বাংলাদেশের আধুনিক চারুশিল্পের ইতিহাসে সকল বিবেচনায় যদি কেউ প্রথমেই স্যালুট পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬)। মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ তাঁর সমকক্ষ শিল্পী পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি দেখা যায়না। শিল্পের প্রতি তাঁর দায়বোধের পুরোটাই প্রকাশিত হয়েছে মানবতার শৈল্পিক রূপায়নে।
![]() |
জয়নুল আবেদিনের জন্ম বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে ১৯১৪ সালে একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। ছেলেবেলা থেকেই তার ভেতর ছবি আঁকার প্রতি ভীষণ আগ্রহ দেখা গিয়েছিল। অবশেষে নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তিনি কলকাতা সরকারী আর্ট স্কুলে ছবি আঁকা শিখতে গিয়েছিলেন ত্রিশের দশকের গোঁড়ায়।
২.
ত্রিশের দশকে জয়নুল আবেদিন যখন ছবির জগতে আত্মপ্রকাশ করেন তখন কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলার চিত্রকলায়
প্রধানত: দু’টি বিশিষ্ট ধারা বিদ্যমান ছিল। একদিকে পশ্চিমা সাদৃশ্য ধর্মী একাডেমিক ধারার অনুবর্তী শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার,
যামিনী প্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, অতুল বসু প্রমুখ। অন্যদিকে, নব্য বঙ্গীয় ঘরানার স্তম্ভ রূপে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার শিষ্যকূল— যাদের ছবি ভারতীয় শৈলীর ছবি হিসেবে একটি বিশেষ অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে আবদ্ধ ছিল। এই দুই ধারার শিল্পীদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত ও অংকন শৈলীগত পার্থক্য নিয়েও ছিল তুমুল বাদানুবাদ। সেই সময় কলকাতা সরকারী আর্ট স্কুলকে একাডেমিক রীতির দুর্ভেদ্য দুর্গ মনে করা হতো। তবে মাধ্যমের স্বাধীনতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার
স্বাধীনতা দিয়ে তৎকালীন আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ মুকুলচন্দ্র দে’ একটি অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। জয়নুল আবেদিন এরকম একটি পরিবেশের ভেতর চারুশিক্ষা লাভ করেছেন।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯২০এর দশকে রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে শান্তিনিকেতনে কলাভবন প্রতিষ্ঠিত হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রণোদনায় শান্তিনিকেতনের কলাভবনে নন্দলালের নেতৃত্বে প্রাচ্য ও
পাশ্চাত্যের শিল্পধারার উদার সংমিশ্রণে এখানে আরেকটি তৃতীয় শিল্পধারা গড়ে উঠেছিল। মূলত অবন ঠাকুরের বলয় থেকে বেরিয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাধারার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে নন্দলালের শিল্পভাবনায় ঘটেছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ধর্ম,
ইতিহাস কিংবা পুরাণ-কাহিনীর মাহাত্ম
বর্ণনার পরিবর্তে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে প্রকৃতি ও জীবন ঘনিষ্ঠ
বিষয় শিল্পকর্মে মূর্ত হতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ও
নন্দলালের সান্নিধ্যের কারণেই
মুকুল দে’ কলকাতা সরকারী আর্ট স্কুলে শিল্পচর্চায় স্বদেশ
ও বিশ্বের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই আদর্শ তরুণ জয়নুলকেও উদ্বুদ্ধ করেছিল ।
প্রাথমিকভাবে জয়নুল আবেদিনের আট স্কুলে ভর্তি হবার উদ্দেশ্য ছিল মূলত: পাশ্চাত্যের
একাডেমিক শৈলীর দক্ষতাকে
ভালোভাবে রপ্ত করা। ব্রহ্মপুত্র পাড়ের ছেলে জয়নুলের শিরায় শিরায় ছিল শিল্পের দুর্নিবার আকর্ষণ, আর মানুষের প্রতি মমতা মাখা চোখ। ফলে ছাত্রজীবনের প্রথম দিকের কাজগুলোতে তাঁর একাডেমিক শৈলীর নিপুণ দক্ষতার পাশাপাশি তীক্ষ্ম এক সংবেদনশীল পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার
প্রকাশ দেখা যায়।
জয়নুলের আঁকা গ্রাম-বাংলার দৃশ্য ও জীবন নির্ভর
ছবিতে রোমান্টিকতার সাথে সাথে দৃশ্যমান জগতের অনুভব ও
অন্তঃলীন সামঞ্জস্যের বোধ এবং এক
গভীর জাগতিক উপলব্ধি খুঁজে পাওয়া যায়।
৩.
মানুষের সৃজনশীল কাজে বিবৃত হয় তার দেশ-কাল ও সংস্কৃতি। প্রতিটি মানুষেরই সৃজনশীল অভিব্যক্তি প্রাথমিকভাবে
দেশ কাল সাপেক্ষে। এক্ষেত্রে হোমার কিংবা হেমিংওয়ের সাহিত্য,
প্র্যাস্কিটেলাসের ভাস্কর্য,
পিকাসোর গুয়ের্নিকা ইত্যাদি
শিল্প কীর্তির কথা উল্লেখ করা যায়। এমনকি গয়্যা বা গনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা সমকালীন সামাজিক ঘটনাবহুল ব্যঙ্গচিত্রের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। জয়নুল আবেদিনের আঁকা বাংলার মন্বন্বরের ছবিও তেমনি দেশকালের ছবি যা সমকালকে ধারণ করেও হয়ে উঠেছে কালোত্তীর্ণ।
১৯৩৮-’৪২ পর্যন্ত
এই কালপর্বে রোমান্টিক ধারায় চিত্রকলার পর জয়নুলের চিত্রকলায়
যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়, তা হয়তো আকস্মিক ছিল না। তবে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ কারণ ’৪৩
এর দুর্ভিক্ষ। পৃথিবীতে
এর আগে মানুষের তৈরি এত
ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা যায়নি। মনুষ্যত্বের এমন লাঞ্ছনা ও
অপমান নজিরবিহীন। দেশে রসদের কোন ঘাটতি ছিল না, অথচ ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের চক্রান্তে সেসময় প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা গিয়েছিল। এসময় শিল্পী জয়নুল এঁকেছিলেন এই মনুষ্য সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ক্ষুৎপীড়িত মানুষের ছবি, মানুষের অপমানের
ছবি। এইসব ছবিতে দেখা যায় ভিখারি মা-মেয়ে, ডাস্টবিনে কাক ও কুকুরের সাথে খাবারের জন্য সংগ্রাম রত মানুষ,
রাস্তার ধারে মৃত কিংবা অর্ধমৃত মানুষ ইত্যাদি। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, বিষয়,( আঙ্গিক
বিষয়), উপস্থাপনার
ভঙ্গি সবকিছুর সম্মিলনে জয়নুলের হাতে সৃষ্টি হয়েছিলো অসাধারণ সব স্কেচ। এই ছবিগুলোতে রূপকের আড়াল-প্রতীকের রহস্যময়তা কিংবা শৈলীর জটিলতা কিছু ছিল না; বরং ছিল প্রকট বাস্তবতার নির্মম উপস্থাপনা আর এক
মহৎ মানুষের বিচূর্ণ হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি।
জয়নুলের দুর্ভিক্ষের চিত্রমালায় প্রতিটি
অবয়ব বা
মূল বিষয়টি চিত্রপটের বিস্তারে তাদের স্বকীয় উপস্থিতি নিয়ে বিরাজ করছে। স্পেস (Space) এর
আয়তন জুড়ে থাকা অবয়বগুলোই প্রাধান্য বিস্তার করেছে। চিত্রগুলোতে ছড়িয়ে থাকা শূন্যতা ও কম্পোজিশনের (Composition)
নতুন মাত্রার গভীরতা এনে দিয়েছে। জয়নুল আবেদিন এই চিত্রমালায় শুধু সাদাকালো তুলির রেখার ব্যবহার করেছেন যা তাঁর পূর্ববর্তী
কাজে দেখা যায়নি। এসব কাজে স্থূল, কর্কশ, স্পষ্ট
এবং কালো রংয়ের তীব্রতা লক্ষণীয়। অনুমান
করা যায়,
বিষয়ের অনুভবেই শিল্পী জয়নুল এমন রেখা ব্যবহার করেছিলেন। এই রেখায় সরলীকরণ, বলিষ্ঠটা, স্পষ্টতা
খুবই তীক্ষ্মভাবে উপস্থাপিত
হয়েছে । অবয়বে শারীরিক শীর্ণতা ও দীর্ঘায়ণ আলাদাভাবে চোখে পড়ার মতো। শিল্পী জয়নুলের এই দুর্ভিক্ষের ছবির ভঙ্গি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যঞ্জনাত্মক ভঙ্গির টানাপড়েনে একটি মজবুত রৈখিক বৈচিত্র্য ও
বিন্যাসে সৃষ্টি হয়েছে অভূতপূর্ব নান্দনিক অভ্যাস। শিল্পী জয়নুল আবেদিনকে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের সংগ্রামী জীবন গভীরভাবে আলোড়িত করেছে। তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে রূপান্তর
করেছেন দুর্ভিক্ষের চিত্রমালাতে।
তিনি জীবনকে তত্ত্বের পথে খোঁজেননি। বরং শিল্পকলায় জীবনের রূঢ় সত্যকে উপস্থাপন করেছেন।
জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছবি স্বাতন্ত্র্যে অনন্য।
এই ছবিগুলো Content ও Form - এর
এক অপূর্ব সমন্বয়। চিত্রে অবয়ব প্রাধান্য পেয়েছে, আশ্চর্য
শূন্যতা Ñ গভীরতা সৃষ্টি
করে। জয়নুলের
‘দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা’র এই
স্থূল-কর্কশ, স্পষ্ট ও
কালোর তীব রেখা প্রাচ্য ও
পাশ্চাত্যের পরম্পরায় অপূর্ব সংমিশ্রণ। এই
রেখা বিষয়কে যেভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছে তা হয়তো অন্য কোন রেখা দিয়ে সম্ভবপর ছিল না। এর আগে তিনি সূক্ষ্ম সংবেদনশীল রেখা দ্বারা নিসর্গ-কোমল স্নিগ্ধতায় ফুটিয়ে
তুলেছেন। দুর্ভিক্ষের চিত্রের
রেখা ছায়াহীন অনুপুঙ্খবর্জিত, স্পষ্ট, বলিষ্ঠ
এবং সরল। এখানেই প্রথম তিনি একাডেমিক রীতির আনুগত্য পরিত্যাগ করে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছেন।
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ চিত্রমালায় জয়নুল তার সমাজ বাস্তবতার বোধকে শিল্পের আদর্শ হিসেবে অংকন করেছেন। তবে ১৯৪৪ সালে তাঁর কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ঘনিষ্ঠতার পর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের
শিল্প-সাহিত্য
বিষয়ক সম্মেলনে যোগ দেয়া এসব কিছুর মধ্যে জয়নুল নতুনভাবে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার আদর্শ খুঁজে পেয়েছেন হয়তো!
উনিশ শতকে বাংলার জাগরণ ছিল নগরকেন্দিক্র এবং তাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। শিক্ষার আগ্রহও মুসলমান অপেক্ষা অভিজাত হিন্দু শ্রেণীর বেশি ছিল। এমনকি বিশ শতকে মুসলমানদের জন্য চাকরিতে আসন সংরক্ষিত থাকলেও উপযুক্ত শিক্ষিত প্রার্থী পাওয়া যায়নি। এছাড়া বিশ শতকের প্রথমার্ধে ধর্মীয়
কারণেও মুসলমান সমাজ থেকে চিত্রশিল্পী দেখা গেছে খুবই কম। বিশেষ করে পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতর চিত্র চর্চার প্রচলন ছিল না বললেই চলে। সেক্ষেত্রে জয়নুল ছিলেন এক বিরল ব্যতিক্রম।
৪.
১৯৪৭ এর দেশভাগের পর কলকাতায়
সরকারী আর্ট স্কুলে শিক্ষাপ্রাপ্ত মুসলমান শিল্পীদের অনেকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় চলে আসেন। এই
শিল্পীদের হাতে ধরেই ঢাকায় ১৯৪৮ সালে চারু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। আর এই নতুন চারু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার আন্দোলনে নেতৃত্বে দেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন । তার সাথে সহযোগী হিসেবে ছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান,
শিল্পী আনোয়ারুল হক, শিল্পী শফিউদ্দিন
আহমেদ প্রমুখ। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটি পুরনো ঢাকার জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের দুটি কক্ষে Government Institution of Art - নামে যাত্রা শুরু করে, যা বর্তমানে চারুকলা অনুষদ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত। এই
শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি-ই বাংলাদেশের আধুনিক
শিল্পচর্চার প্রধান প্রাণকেন্দ্র। এখনো বাংলাদেশের চারুকলা
বিষয়ক সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু এই
প্রতিষ্ঠানটি।
সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই ১৯৪৮-এ তিনি ঢাকায় আর্ট স্কুল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এদেশের শিল্পকলাকে মানুষের সাথে সম্পৃক্ত করে তোলার জন্য সর্বোতভাবে সচেষ্ট
ছিলেন। সমাজ বা দেশের প্রতি দায়বোধই তাঁকে এই আর্ট স্কুল সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করেছে আমরা তাঁর কণ্ঠেই শুনতে পাই সেই উচ্চারণ “আমি নিজে শিল্পকর্ম করে যতটা আনন্দ পাই, তার চেয়ে বেশি আনন্দ পাই শিল্পকে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে দেখলে... ... .... শিল্পকলা চর্চা সেজন্যই সার্বজনীন করা একান্ত বাঞ্ছনীয়” ।
শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিনের শিল্পের পথে এই
নিরন্তর অভিযানই বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চার ভিত্তি
স্থাপন করে। তাঁর নিজের অনবদ্য সৃষ্টি নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে
বাংলাদেশের মানুষের শিল্পচর্চার দ্বার উন্মুক্ত করে গেছেন অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে। আমৃত্যু তিনি বাংলাদেশে চারুশিল্পের বিকাশে
নানা রকম পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে এখানে ঢাকায় লোকশিল্পের
প্রদর্শনী আয়োজন কিংবা সোনারগাঁয়ের লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা যায়। শিল্পী হিসেবে তো
বটেই, বাংলাদেশে
চারুশিল্পের বিকাশে এবং শিল্প ও শিল্পী সৃষ্টিতে গৌরবদীপ্ত ভূমিকাই তাঁকে ইতিহাসের ধূসর পাতায় উজ্জ্বল করে রাখবে।
লেখক: চিত্রশিল্পী, গবেষক।
লেখক: চিত্রশিল্পী, গবেষক।