সই ।। পূজা মৈত্র



অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে সাড়ে এগারোটা বেজে যাওয়া এখন অমিতের কাছে রোজকারের অভ্যাসের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে।গত ছ’মাসে কাজের বোঝা হঠাৎ বেড়ে গেছে এমন নয়।প্রোমোশনের সুখবরও অমিতের জীবনে আসেনি।তবুও আগেকার মত সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে বাড়ি ঢুকতে পারে না ও।পারে না,নাকি চায় না।অতচ তার আগের বছর আড়াই যেন তেন প্রকারেণ পাঁচটা বাজতে দশে অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়ত অমিত।পাঁচটা পঁচিশের গাড়িটা ধরতেই হবে যে।আড়ালে আবডালে সহকর্মীরা অমিতের এই তাড়াহুড়ো দেখে মুখ টিপে হাসত না তা নয়।অমিতের তাতে বয়েই যেত।কি আর বলবে ওরা,বড়জোর “বৌ পাগলা”।এর বেশি তো কিছু নয়।রূপকথার কাছে ঠিক সময়ে যাবার জন্য ওসব শুনতে কোন আপত্তি ছিল না অমিতের।বরং এখন মুখটা তেতো হয়ে যায় যখন দত্তদা একরাশ সহনুভুতি নিয়ে বলেন,”অমিত বাড়ি যাও,কত আর কাজ করবে?সাড়ে সাতটা বেজে গেল।এবার কিন্তু আমি বেড়িয়ে যাব।“দত্তদা অফিসের সবচেয়ে সিনিয়ার দায়িত্ববান লোক।সবার শেষে বেরোনো ওনার অভ্যাস।অমিত যে কাজ করার জন্য অফিসে বসে নেই একথা কি দত্তদা জানেন না?জেনেও…সহানভুতির প্রয়োজন নেই অমিতের।প্রয়োজন একটু শান্তির।মনের মধ্যে অহরহ যে দহন হচ্ছে সে জ্বালা কিভাবে মেটাবে ও?"যাচ্ছি দত্তদা।আর একটু।"তিক্ততা মুখে প্রকাশ করতে শেখেনি অমিত।তারপর ধীরে সুস্থে ব্যাগ গুছিয়ে হেঁটে হেঁটে শিয়ালদহ।তিন চারটে ট্রেন ভিড়ের বাহানায় অনায়াসে ছেড়ে দেয় অমিত।স্টেশনে কোণের একটা চেয়ারে একা বসে থাকে।কিছু ভাবে কি? নাহ। ভেবে কি লাভ? যা হওয়ার হয়েই তো গেছে।কাকিমা সেদিন বলছিল আর একটা বিয়ে করতে।ছুটির বিকালে বাড়ি এসে যেচে পাত্রীর সংবাদও দিয়ে গেছে।পাত্র হিসাবে এখনও অমিতের অনেক দাম।মোটা অঙ্কের সরকারী চাকরির স্ট্যাম্প গায়ে লেগে আছে।কাকিমা অমিতের মৌনতাকেই সম্মতির লক্ষণ ভেবে অনর্গল বলে চলেছিলেন,"তাহলে কথা চালাই?তাই ভালো।বৌ আসলে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।যার অভাবে মনমরা হয়ে থাকিস সেই….” “কাকিমা,তুমি যা ভাল বোঝ কর।"প্রসঙ্গটাকে আর বাড়তে দিতে চায়নি অমিত।“ সে তো অবশ্যই।ওর জন্য মনখারাপ করে কি লাভ বল?ও তো তোকে ঠকিয়ে গেছে।ওরা ঠগ,প্রতারক।"
                            “তুমি আমার সাথে এত বড় প্রতারণা করলে?” রুপকথাকে ঠিক ছয়মাস আগে এক শীতের সন্ধ্যায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অমিত জিজ্ঞাসা করেছিল।সঠিক হিসাবে পাঁচমাস আঠারো দিন।রূপকথা ক্ষীণকন্ঠে বলেছিল,"বিশ্বাস করো,আমি জানতাম না।"বারবার ওই একটা কথাই বলছিল ও।বিশ্বাস করার মত মানসিক অবস্থা অমিতের ছিল না,"বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।তোমাদের বাড়ির সবাই জানত আর তুমি জানতে না?যাইহোক,কোনরকমের অশান্তি আমি চাইনা।তোমার সাথে একসাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।"চরম এক বিতৃষ্ণার বশে বলে ফেলেছিল অমিত।রূপকথাকে।সেই রূপকথাকে যাকে ছাড়া একমুহুর্ত বাঁচতে পারবে ভাবেনি অমিত।“আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছ তুমি।আমার সমস্ত ইচ্ছা আশা আকাঙ্ক্ষায় জল ঢেলে দিয়ে বলছ তুমি কিছু জানতে না!যাক-তোমার থেকে আমি মুক্তি চাই।এইটুকু দয়া অন্তত তুমি আমায় করবে।তোমাকে চোখের সামনে দেখে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।" কথাগুলো অমিতের কানে হঠাৎ বেজে উঠল।দরজার ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফিরছিল অমিত।ট্রেনে অনেক সিট ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল।তবুও বসবার ইচ্ছা হয়নি।রূপকথাকে হারিয়ে অমিত কি আদৌ বেঁচে আছে?একে কি বেঁচে থাকা বলে?যা নেই তা পাওয়ার আশায় যাকে পেয়েছিল তাকে হারিয়ে আজ একেবারে নিঃস্ব অমিত।তবুও রূপকথাকে ফিরে পাবার কথা ভাবতে পারেনা ও।ভাবতে চাইলেও চোখের সামনে ভেসে ওঠে একরাশ ঘৃণাভরা দুটো চোখ।চলে যাবার সময় রূপকথা মুখে কিছু বলেনি।কিন্তু ওই চোখদুটো অনেককিছু বলেছিল।অমিতের বারংবার বলা ভালবাসার প্রতিটা কথাই কতটা অন্তঃসারশূন্য,কতটা স্বার্থের গন্ধমাখা-ঐ চোখদুটোতে স্পষ্ট লেখা ছিল যেন।তাই আর কোনদিন ঐ চোখদুটোর সামনে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না।
                     রূপকথাও কি এভাবেই ভাবে ওর কথা?প্রতিটা মুহুর্তে…নিশ্চয় ভাবে।সম্বন্ধ করে বিয়ে ওদের।রূপকথার দিদি সেঁজুতিকে দেখতে গিয়েই রূপকথাকে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল অমিতের।গ্র্যাজুয়েশন ফাইনাল ইয়ার পড়ছিল তখন রূপকথা।অমিতের থেকে বছর সাতেকের ছোট।অমিত তখন বছরখানেক হল চাকরিটা পেয়েছে।কাকা কাকিমার সংসারে মানুষ অমিত।স্বাবলম্বী হয়েই আর ওদের বোঝা বাড়াতে চায়নি।রূপকথার বাবা মায়ের প্রথমে অমত থাকলেও পরে এত ভাল সম্বন্ধ আর ফেলতে পারেননি।বড় মেয়েকে বিয়ে না দিয়েই ছোট মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন অমিতের জেদাজেদিতে।অমিত হাতে স্বর্গ পেয়েছিল যেন।ভাড়ার ফ্ল্যাটে নতুন সংসার পেতেছিল।রূপকথাকে দুনিয়ার সব সুখ এনে দিতে চেয়েছিল।এমন 'ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে'র জন্য রূপকথা প্রথমে প্রস্তুত ছিল না।কিন্তু পরে অমিতের সাথে চমৎকার মানিয়ে নিয়েছিল।মেয়েদের মধ্যে মানিয়ে নেবার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে।রূপকথাও ব্যতিক্রম ছিল না।অমিত যতটা ওকে ভালবেসেছিল রূপকথাও ঠিক ততটাই ফিরিয়ে দিয়েছিল।ভালবাসত অমিত রূপকথাকে।বাসত?না,না।এখনো বাসে।নাহলে রূপকথার মোবাইলটা একটা নতুন সিম থেকে রোজ রাত একটায় বাজিয়ে তোলে কেন?রূপকথা কি বুঝতে পারে অমিত-ই কলটা করে?পারে নিশ্চয়।একবার-ও রিং ব্যাক করেনি তাই।এমনটা কি অমিতের সাথেই হতে হল?কি দরকার ছিল রূপকথার মা-বাবার এতবড় কথাটা লুকানোর?রূপকথার সন্তান সম্ভবনা নেই তা ভালমত জেনেও…আর ভাবতে চায় না অমিত।ট্রেন স্টেশনে এসে গেছে।ঘড়ি দেখল।এগারোটা দশ।ট্রেনটা ভালই টেনেছে তাহলে।শীতলা পূজার মেলা চলছে এখন।রাস্তায় মেলা ফেরত কিছু লোক এখনো আছে।একটা সিগারেট ধরাল অমিত।বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল তারপর।
              রূপকথা কি সত্যি-ই জানত না?ওর একটা ডিম্বাশয় বাদ গেছে আর একটা দিকের টিউব এমন ভাবে ব্লক যে......রিপোর্টটা হাতে পেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল অমিত।অমিতের যখন মাত্র ছয় বছর বয়স মা-বাবা একটা দুর্ঘটনায় মারা যান।অনাথ হবার জ্বালা ভালোমতোই বোঝে তাই।চেয়েছিল নিজে বাবা হলে নিজের সন্তানকে স্নেহ ভালবাসায় ভরিয়ে দেবে।কত পরিকল্পনা করেছিল।ভাল বাড়ি দেখেছিল একটা।কিনবে বলে।ভাড়ার ফ্ল্যাটে নিজের সন্তানকে বড় হতে দেবে না।বড় একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে দেবে তারপর।বোর্ডিং হলে ভাল হয়।মানুষের মত মানুষ করবে তাকে।রূপকথাকে অসংখ্য বার বলেছে পরিকল্পনাগুলো।সবেতেই সায় ছিল ওর।কেবল বোর্ডিং-এর ব্যাপারে আপত্তি ছিল।সিগারেটটা ফেলে পা দিয়ে পিষে নেভাল অমিত।এসব কথা আর ভেবে কি লাভ? কাকিমা যা বলছে তাতে সন্তানের অভাব মিটবে বটে।কিন্তু রূপকথার অভাব?কেউ কোনদিন মেটাতে পারবে না।
              দিন দশেক এক অদ্ভুত নেশা হয়েছে অমিতের।নেট সার্ফ করতে করতে একদিন টেস্ট টিউব বেবি নিয়ে একটা আর্টিক্যাল চোখে পড়ে।তারপর থেকে এই ব্যাপারটা নিয়ে বিশদে পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে অমিত।আইভিএফ,টেস্টটিউব বেবি,সারগেট মাদার-সবকিছু এখন অমিতের নখদর্পণে।নেটে সেখানে পড়ে মন না ভরলে পত্রিকা কিনে মায় মেডিক্যাল জার্নাল-তন্নতন্ন করে সব পড়ে ফেলে আজকাল।রূপকথার ইউটেরাস আছে।সারগেট মাদার লাগবে না।ওর ওভ্যুলেশন হয়।ফলে ডিম্বাণু দাত্রীর দরকার নেই।এখন দরকার কেবল ডিম্বাণু সংগ্রহ করে তাকে শরীরের বাইরে একে অমিতের স্পার্ম দিয়ে ফার্টিলাইজ করার।একে আইভিএফ বলে।খরচ অনেক।কিন্তু অমিত জোগাড় করতে পারবে।ধারদেনা করে হলেও জোগাড় করবে অমিত।গত রবিবার এই সরল সত্যিটা বুঝেছে।মা হতে পারবে রূপকথা।অমিত বাবা হতে পারবে।ছুটির দিন বদ্ধঘরে একা একা দমবন্ধ হয়ে আসত।অফিস থাকে না বলে ভীষন বোর লাগত।এখন পড়াশুনা করে কৃত্রিম প্রজনন নিয়ে তাই একঘেয়েমি কিছুটা হলেও কেটেছে।রবিবার বসে বসে জার্নাল ঘাঁটছিল।আর ঘাঁটতে গিয়েই এই রবিবার আচমকা সত্যির দরজা খুলে গেছে।অকস্মাৎ এই রিয়ালাইজেশনে আনন্দে ভেসে গিয়েছিল অমিত।খুশিতে পাগল পাগল লাগছিল নিজেকে।কিন্তু সে আনন্দ নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী।রূপকথাকে আবার ডেকে নেবার কথা মাথায় আসতেই একটা গলার শীতল নিষ্ঠুরতার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।শিরদাঁড়া দিয়ে হিম স্রোত বয়ে গিয়েছিল যেন।গলাটা সেঁজুতির।এমনিতেই অমিতের প্রত্যাখ্যানে ক্ষুব্ধ হয়েছিল সেঁজুতি।ওকে দেখতে এসে বোনকে বিয়ে করে ফেলা অমিতের সাথে শীতল দূরত্ব বজায় রাখত।বছর খানেক আগে এক প্রফেসারের সাথে বিয়ে হয়েছে সেঁজুতির।অমিতের থেকেও ভাল পদমর্যাদার বর পেয়ে বিয়ের পর কিছুটা হলেও সহজ হতে পেরেছিল।কিন্তু যেচে ফোনটোন করত না কখনো।একবার-ই করেছিল।রূপকথা যেদিন বাপের বাড়ি ফিরে গিয়েছিল তার পরের দিন-ই রূপকথার মা-বাবা এসে অমিতের কাছে ক্ষমা চান।রূপকথার বাবা হাতে পড়েছিলেন।পায়ে পড়তে বাকি ছিল শুধু।তাদের কাকুতিমিনতিকে নাটক বলে অভিহিত করেছিল অমিত।ক্ষমা তো দূরের কথা-নির্মম অপমানের সাথে ওনাদের প্রত্যাখান করেছিল ।কঠিন মন নিয়ে ততোধিক কঠিন গলায় ওনাদের প্রতারক বলে প্রতারণার শাস্তির নিদান দিয়েছিল।ওনাদের চোখের জল পড়ায় মনের মধ্যে এক অদ্ভুত তৃপ্তির স্বাদ পেয়েছিল সেদিন।যুদ্ধজয়ী মনে হয়েছিল নিজেকে।জয়ের আনন্দ বেশিক্ষণ টেকেনি।তারা বাড়ি ফিরে যাবার পর-ই সেঁজুতির কলটা আসে।সেঁজুতি ফোনের ওপার থেকে অমিতকেই প্রতারক প্রমাণ করে ছেড়েছিল।উত্তর দিতে পারেনি অমিত।ঝগড়া করতে পারেনি।রূপকথাকে ভালোবাসাটা যে অমিতের অভিনয়মাত্র এমন গুরুতর অভিযোগ অবধি মাথা পেতে নিয়েছিল।অভিযোগটা অসত্য জেনেও নির্বিবাদে শুনে গিয়েছিল,"রূপকথাকে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া কিছু ভাবেননি আপনি।সেই ক্ষমতা যখন নেই প্রমানিত হল তখন ওর শরীরের অকেজো কলকব্জার মত ঠাই হল আবর্জনার স্তুপে।এর থেকে বেশি সম্মান আপনার কাছ থেকে আশা করাই তো অন্যায় অমিতবাবু।বরাবর আপনি শরীর দেখেছেন।মনটার কোন দাম আপনার কাছে নেই সেটা প্রথম থেকেই আমাদের বোঝা উচিৎ ছিল।রূপের জন্য কদর ছিল বোনের।রূপসী বৌ লোক দেখিয়ে পুরনো হয়ে গেছে এখন।তাই বাচ্চার জন্ম না দিলে সে বাতিল।এত যে ভালোবাসার দাবী করেছেন এতদিন ধরে তা ছেঁড়া কাগজের মতই মূল্যহীন।শুনে রাখুন রূপকথাকে আপনি প্রত্যাখ্যান করেননি।আপনার ক্ষুদ্রতা আপনাকে সে অধিকার দেয়না।রূপকথা প্রত্যাখ্যান করেছে আপনাকে।আপনার অসততাকে,আপনার নীচতাকে।একদিন না একদিন রূপকথার অভাব বুঝবেন আপনি।সেদিন হাজার চাইলেও ওকে পাবেননা।“কথাগুলি কানে বাজতেই অমিতের সব উৎসাহে কে যেন জল ঢেলে দিয়েছিল।সেদিন এত হঠকারী কেন হয়েছিল ও? একটু ধৈর্য ধরলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।রাগ না দেখিয়ে যদি কলকাতায় নিয়ে যেত একবার বড় ডাক্তারের কাছে তাহলেই…আর ভাবতে পারে না অমিত।কেমন সব জট পাকিয়ে যায়।কি বলে এখন ও ডাকবে রূপকথাকে?"রূপ আমি জানতে পেরেছি তোমার সন্তানধারণের সম্ভবনা আছে।তুমি ফিরে এস।আমি তোমার সন্তানের পিতা হতে চাই।তোমার মূল্য আমি এই সত্যিটা জানার পর নতুন করে বুঝতে পেরেছি…” না,না।এইকথা বলে অমিত নিজেকে আর কত ছোট করবে?তার থেকে থাক।
             বাড়ি পৌঁছে জামাকাপড় বদলে সবে টিভি চালাতে যাচ্ছিল অমিত।হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল।এত রাতে আবার কার কল?অচেনা নাম্বার!"হ্যালো।"বিরক্তির সুরেই বলল অমিত।“ এখন বাড়ি ফিরলে?”স্বাভাবিক সুরে ফোনের ওপার থেকে যে কন্ঠ বলে উঠল সে আর কেউ নয়-রূপকথা।অমিত এত অবাক হল যে প্রশ্ন করতেও ভুলে গেল ও এখন বাড়ি ফিরল সেটা রূপকথা জানল কী করে?"তুমি!” "গলা চিনতে পেরেছ তাহলে।" “কল করলে কেন?” “ দরকার ছিল।তোমার একটা সই দরকার।"ডিভোর্স চাইছে রূপকথা।অমিতের গলা শুকিয়ে আসছিল।সই কেন চাই প্রশ্ন করার বদলে বলে ফেলল,"নিজের রাস্তা দেখে নিচ্ছ তাহলে?” রূপকথা হাসল।“বলতে পারো।"মানে!বিয়ে করছে নাকি রূপকথা!বিয়ের আগে অমিত কানাঘুষো শুনেছিল রূপকথাকে নিয়ে।ছোট মফঃস্বল শহর।তার একমাত্র কলেজের সেরা সুন্দরী মেয়েটিকে নিয়ে গুজব থাকবেও।রটেছিল ক্লাসের-ই এক ছেলের সাথে প্রেম ছিল রূপকথার।সে বেকার ছিল।পড়ুয়া ছিল।মাঝখান থেকে অমিত এসে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায় রূপকথাকে মোটা মাইনের জোরে।বিয়ের আগে রটনাটা শুনলেও কান দেয়নি অমিত।কান দিলে রূপকথাকে পাওয়া হত না।বিয়ের পরে কথাগুলো রূপকথাকে জিঞ্জাসা করেনি কখনো।অতীত ঘেঁটে লাভ নেই।রূপকথার প্রাথমিক অস্বাচ্ছন্দ্যকেও পাত্তা দেয়নি অমিত।নিজের ভালোবাসার উপর আস্থা রেখেছিল।অভিষেক নাম ছিল ছেলেটার।সেঁজুতি একদিন মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিল।সে নিশ্চয় এতদিনে ভাল চাকরি পেয়ে গেছে।অমিতের বুকের মধ্যে উথালপাথাল  করতে থাকল। “চুপ করে গেলে যে?শুনলাম পাত্রী খুঁজছ?”সম্বিৎ ফিরল অমিতের।“কাকিমা খুঁজছে।" "তুমি সম্মতি না দিলে…যাক বাদ দাও।সইটা দিয়ে দিও।এটুকুই শেষ চাওয়া তোমার কাছে।" “মুক্তি চাইছ?”অমিত ব্যাঙ্গ করল।“সে তো কবেই পেয়ে গেছি।এখন বাঁচতে চাই।" "উদ্দেশ্য পেয়ে গেছ তো?”রূপকথা হাসল,"আমার মধ্যেকার সম্ভবনার কথা সম্প্রতি জানতে পেরেছি।"মানে!!রূপকথা জেনে গেছে কৃত্রিম উপায়ে ও মা হতে পারে?কে জানাল ওকে? সেঁজুতি-ই সম্ভবত খোঁজখবর করেছে অথবা গাইনি দেখিয়েছে কলকাতায়।নাকি অভিষেক?তা-ই হবে। অমিতের নিজেকে লাথি মারতে ইচ্ছা করছিল।ওর পরিকল্পনাটা চুরি করে অভিষেক রূপকথাকে কেড়ে নেবে।রূপকথার সন্তানের পিতা হবার অধিকার জিতে নেবে।আগেরবার দড়ি টানাটানিতে অমিত জিতেছিল আর এবার জিতবে অভিষেক।“সইটা কবে চাই বল?”ঘেন্না ধরে গিয়েছিল অমিতের।তলেতলে তাহলে ভালই যোগাযোগ ছিল নাগরের সাথে।ফেসবুকেই হবে হয়ত।“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।কাল হলে কাল-ই।” "আর তর সইছে না,তাই না?”আঘাত হানল অমিত।“সত্যি-ই তাই।"নির্লজ্জ স্বীকারোক্তিতে অমিতকে চমকে দিয়ে বলল রূপকথা।“কাল কখন?” “বেলা দশটা নাগাদ।" "কোর্টে?” “ হুম।" “বেশি হ্যাপা নেই তো?” "না,না।মাত্র দশ মিনিটের ব্যাপার।চলে এস।রাখছি তাহলে।"ফোন রেখে দিল রূপকথা।
                    রূপকথাকে নিজের করে রাখতে পারল না অমিত।মুঠো বন্ধ করে চেষ্টা করে দেখতে পারত।কিন্তু তার আগেই পাখি উড়ে গেল।সব মিথ্যা।সব অভিনয় ছিল।রূপকথা জীবনেও ভালোবাসেনি অমিতকে।এতদিন বৃথা কষ্ট পেয়েছে অমিত।কালকের দিনটা গেলে বাঁচা যায়।রূপকথাকে চিরদিনের মত ভুলে যাবে অমিত।রূপকথা ভেবে ভুলে যাবে।নতুন করে জীবন শুরু করবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।রূপকথাকে জিততে দেবে না ও।কোনমতেই না।
                    ভরা বর্ষাকাল।দশটার মধ্যেই আদালত চত্বরে পৌঁছে গিয়েছিল অমিত।বৃষ্টি ভালোমতোই পড়ছিল।রূপকথা খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছিল।দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিল অমিত।অনেক কষ্টে চোখ ফিরিয়েছে।হাল্কা হলুদ রঙা শিফন শাড়িতে কি অসম্ভব সুন্দর-ই না লাগছিল ওকে।“এসে গেছ?” "আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলে বুঝি?” "তুমি কি ভাবলে অন্য কারোর জন্য?” "নাহ।আজকে আমাকেই বেশি দরকার তোমার।ভেতরে চল।বৃষ্টিতে ভেজার মত শরীরের জোর বা মনের অবস্থা কোনটাই নেই আমার।” "সেই ভাল।"
                     ভেত্ররে ঢুকে সেঁজুতিকে দেখে অবাক হয়ে গেল অমিত।রূপকথার দিকে তাকাল,"তুমি বলোনি তো?”" কি বলব?” "সেঁজুতির বাচ্চা হয়েছে।কবে হল?” রূপকথা হাসল,"দেখে কবে মনে হচ্ছে?” "দেখে তো দিন সাতেকের বেশি বয়স মনে হচ্ছে না বাচ্চাটার।কি দরকার ছিল ওকে এখন এখানে আনার?সেঁজুতির নিজের চোখে না দেখে শান্তি হচ্ছিল না বুঝি?” চাপা গলায় বলল অমিত।রূপকথা গায়ে মাখল না।“বাচ্চাটাকে দেখবে না ভালো করে?”এমন প্রস্তাবে অমিত অবাক হলেও বাচ্চাটাকে দেখতে মানা করতে পারল না,"যতক্ষণ দেখার অধিকার আছে দেখে নিই।" সেঁজুতির দিকে এগিয়ে গেল অমিত।“কবে হল?” "আজ পাঁচদিন।” "দেখতে তো বেশ হয়েছে।"সেঁজুতি হাসল।“গায়ের রংটা রূপকথার মতই না একদম?” এই কথাটা অমিতের মনেও এসেছিল।এত সুন্দর বাচ্চা রূপের কোলেই মানাত।“দীপদা খুশি?” "খুশি হবে না? আপনি খুশি তো?”অমিত বলতে যাচ্ছিল আমার খুশিতে কি এসে যায়?বাচ্চাটার সুন্দর মুখটার দিকে চেয়ে বলতে পারল না।“কোলে নেবেন না?” এমন কথায় অমিত চমকে গেলেও মুখে কিছু বলল না।হাত বাড়াল। কোলে নিল।নিজের অজান্তেই কখন চোখে জল চলে এসেছে টেরও পেলনা।অন্যের প্রাপ্তি নিজের অপ্রাপ্তির কষ্টকে বাড়িয়ে দিয়ে যায়।ছেলেবেলায় বন্ধুদের সবাইকে মা-বাবার সাথে দেখেও এমনি জল আসত দুইচোখে।যদি সত্যিসত্যি-ই এটা রূপকথা আর অমিতের সন্তান হত অমিতের মত সুখী আর কেউ হত না।“কি দেখছ এত?” "কিছু না। ছেলেটা খুব সুন্দর হয়েছে, না?” রূপকথা অমিতের হাত থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে নিল,"পছন্দ হয়েছে তাহলে।আমি ভাবলাম মেয়ে হলে খুশি হতে।যা মেয়ের ঝোঁক তোমার।"অমিত ম্লান হাসল।মেয়ে না হলেও ফুটফুটে একটা ছেলেও কম কি? "এত সুন্দর ছেলে কার না পছন্দ হবে?” "কার ছেলে দেখতে হবে না? সুন্দর না হয়ে যায়?”রূপকথার দিকে অবাক হয়ে তাকাল অমিত,"কার ছেলে?” “কার আবার?আমার।" "তোমার দিদি দিয়ে দিল বুঝি?” "দিদি দেবার কে? এটা তো আমার ছেলে।" সহজভাবেই বলল রূপকথা।তামাশা করছে হয়ত।কিন্তু এই তামাশাটা ভাললাগছে না অমিতের।“ কি যা তা বলছ?” "যা তা? তোমার কাছে যা তা হতে পারে কিন্তু আমার কাছে এটাই সত্যি।" রূপকথা অমিতের দিকে সোজাসুজি তাকাল এবার,” ফেসবুক হোয়াটসআপ ছেড়ে দিয়েছ দেখতে পাই।কিন্তু টিভি দেখ না খবরের কাগজ পড় না জানতাম না।" “ স্পষ্ট করে বল।" ধৈর্য ভাঙ্গছিল অমিতের।“ ছেলেটাকে আমি চারদিন আগে কুড়িয়ে পেয়েছি অমিত।" “কি!!”  " ঠিকই শুনছ।আমাদের বাড়ির পিছনের বাগানে কে বা কারা ফেলে গিয়েছিল।সে নিয়ে চারিদিকে হুলুস্থুল।মিডিয়া কাগজের লোকজন এসেছিল।ওকে দেখতে ভিড়ভাট্টা জমেছিল।শেষে পুলিশ এসেছিল ওকে হোমে নিয়ে যাবে বলে।কিন্তু ও তো আমার কাছে থাকার জন্য এসেছে অমিত,হোমে যাবার জন্য নয়। ওর মুখটা যখনি দেখেছি তখনি জেনেছি ও শুধু আমার।আর কারোর নয়।আমার জন্যই ভগবান ওকে পাঠিয়েছিল।একটা দিন সকাল থেকে রাত অবধি ছিল আমার কাছে,কিন্তু সেই একদিনেই বিশ্বাস কর এত মায়া পড়ে গেছে…নিজে তো আর মা হতে পারব না।আর যদি হতেও পারতাম ওকে ফেলতে পারতাম না।আমি-ই যে ওর মা।" রূপকথার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছিল।নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছল ও,"তোমাকে কোন দোষ দিইনা আমি।আমার দুর্ভাগ্য আমি আগে জানলে বিয়ে করতাম না তোমায়।একটা উপকার চাইব শুধু।জীবনে শেষবারের মত।ওকে দত্তক নেবার আবেদন করেছি।কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর সম্মতি ছাড়া দত্তক দেবেন না বিবাহিতা মহিলাকে।যদি তুমি একটা সই করে দাও…” "রূপ!” “দেবে না? আর কিছু চাই না যে। ডিভোর্সের কাগজে যেদিন বলবে সই করে দেব।তোমারও বাঁচার জন্য কাউকে দরকার।নিজের সন্তানের জন্য আকাঙ্ক্ষা অযৌক্তিক নয়। আমার সবটুকু খুশি আমি পেয়ে গেছি।শুধু একটা সই।" কি জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছিল না অমিত।অবশেষে বলে ফেলল,”একা একা ওকে মানুষ করবে কী করে?”
                   রূপকথা হাসল, "সে ঠিক পেরে যাব।তোমার কাছ থেকে কোনোদিন কিছু দাবী করব না। খোরপোষও  চাইনা আমার।কথা দিচ্ছি ছেলে বড় হয়েও তোমার কাছ থেকে কিছু দাবী করবে না।ও শুধু ওর বাবার নাম হিসাবে যদি তোমার নাম ব্যবহার করে…তোমাকে চেনাব না ওকে।বলব ওর বাবা নেই।“ অনর্গল কথা বলে চলেছিল রূপকথা।অমিত ঠোঁটে তর্জনী রেখে চুপ করতে বলল,"কি বলবে?ওর বাবা মারা গেছে?নাকি ওকে আর ওর মাকে ফেলে চলে গেছে?সবদিক দিয়েই তো আমার বিপদ রূপ।" “ নামটা দেবে না তাহলে?” আকুল চোখে তাকিয়ে বলল রূপকথা।“ তাই কি বলেছি একবারও?” " কি বলছ কি তুমি? প্লিজ স্পষ্ট করে বল।" অবুঝ হল রূপকথা।অমিত বিশ্বাস করতে পারছিল না যাকে দেখছে সে ওর চিরচেনা রূপকথা কিনা।এই ক’দিনে এতটা ভালবেসে ফেলেছে বাচ্চাটাকে যে বিনিময়ে নিশর্তে অমিতকে মুক্তি দিতে পারে নিজেদের ভালোবাসার মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে। রূপকথা সন্তান চেয়েছিল।কিন্তু এতটা গভীরভাবে চেয়েছিল অমিত ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি।নিজের চাওয়াটাকেই বড় করে দেখে অমিত রূপকথার চাওয়ার অসম্মান করেছে।নিজের অক্ষমতার কথা রূপকথা জানত না।সত্যি-ই জানত না।আজ এব্যাপারে নিশ্চিত অমিত।এক-ই ঘটনা যদি অমিতের সাথে ঘটত তাহলে রূপকথা কি এভাবে ওকে ত্যাগ করত?কি বলবে এখন রূপকথাকে ও? "কি হল? ম্যাজিস্ট্রেট ডাকছেন যে। যাবে না?” "ওঃ। চলো।"
                  সুখী দম্পতির অভিনয় করে সম্মতিপত্রে সই করে ম্যাজিস্ট্রেটের ঘর থেকে বেরিয়ে এল দুজনে।“ আজ তোমার অফিস কামাই হল।" অমিত হাসল,"অনেক ছুটি পাওনা ছিল। অসুবিধা হবে না।" ‘ফিরতে এত রাত কর কেন এখন?” "কি করব তাড়াতাড়ি ফিরে?” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল অমিত।“অনিয়ম করবে তা বলে?ভাল থাকার চেষ্টা করতে হবে যে।পাত্রী খুঁজে পেলে জানিও। একটা সই ধার নিয়েছি।শোধ দিয়ে দেব।”  "চলে যাচ্ছ ?”  “ যাই। দিদি ছেলেকে নিয়ে রিকশায় উঠে পড়েছে।" “ একটা কথা বলার ছিল।" “ কি?” “ কদিন আগে জেনেছি যে তুমি মা হতে পারবে।" রূপকথা ভারি অবাক হল,"কি করে?”  "আইভিএফ।মানে টেস্টটিউব বেবি আর কি।অনেক টাকা লাগবে। তবে…” “ আর ওসব ভেবে কি লাভ? আমার কথা এখনো ভাব তুমি?” “ তোমার কি মনে হয় ভাবি না?” রূপকথার চোখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল অমিত।চোখ নামাল রূপকথা।অমিত হাসল,"তবে ঠিক-ই বলেছ। এখন আর ওসব ভেবে লাভ নেই। মা তো তুমি হয়েই গেছ।" রূপকথার মুখে হাসি ফুটল।বড্ড সরল আর পবিত্র সে হাসি।“ ওকে তোমার নাম দেবে তো অমিত?” “ উঁহু।" রূপকথার মুখে আবার কালো মেঘ ছেয়ে গেল,"থাক তাহলে।আসছি।" “ শুধু নাম কেন রূপ? ওর বাবা হিসাবে আমাকে নেবে না?” বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে উঠল রূপকথা।“ আমি তো সবসময় একটা জিনিস-ই চেয়েছি।তোমার সন্তানের বাবা হতে।আজ তুমি মা হলে।সত্যিকারের মা।আর আমার বেলায় শুধু খাতায়কলমে?এটা ঠিক না।“ অমিত সুন্দর করে হাসল এবার।“ কিন্তু তোমার…” “ কোন কিন্তু নয়। তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না আমি।এই কথাটা তোমাকে হাজারবার বলতে চেয়েছি।কিন্তু পারিনি এতদিন।আজ আমার ছেলেটা এসে কথাটা বলার সুযোগ করে দিল।" “তোমার?”  "একদম। যা কিছু তোমার আমার নয় কি?এবার তো ক্ষমা করবে আমায়?” “ক্ষমা?” “জানি করবে।আমি মন থেকে অনুতপ্ত আমার ব্যবহারের জন্য।হঠকারিতার জন্য।কিন্তু আমার ভালোবাসাটা নিখাদ। তোমাকে ছাড়া কাউকে ভালবাসতে পারব না।" কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রূপকথা বলল,"বাড়িটা কবে কিনছ?”অকস্মাৎ এই প্রশ্নে অবাক হল অমিত,"মানে?” “ তোমার ছেলেকে ভাড়ার ফ্ল্যাটে রাখবে না বলেছিলে ভুলে গেছ? কিন্তু বোর্ডিং-এ আমি কিছুতেই দেব না।" রূপকথাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল অমিত। সেঁজুতি রিকশাওয়ালাকে হেসে বলল,"দাদা-আর একটা রিকশা হবে।"

SHARE THIS

Author: