ট্রেন এখনো দেয় নি বলে স্টেশনটা বেশ ফাঁকা। শিয়ালদার নয় নম্বর প্ল্যাটফর্ম। এক ঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেল শ্রীপর্ণা। মাসে একবার এই জার্নিটার জন্য মনটা মুখিয়ে থাকে। সরকারী চাকরী করে যে সময়টা বাঁচে, তাতে থিয়েটারের শখটা এক ঝলক টাটকা বাতাসের মত। মেক-আপ করে স্টেজে উঠে সবটুকু দিয়ে অভিনয় করার পরও ডিরেক্টর মানসদার বকুনি না খেলে জীবনটাই কেমন বৃথা মনে হয়। মানসদা চশমা খুলে চরম কৃত্রিম হতাশা নিয়ে বলে, "তুই এবার রিটায়ার করে বৃদ্ধাশ্রমে যা বরং।" শ্রীপর্ণা হেসে বলে, "মানসদা, আমি তো সবে বেয়াল্লিশ!" এরকম ঝগড়া চলতেই থাকে তাদের পনেরো জনের ছোট্ট প্রাণচঞ্চল সংসারটায়। এদিক সেদিক ঘুরে, শখের থিয়েটার করে জীবন উপভোগ করে শ্রীপর্ণা। বিয়ে করার কথা তাই কখনো মাথাতেই আসে নি।
সবে সাড়ে ছটা। সন্ধ্যে নেমেছে শিয়ালদার উড়ালপুলে। ম্যাগাজিনের দোকনটার পাশের চায়ের স্টলটার ঠিক পাশের বেঞ্চটায় একটা মেয়ে বসে আছে একটা ব্যাকপ্যাক নিয়ে। তার পাশটাতে গুছিয়ে বসল শ্রীপর্ণা। এখন লোকজন বেশী নেই আশেপাশে। চায়ের কাপটায় চুমুক দিয়ে আড়চোখে মেয়েটাকে দেখে নিলো। কত আর হবে? বড়জোর সতেরো-আঠারো। টানা টানা ভাসা চোখ, বেশী হাইট বলে মনে হচ্ছে না। একটা জিনস আর লাল টপ পরনে। বারবার ঘড়ি দেখছে হাত উল্টে। কারো অপেক্ষা করছে বোধহয়।
বাসে আসার সময় গ্যাংটকে গণ্ডগোল পড়তে পড়তে এসেছে শ্রীপর্ণা। আচ্ছা, ফেলুদা বা শার্লক হোমস এরা তো কেমন লোককে দেখে কত কি বলে দেয়! একবার ট্রাই নেবে নাকি এই কেসটা? শ্রীপর্ণা নিজের কাঁচা পাকা চুলে একবার হাত বুলিয়ে হাসিটাকে কন্ট্রোল করে। সাধে কি আর মানসদা ভুশুণ্ডি বলে ডাকে!
যাই হোক্, চটি থেকে শুরু করল শ্রীপর্ণা। সে নিজে পড়ে আছে ক্যাম্বিসের জুতো। ট্রেনে সুবিধা খোলা পরার, তাছাড়াও চুরি হবার ভয় কম রাতে। মেয়েটি কিন্তু বেশ একটা স্টাইলের হাই হিল জুতো পড়ে আছে। তাও নতুন বলেই মনে হচ্ছে। জুতোর স্টাইল বলে দিচ্ছে, সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে নয় এ। হেলান দেওয়ার ছলে পিছনে একটু বেশী করে হেলে জিনসের লোগো বোঝার চেষ্টা করল শ্রীপর্ণা। নাহ, দেখা যাচ্ছে না। টপটা দেখে অবশ্য বেশ বোঝা যাচ্ছে - দামী। ঘড়িটা সোনালী ব্যান্ডের, টাইটান। চুল চকচকে, স্ট্রেইট। অর্থাৎ অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে।
নিজের চিন্তাশক্তিতে বেশ খুশী হয়ে উঠল শ্রীপর্ণা। মেয়েটা আবার ঘড়ি দেখল। এবার ট্রেন দিয়ে দেবে। স্টেশনে বেশ ভিড় হয়ে গেছে। মেয়েটা অনেকটা দূরের বাইরে বেরনোর গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতের টিকিটটা গোল করে পাকিয়েছে উত্তেজনায়। এবার আবার একবার সোজা করল যখন, শ্রীপর্ণা বেশ পরিষ্কার দেখতে পেল, টিকিট একটা নয়, দুটো।
ওহ! এটা বাড়ি থেকে পালানো কেস শিওর! নাহলে এত ছটফট করবে কেন! আজকালকার ছেলেমেয়েগুলোর এই এক রোগ! মতের মিল নাহলেই কেমন অনায়াসে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। এ সতেরো, আর সে ছেলে না জানি কত! আহাম্মকের দল! বাবা-মার কথা একবার ভাবে না!
একটা দুষ্টবুদ্ধি চাড়া দিয়ে উঠল শ্রীপর্ণার। এই সুযোগে অভিনয়টাও ঝালিয়ে নেওয়া যাবে। "আহ" করে একটা হালকা চাপা আর্তনাদ করে পেটটা চেপে ধরল সে। সামনে, প্ল্যাটফর্মের ধার ঘেঁষে দাঁড়ানো চারটে ছেলে একবার দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। বাঁচল শ্রীপর্ণা। মেয়েটা এই প্রথমবার পুরোপুরি ঘুরে দেখল ওকে। "আর ইউ ওকে আন্টি?"
ওমা! কি মিষ্টি অথচ শার্প গলা। পরের নাটকটায় এরকম একটা গলার মেয়েকে নায়িকা খুঁজছে মানসদা। কারণ মেয়েটা হবে একজন স্ট্রাগলিং সিঙ্গার।
"ওই আর কি! এই অবস্থায় এরকম যখন তখন ব্যথা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক, মা!" সামনে প্ল্যাটফর্মে রাখা মুটের মস্ত ঝাঁকার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলল শ্রীপর্ণা, ক্লিষ্ট মুখ করে।
"ওহ! সো সরি আন্টি। কিন্তু এই অবস্থায় আপনি নাইট জার্নি করতে পারবেন?" মেয়েটাকে উদ্বিগ্ন দেখালো। শ্রীপর্ণা অভিনয় সত্ত্বেও বুকের কাছে একটা অন্য সুখ বেশ অনুভব করতে পারল।
"মেয়েটা তো মানুষ হল না। কে আর দেখবে বলো মা! তাই এই অবস্থাতেও কাজের জন্য জলপাইগুড়ি কোলকাতা করতে হয়।"
"মেয়ের কি হয়েছে আন্টি?"
এই মেয়ের পালানো আটকাতে হলে বিশেষ কিছু একটা নাটক তো করতেই হবে। শ্রীপর্ণা এক মুহূর্ত ভেবে নিলো। এর মধ্যে মেয়েটা আর একবার ঘড়ি দেখে, ঘাড় ঘুরিয়ে গেটের দিকটা দেখে নিয়েছে।
"একমাত্র মেয়ে ছিল গো। কত আদরে মানুষ করলাম ওর বাবা মারা যাবার পরেও। উচ্চমাধ্যমিক দিয়েই সে উড়ে গেল অন্য কারো সাথে। পাঁচ বছর হয়ে গেছে। একদিনও এসে খোঁজ নেয় নি, বাঁচলাম কি মরলাম। মরণরোগে ধরেছে সেও জেনেই গেছে। তবুও দেখতে আসে না কি করে চলে আমার।" হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখটা মুছতে মুছতে মেয়েটার ভাবান্তর লক্ষ্য করল শ্রীপর্ণা। তাই আরো বলতে লাগল।
"মা বাবা কত কষ্ট করে ছেলেমেয়ে মানুষ করে, তাই না মা? ছেড়ে চলে যায় কি করে এভাবে একা ফেলে? শেষ সময়ে একা একা মরার জন্য? এক গ্লাস জল দেবারও কেউ নেই রে মা আমার।"
মেয়েটার চোখ টলটল করছে। কাজ হচ্ছে তার মানে। অথচ মানসদা হলে নির্ঘাত তেড়ে আসত, "অভিনয় কর, ভুশুণ্ডি, অতি অভিনয় নয়!" এদিকে ট্রেন ঢুকছে। লম্বা প্ল্যাটফর্মের শেষ থেকে জোরালো একটা লাইট আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে।
শ্রীপর্ণা একটু মরিয়া হয়ে পেটটা চেপে আর একবার ককিয়ে উঠল।
"একটু জল খাবেন আন্টি?" মেয়েটা ব্যাকপ্যাক হাতড়াতে যাবে, সেইসময় একজন ইয়া মোটা মহিলা হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে একটা ঢাউস ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সামনে এসে হিমালয়ের মতো দাঁড়ালেন।
"আমি এদিকে খুঁজে মরছি! ফোন কোথায় তোর?"
মেয়েটা চোখ তুলে দেখেই খুব খুশী হয়ে গেল নিমেষে। "এই তো মা এসে গেছে!"
মা! কাহানিমে ট্যুইস্ট! শ্রীপর্ণার একগাল মাছি। হাঁ করে দেখছিল মা আর মেয়েকে, ট্রেনটা সামনে এসে ভস করে একটা আওয়াজ ছাড়ল, মানে শ্রীপর্ণার বকলমে দীর্ঘশ্বাস আর কি!
"এক মিনিট মা, এই আন্টি খুব অসুস্থ, ওনাকে একটু জল দিয়ে যাই।"
শ্রীপর্ণা প্রথম হাফেই ছয় গোল খাওয়া গোলকিপারের মতো মুখ করে কোনরকমে বলল, "ইটস ওকে, আছে আমার কাছে। যাও তোমরা। আমিও যাই।"
"টেক কেয়ার আন্টি" বলে মেয়ে মায়ের সাথে চলে গেল টুটায়ারের দিকে। উঠে পড়ার আগে, শ্রীপর্ণা এর ওর পায়ের ফাঁক দিয়ে ঘুরে বেড়ানো নেড়ির ছানাটার দিকে চেয়ে কটমট করে তাকিয়ে বলল, "তোপসে, তুই একটা হোপলেস! এইজন্য বলি পড়াশুনা কর!"