পীদের উপস্থাপনার বিপরীতে। তার কাজে নর-নারীর গ্রন্থনা একটি ঐক্য গঠন করে। তিনি ভাসা ভাসা সুন্দর আনন্দময়ী আদর্শ ফর্ম করার পরিবর্তে তার ফর্মগুলোকে সরল, অর্থপূর্ণ, স্বকীয়তায় সমৃদ্ধ করেছেন। উন্মোচন করেছেন সবধরণের বিচলিত, আবেগমথিত, সত্যিকারের নারীর রূপকে। দি লং ওয়েট কাজটি তারই নমুনা। তার মায়েরা সুন্দরী নয়, কিন্তু শক্তিময়ী, জোড়ালো ও সংগ্রামী। তারা মানবিকতার ধ্রুপদী প্রতীক।
নভেরা তার শিল্পকর্মে একঘেয়েমি কাটাতে পরবর্তীতে কতগুলো কাজে ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেছিলেন। যেমন: নগ্ন নারী মুর্তি, লম্বা গ্রীবা ও মাথার এনাটমিতে বাংলাদেশের ‘কন্যা-পুতুলের’ আঙ্গিকের পাশাপাশি হাত-পা-শরীরের অবস্থান স্থাপনের ক্ষেত্রে মদীয়ানির ফর্ম ও ড্রইভের সুষমা, স্তন ও শরীরের উপস্থাপনায় মহেঞ্জোদারোর ‘বালিকা-মূর্তির’ প্রাচ্য অভিলাষকে একত্রিত করেছেন। অন্যদিকে প্লাস্টার অব প্যারিসে নির্মিত দু’টি ভাস্কর্যে মুখমন্ডল বহুলাংশে বাস্তবধর্মী, সামান্য গান্ধারা শিল্পধারায় প্রভাবিত। সম্ভবত এই মস্তক দু’টি বুদ্ধের মস্তকের অনুকরণে অণুকৃতি।
নভেরার বেশকিছু ভাস্কর্যে আবহমান বাংলার লোকজ আঙ্গিকের আভাস পাওয়া যায়। তবে লোকজ ফর্মের সাথে সেখানে পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়ও বর্তমান। লোকজ টেপা পুতুলের ফর্মকে সরলীকৃত করে তাকে দক্ষতার সাথে বিশেষায়িত করেছেন তিনি। এভাবে ঐতিহ্যের সাথে পাশ্চাত্য শিক্ষার স্বার্থক ভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা তার আধুনিক চিন্তার লক্ষণ। এক্ষেত্রে তার ভাস্কর্যগুলো আদলে তিনকোনা, চোখ ছিদ্র, লম্বা গ্রীবা অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য হিসেবে আসে।

১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কর হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি। ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব পেইন্টিং স্কাল্পচার এ্যান্ড গ্রাফিক আর্টস শিরোনমে এই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া তার ছ’টি ভাস্কর্যের মধ্যে চাইল্ড ফিলোসফার নামে একটি ভাস্কর্য বেস্ট স্কাল্পচারে পুরস্কৃত হয়।
পরে ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। তাকে নিয়ে নভেরা (১৯৯৫) শিরোনামে জীবনী উপন্যাস রচনা করেছেন হাসনাত আবদুল হাই। নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্য চিত্র নহন্যতে (১৯৯৯)। এক সময় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের একটি হলের নামকরণ করা হয়েছিল "ভাস্কর নভেরা আহমেদ হল"। বর্তমানে বাংলা একাডেমী’র একটি হলের নাম নভেরা হল।
তথ্যসূত্রঃ তথ্য ও ছবি ইন্টারনেট ও উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহিত।