এক
চলে যাওয়া দিনগুলিকে যদি পারতাম বন্দি করে রাখতে তাহলে হয়তো তাই
করতাম।
ফ্রেমে যেমন বন্দি করে রাখা যায় ছবি, ঠিক তেমন করে বেঁধে রাখতাম আমার
হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলো। আজকাল পরিচিত সেই কণ্ঠটা আমাকে বড্ড ডাকে, সেই ডাকার
ধরণটাও আবার বড় অদ্ভুত রকমের। মাঝ রাত্তিরে ঘুমোতে যাই, দুচোখ ছাপিয়ে ঘুমও আসে-মনে
মনে ভাবি এই বুঝি জ্ঞানশূন্য সাগরে ডুবে গেলাম, কিন্তু নাহ্! তা আর হয়না,
চোখের পাতায় ঘোর অমাবস্যার যে আধার- তাতে আচমকা ভেসে উঠে পোড়ামুখীর মুখটা।
হতচ্ছাড়ি জ্বালিয়ে রেখেছে আমায় শেষ প্রদীপের সলতের মতো; যেন আমি টিপ-টিপ করে
জ্বলছি।
জানিনা আর কত রাত এভাবে ঘুম শূন্য করে রাখবে আমাকে ও।
মাঝে মাঝে ওর হাসির শব্দে মনে হয় চারপাশটায় কলরব উঠে যায়। মাঝ রাতের
আঁধারে আমায় ডাকে; আমার চারপাশে পুরনো সেই সুগন্ধি ছড়িয়ে কণ্ঠ খুলে ডাকে;
-কান্ত! এই কান্ত এসো না... অন্ধকার আর আলোর মাঝে স্বপ্ন মিশিয়ে মাঝ
রাত্তিরে কানামাছি খেলি।
‘শুধুই কি কানামাছি আরও কত কি বায়না ধরে যায় ওর কণ্ঠ’ আমি শুধু এড়িয়ে
যাই কিছুতেই আমার কানামাছি খেলা হয় না; তার বদলে আমার ঘুমের সাগর শুকিয়ে কাঠ হয়ে
যায়- বিতৃষ্ণা এসে ঠেকে জিবের ডগায়। মাঝ রাতে বাইরে যে বের হবো সে উপায় টুকু
পর্যন্ত নেই; র্যাকের পাশে পাহারাদার বসে আছে। এই অভাবনীয় ভয়ের রাতে সে আমাকে
সঙ্গ দেয়। এমনটা হতোনা; কিন্তু গত দিনের পর থেকে আর বিপদ কাঁধে নেয়া যায় না সেটুকু
ভেবেই এই ব্যবস্থা।
আমার চিন্তা কিংবা চেতনার মাঝে অশরীরী কারও উপস্থিতিটা এতকাল শুধু
আমিই জানতাম; উপস্থিতিটা আমার চারগণ্ডীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এতকাল কিন্তু সেটা
যখন দেয়াল থেকে বাগান ঘুরে কারো ঘরের আঙ্গিনায় গিয়ে দাড়াতে শিখলো; ঠিক তখনই সবাই
আমাকে ঘিরে চোখ গোল করা দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলো; তার সাথে সাতসতেরো থেকে
সাতপাঁচ বারোর গ্যাঁড়াকলে আমার দৈনন্দিন জীবন ভাজা হতে লাগলো।
এমনও হয় যে আমি খেতে যাবো কিন্তু ঘোর লাগা টোপে বসে রয়েছি চাদের
উপরে; কিংবা আমি ছিটকিনি খুলে হঠাৎ তাকিয়ে আছি বিরান ভূমির দিকে পেছনে জমকালো
অনুষ্ঠান গুলো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে খেয়ে চলে যাচ্ছে। এমনও হয় চোখ আমার দূরবীন হয়ে
আছে ভিড়ের মাঝে হঠাৎ কিছুটা আনমনা হয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যায় সেখানে। এভাবেই ভজঘট হচ্ছিল
আমার; আর এই রকম হলেই চারপাশ থেকে কথা ছুটে আসতো; সবার উৎসুক চোখ বলতো -এই কান্ত
তোর হয়েছেটা কি; বল দেখি?
-কান্ত’র আর কি হবে !! প্রেমে-ট্রেমে পড়েছে বোধহয়;
-তোমাদের যা-কথা; কান্ত পড়বে কারো প্রেমে; ওর মতো এমন রসহীন ঘাস কি
কারো সবুজ বনের অবুঝ সাথী হতে পারে?
এইরকম প্রশ্ন গুলো আমাকে বিদ্ধ করতে করতে শেষে ওদের কথার ফলা একসময়
ভোতা হয়ে গেল তবুও ওরা ক্ষান্ত হয়না; নতুন করে শুরু করে, আমার ভেতরের টিপ টিপ করে
বয়ে চলা বর্ষণটাকে ঝড়ের আকারে ধারণ করাতে চায়-কিন্তু আমি এত সহজে সেই ঝড়কে আহবান
করতে চাইনা। কেন চাইনা? কি জন্য? কোথায় কোন ভুল হয়েছি কি? আমি কারো পাকা ধানে মই
দিতে যাইনি সেটাই কি আমার ভুল হয়েছে? আমি কারো ভালোবাসায়
গিট্টু মেরে দিইনি সেটাই আমার ভুল হয়েছে? নাকি আমি কাউকে অকারণে দুঃখ দিতে পারিনি
সেটাতে আমার ভুল হয়েছে- আমি সম্পূর্ণ মানুষ হয়েও একটু একটু করে ঋজু হয়ে যাচ্ছি আর
বিধাতা পুরুষ সেটা দেখছে; এটাই তার কাছে সঠিক লাগছে নাকি তিনি নিজেও বিব্রত বোধ
করছেন আজকাল আর সে জন্যই বোধহয় হতচ্ছাড়ির আনাগোনা বেড়ে গেছে আজকাল।
বর্ষা শেষের এক রাতে আমি যে কাণ্ডটা করলাম তাতে ওরা শঙ্কিত হয়ে গেলো;
আমাকে কিছুতেই একা থাকতে দেবেনা। আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হলো; তুমি কেন এমন
করছো ? সত্যিই তো আমি কেন এমন করছি অনেকটা সাইকোর মতো! কেন হঠাৎ করেই ঘুমের মধ্যে
পোড়ামুখী -সুশি কে ডেকে চলেছি।
দুই
সে রাতে আমি ঘুমন্ত না জাগ্রত ছিলাম সেটাই ধাতস্থ করতে পারছিলাম না,
আর একপা বাড়ালে হয়তো দেখতে আর হতো না আমাকে; আমি বট তলার শ্মশান ঘাটের যাত্রী হয়ে
যেতাম। নিশুতি রাতে ঘুম সাগরে হতচ্ছাড়ি সুশি এসে আমাকে খুব করে ডেকে হাত ধরে ছাদের
উপরে নিয়ে এসে যে কাণ্ডটা ঘটালো তাতে লোক মুখের রহস্য কাহিনীর চরিত্র হয়ে গেলাম
আমি।
অদৃশ্য সুশি হঠাৎ দৃশ্যমান হয়ে ছাদের উপর দু’হাত তুলে ডেকে বললো
কান্ত ভালবাসা কত লম্বা হতে পারে তা জানো তুমি?
আমার পুরনো ধাঁচের সেই রসহীন উত্তর -জানবো কি করে, কখনো মাপিনি তো!!
ঝাঁঝালো কণ্ঠে সুশি বলে উঠলো, মাপ নি বেশ করেছ; এবার ছাদের উপর থেকে
লাফ দিয়ে নিচে পড়; যত দূরে গিয়ে পড়বে আমি বুঝে নেব ততখানি লম্বা তোমার ভালোবাসা।
কথা শুনে আমি ঝাঁপ দিতে গেলাম; ভালবাসার দূরত্ব দেখাতে...
সেদিন মরেই যেতাম; কিন্তু পেছন থেকে রন্তু এসে ধরে ফেললো আমায়; তাই
বেঁচে গেলাম। দেখাতে পারলাম না আসলে কতখানি ভালবাসতাম সুশি কে।
আজ মাসের পাঁচ তারিখ। শৈবাল আর্ট গ্যালারিতে আমার ছবির প্রদর্শনী
হচ্ছে; পুরো হল রুম জুড়ে মানুষের সমাগম; আমি গ্যালারির একপাশে চুপচাপ দাড়িয়ে;
রন্তু এসে বললো কান্ত দা একজন তোমার ছবি কিনতে এসেছে।
আমি কিছু একটা ভাবছিলাম’ একটু আনমনা ছিলাম তাই নিষেধ করতে ভুলে গেলাম
যে, বলে দাও ছবি বিক্রি হবেনা। নিচে থেকে পুনরায় ডাক আসার আগেই নিচে গেলাম; যিনি
নিতে এসেছেন তাকে তাড়িয়ে দেব এই ভেবেই।
‘জলরঙে আঁকা পেইন্টিংটার নাম “উদোম” যিনি কিনতে এসেছেন তাকে দেখে
কিছুটা অবাক হলাম;কেননা তার বয়স চব্বিশ ছাড়িয়ে যায়নি; মনে হয় নতুন শাড়ি পড়া
শিখেছে; আঁচল টানতে জানেনা। চোখে সোনালী ফ্রেমের চমশা নেই কিন্তু দেখে আন্দাজ করা
গেল চোখে ল্যাসিক করা। আমি কাছে গিয়ে দাড়াতেই পরিচিত একটা সুগন্ধির আভাস পেলাম।
তিনি বিস্ময় মাখা চোখে বললেন আপনিই কি ছবিটা এঁকেছেন ?
আমি বললাম হ্যাঁ। ‘তার চোখ আর ঠোট উল্টানো দেখে বোঝা গেল তিনি
বিশ্বাস করতে পারলেন না;
বললেন -ভেবেছিলাম বয়স্ক গোছের লোক হবে কিন্তু এতো তরুণ ভাবিনি; যাই
হোক কত দাম চাইছেন ?
-সতের হাজার পাঁচশো তের টাকা।
-আমি সতের হাজার টাকা দিচ্ছি;
-না ,হবেনা; টাকা পুরোটাই দিতে হবে।
-কিছু কম রাখুন !!
-আমি পারছিনা।
মেয়েটা কোন দীর্ঘশ্বাস ফেললো না। ব্যাগের ভেতর টাকা খুঁজলো। তারপর
টাকাটা আমার সামনে মেলে ধরে বললো; এই নিন পুরোটাই আছে !!
আমি গুনে দেখলাম আট টাকা বেশি আছে; ফেরত দিতে চাইলাম কিন্তু পকেটে
ভাংতি নেই;
-রেখে দিন পরে নিয়ে নেব;
-পড়ে আমাকে পাবেন কোথায় ?
-পেয়ে যাবো পৃথিবীটা খুব বড় নয়; চোখের আঙ্গিনায় চোখ পড়ে রয়; বাকী
থাকে শুধু মনের ইচ্ছেটা; ইচ্ছেটা যদি থাকে তো পুনরায় দেখা হয়।
আমি বললাম সহজ ভাবে বলুন; কাব্যিকতা পছন্দ করিনা। মেয়েটা হাসলো
অদ্ভুত ওর দাঁতগুলো খুব সাদা।
মেয়েটার চলে যাওয়া দেখলাম;
গ্যালারির বাইরে শত লোকের ভিড়ে নিজেকে ডুবিয়ে দিলাম কিন্তু বার বার
মেয়েটির রেখে যাওয়া কথাটা মুছে দিতে পারলাম না মন থেকে; “পৃথিবীটা খুব বড় নয় চোখের
আঙ্গিনায় চোখ পড়ে রয়; বাকী থাকে শুধু মনের ইচ্ছেটা; ইচ্ছেটা যদি থাকে তো পুনরায়
দেখা হয়”
এই কথাটা আমাকে কেউ একজন এর আগে বলেছিলো;
কে বলেছিল? কেন বলেছিল; মনে করেও করতে পারছিনা।
তিন
ভরদুপুরে ক্যামেরা কাঁধে বাসায় ফিরছি। রাস্তায় হন্যে হয়ে কিছুক্ষণ
হেঁটেছিও একটা অটো কিংবা সি.এন.জি. কোনটাই পাইনি। দুপুর রোদে তৃষ্ণায় বুক জ্বলছে
কি-যে করি; সাউথ হিলসের কাছে আসতেই ফুলের দোকানটার পাশেই একটা সি.এন.জি পেয়ে
গেলাম। কাছে ঘেষতেই ড্রাইভার বলে উঠলো বাবু রিজার্ভ আছে যাওয়া যাবে না। আমি
ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললাম ক’জন নিয়ে যাবেন; ড্রাইভার বলল মানুষ একজন আর কিছু ফুল।
-তাহলে তো যাওয়াই যায়।
-না বাবু উনি আমাকে বলেই নিয়েছেন আগে;
-কোথায় উনি
-ওই তো ভেতরে ফুল কিনছে।
আমি বাইরে দাঁড়ালাম দেখি কে সে; -আর যাওয়া যায় কি না।
এক তোড়া ফুল নিয়ে চোখে পড়ার মতন একটা মেয়ে সি.এন.জি তে উঠে বসলো।
রোদের তাপে মাথা তখন আমার আই-টাই করছে। সাত চৌদ্দ না ভেবে গিয়ে সরাসরি বললাম যদি
কিছু মনে না করেন, আমি কি; সি.এন.জি তে আপনার পাশে কিছুটা সময় যেতে পারি; এ রোদের
দুপুরে সব খা খা করছে বাড়ি যেতে হবে তাড়াতাড়ি। মেয়েটি চোখ কঠিন করে বলল না যেতে
পারেন না; দেখছেন না আমি রিজার্ভ নিয়েছি
‘মুখের উপর না বলাতে আমার একটু খারাপ লাগল’ ঠায় দাড়িয়ে রইলাম।
সি.এন.জি স্টার্ট নিয়ে চলে গেল। কিছু মেয়েরা যে বড্ড বাজে রকমের মেজাজি
হয় সেটা জানা ছিলোনা; আজ জানলাম। রোদ মাখা পথে পা রাখলাম; সকাল থেকে মেঘালয়ের
পাহাড় ধরে দু’টো প্রজেক্টের কাজ শেষ করেছি। আজ বাইকটাও আনিনি সাড়াতে হবে তাই; কে
জানতো ভর দুপুরে এমন হবে।
পকেট থেকে দেশলাইটা হাতে নিলাম, সিগারেট বের করতে যাবো অমনি সি.এন.জি
র আওয়াজ।
আরেকটা সি.এন.জি এলো বোধহয় ;
-এই যে আসুন;
পেছন তাকাতেই দেখি সেই মেয়ে।
কি ভাগ্য আমার !!
সিগারেট পকেটে ফেলেই উঠে গেলাম। আমাকে না নিয়েই চলে গিয়েছিলেন আবার
যে এলেন;
- একটু যেতেই মনে হলো এই দুপুরে আপনার কষ্ট হচ্ছে তাই নিতে এলাম; তবে
কথা বলা চলবে না কিন্তু।
আমি চুপচাপ বসে গেলাম। সি.এন.জি চলছে মাঝারী স্পিডে পাহাড়ি পথে।
মেয়েটার দু’পাশে অনেক ফুল আর ফুলের তোড়া; অনেকটা ফুলের বনে পরি’র মতো লাগছে ওকে।
ভালো করে তাকাতে গিয়ে চোখে চোখ পড়ে গেল মাথা নিচু করে গেলাম।
আমার সিগারেট খাওয়া দরকার কিন্তু মেয়েটি যদি বিরক্তি বোধ করে। এই
জাতীয় মেয়েদের তো সিগারেটের গন্ধে অ্যালার্জি থাকে। বাধ্য হয়ে ড্রাইভারের কাছে
দেশলাই চাইলাম এইবার মেয়েটা মুখ খুললো;
-না জনাব এখন সিগারেট খাওয়া চলবে না; ওটার গন্ধ সহ্য হয় না আমার।
কি আর করা; থাকলাম ভজু হয়ে। কিন্তু সিগারেট যে আমায় খেতেই হবে ও নেশা
বড্ড বাজে। পাহাড় দেখতে দেখতে চোখ সবুজ হয়ে গেছে তবুও ভালোলাগা এখনো ফুরিয়ে যায়নি
তাই একটানা তাকিয়ে ছিলাম সবুজ পাহাড় গুলোর দিকে। আধঘণ্টা কেটে যেতেই আমি লজ্জাকে
চুপসে যাওয়া টিস্যুর মতো রাস্তায় ফেলে দিয়ে সিগারেট জালিয়ে নিলাম।
-আপনি তো বড্ড বাজে লোক, না বলা সত্ত্বেও কাজটা করলেন। আপনি নামুন
তো।
আমি হাসলাম; মেয়েটা ততক্ষণে রেগে গেছে, মুখটা ভবানীর মতো লাগছে।
-এই দুপুরে নেমে গেলে আমি রোদে পোড়া নিগ্রো হয়ে যাবো। মেয়েটা
ভ্রু-কুঁচকালো তারপর বললো; হলে হবেন; আরেকটা নিগার খুঁজে পেতে কষ্ট হবেনা আপনার।
আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল; মুখ ভর্তি ধোয়া ছেড়ে দিলাম। দু’মিনিট আমার দিকে তাকিয়ে
মেয়েটার ভাব বদলালো।
-এবার ফেলুন;
সিগারেট আধ খাওয়ায় হয়নি ততক্ষণে; আমি ছুড়ে ফেলে দিলাম। এবার সব শান্ত
হয়ে এলো।
দু’পাশে পাহাড় ছাড়া আর কিছু নেই। দুরের মাঠে আজকাল রাখালও দেখা যায়
না। গরু আপনা-আপনি চড়ছে। ছেলেরা ঘুরি আর উড়ায় না; এ পথে কোম্পানি বসে গেছে,
পাহাড়ের সাদামাটি কেটে তৈজসপত্র বানায়। আমি সাদামাটির পাহাড়ের দিকে খানিকটা সময়
তাকিয়ে ছিলাম; তাকিয়ে থাকা মনে মাঝে মাঝে কল্পনার এ্যনিমেশন শুরু হয়ে যায়।
আনমনা থেকে সংবিৎ ফিরে পেলাম যখন দেখলাম সি.এন.জি থেমে আছে।
অসহ্য গরম !! কাঠরূপালী রোদ্দুর, রাস্তা আর বনাঞ্চল জুড়ে।
মেয়েটা বসে থেকে ঘেমে গিয়ে নেমে গেল, সাথে পা ফেললাম আমিও।
গ্যাস নেবে বলেই থেমেছে সি.এন.জি।
শাড়ির আঁচল ভাজ করতে করতে মেয়েটা বলল রোদ আজ কড়কড়ে। আমি একটু এগিয়ে
বললাম-তাই তো মনে হচ্ছে
Ñ রোদের ছেলে কে জানেন? কাব্যিক প্রশ্ন!! অমন রাগী মেয়ে আবার কবিতা
জানে নাকি ? - মুখ ঝাঁকিয়ে বললাম জানি না।
Ñ রোদের ছেলে হলো পড়ন্ত বিকেল।
Ñ তাই নাকি !!
Ñ মনে হচ্ছে রোদের মা খেপেছে আজ। শরীর থেকে সব বেরিয়ে যাচ্ছে।
Ñ মেয়েটি এবার আঁচল ছেড়ে দিয়ে হাতের কঙ্কণ ঘুরাতে ঘুরাতে বলল, আপনার
কোনটা ভাল লাগে রোদ না বৃষ্টি। কথাগুলো আমার ঠিক উপচে পড়া লাগছে না, তাই মিথ্যে
করে বললাম আমার রোদ ভাল লাগে।
Ñ মেয়েটি বলল কেন ?
Ñ রোদ না এলে সব কিছুতে গুমোট থেকে যায়। আর আধারটাকে ভালো লাগেনা বলেই
তো রোদটাকে প্রিয় ভাবি।
Ñ ও তাই; কাব্যিক সংলাপ।
Ñ আপনিও কিন্তু কম না; রোদের যে ছেলে আছে সেটা তো জানতাম না। আজ
শুনলাম।
Ñ তাই নাকি; ওই যে দূর পাহাড়ের ঝরনা দেখছেন বলতে পারেন ওই ঝর্ণার
প্রিয় বন্ধু কোনটা ?
Ñ প্রিয় বন্ধু যদি বলতে হয় তাহলে বলতে হবে ¯ স্রোতকে ;
- নাহ্ ঝর্ণার প্রিয় বন্ধু প্রকৃতি। প্রকৃতির কোলে ঝরনার সৌন্দর্যই
সেরা।
Ñ হুম বুঝলাম; আপনি কাব্যিক করে বলেন বলে ভালো লাগলো; নয়তো এগুলো হলো
আঁতলামো। মেয়েটা এবার দাঁত কড়মড় করে বললো তাই! তবে আপনি হলেন একটা ট্যাঁ-ট্যাঁ
টাইপের লোক; এত গুলো কথার মাঝে বানিয়ে একটা মিথ্যেও বললেন আমার সাথে।
আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কিভাবে বুঝলেন যে একটা মিথ্যে ছিল?
মেয়েটি চুপ। একদম চুপ।
আর কোন কথা হলোনা ; সি, এন জি ততক্ষণে স্টার্ট নিয়েছে।
বাড়ি ফিরবার পথে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম এত বড় উপকার করলেন; আপনার নামটা
তো জানা হলোনা।
ও বললো হাজার লোকের ভিড়ে ক’জনকেই আর মনে রাখতে পারি বলুন; তাছাড়া
আমাকে মনে না থাকলে কোন দোষ হবে না তাতে।
দোষ হবেনা জানি কিন্তু উপকারটা ফেরত দিতাম আরকি ?
চার
সুশির সাথে দ্বিতীয় বার দেখার তারিখটা আমি কিছুতেই মনে করতে পারছিনা
তবে এটুকু মনে আছে; গারো বাজারের শিবতলার পথে এক ভিখারির থালায় পয়সা দেব বলে পকেট
হাতড়াচ্ছিলাম; আচমকা ও পেছন থেকে ভিক্ষা থালায় পয়সা দিয়ে বলেছিলো; দরাজ দিলের একটা
ব্যাপার-স্যাপার আছে; দরাজ দিল না হলে ভিক্ষার পয়সাও পকেটে থাকেনা।
রিকসা করে যাচ্ছিল সেদিন; তাই আর ধরতে পারিনি ।
মেয়েটির নাম যে সুস্মিতা বিনতে সুশি সেটা প্রজেক্ট ম্যানেজারের কাছেই
প্রথম জানতে পাই। নীল লেকের ফটোসেশনের মিশনেই তৃতীয়বারের মতো ওর সাথে দেখা হয়
আমার। সেদিন একটা বালুচরি শাড়ী পড়ে এসেছিলো; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আমাকে
চিনতে পেরেও না চেনার ভান করে বাচ্চাদের ডাটা এন্ট্রি লিখছিলো। আমি সামনে গিয়ে
হ্যালো বলার পর ও বললো; আমি কি আপনাকে চিনি ?
আমি হাসি চাপা রাখতে পারছিলাম না; তাই বললাম আপনার নাম তো সুশি; তাই
না। মেয়েটি কপট রাগ দেখিয়ে বলল; হ্যাঁ তো; বলুন এখন আপনার জন্য আমি কি করতে পারি ?
নাকি আপনি আমার ডাটা নিতে এসেছেন ?
কিছু করতে হবেনা আপাতত পরিচিত হতে চাই। সুশি ভেবে নিয়ে বললো আমি আর
আপনি মানুষ এটাই বড় পরিচয়। আমি হেসে বললাম কেন পরিচয় দিতে অসুবিধে আছে ? আবার সেই
চুপ। নিশ্চুপ।
আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম কাজে তাই আর কথা বলা হলোনা সেদিন। নীল লেকের
ফটোসেশনে সুশিরও ছবি তোলা হয়েছিলো। সেই ছবিটা দেখে আমি জলরঙে একটা ছবিও এঁকেছিলাম।
সেদিন দুপুরের পরে সাদা মাটির উপর বসে ডাটা এন্ট্রির টেবিল ছেড়ে সুশি
হাওয়া লাগাচ্ছিল গায়ে। আমি ঠিক তারই পাশে ক্যামেরা রেখে ডাইরি লিখছিলাম। এরই মাঝে
আমার ধোয়া ছাড়বার নেশা পেয়ে বসলো তাই ডাইরি রেখে উঠে গিয়েছিলাম; এসে দেখি ডাইরি নেই;
খোজা-খুঁজি করতে হলো অনেক। কিন্তু পেলাম না। সুশিও নেই যে ওকে
জিজ্ঞেস করবো। শেষে টিম ম্যানেজমেন্ট অফিসার কে জিজ্ঞাসা করলাম সুশি কোথায় ? উনি
ভ্রু-বাঁকা করে বললো সুশি নিচে পানি আনতে গেছে।
বিকেলে ব্যস্ত হয়ে গেলাম আবারো ।
সন্ধ্যের দিকে তখনও আধারটা পুরো আসেনি; তবে আসবে আসবে করছে। সবাই
হিলস ছেড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটছি তখন। পিছনে দেখা গেল সুশিকে; আমি পাশে গিয়ে
বললাম আমার ডাইরিটা দেখেছেন ? ও চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বললো হ্যাঁ।
মনে মনে আমার একটু রাগ উঠে গেল; না বলে কেন এমনটা করলো। আচ্ছা মেয়েতো
ঝাড়ি দিতে হবে। ডাইরি বিষয়টা আমার কাছে অতি গোপনীয় একটা জিনিস। আমি ওর সাইড ছেড়ে
দিয়ে পিছনে দাড়িয়ে গেলাম। ও পিছু ফিরে এসে বললো- বাতাসে ডাইরি পড়ে গিয়েছিলো তাই
আমি নিয়ে গিয়েছিলাম; ভয় নেই পড়িনি। কথাটা যে আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না সেটা
ততক্ষণে আমার চোখ দেখে ও বুঝে গিয়েছিল।
কোম্পানির মিনিবাসে করে সবাই যে যার আস্তানায় ফিরছিলো; গারো বাজারে
নামবার সময় সুশি বলে উঠলো লেখায় এতো বানান ভুল করেন কেন ?
পাঁচ
গারো বাজারের অন্ধ গলির পাশেই একটা বাইজীখানা যে আছে তা আমি জানতাম;
কিন্তু কখনো সেখানে যাইনি। প্রয়োজনও পড়েনি; নীল লেকের প্রজেক্ট শেষ হবার আগের দিন
সুশি আমায় বললো আপনি কখনো নর্তকীর উদোম নৃত্য দেখেছেন ? আমি বললাম না তো;
-তাহলে গনিকাবৃত্তির উপর অমন একটা লেখা কি করে লিখলেন ?
-কোথায় পেলেন লেখাটা !!
-যেখানে ছাপাতে দিয়েছিলেন; সেখানেই।
-আসলে আন্দাজে লিখেছি;
-মিথ্যে বলতে ভয় করে আপনার। আমি জানি পুরুষরা একটু-আধটু ওই রকম যে
হয়;
-অনেক পুরুষ নিয়ে গবেষণা করেছেন মনে হচ্ছে !
-অনেক না হোক আপনাকে নিয়ে কিছুটা করতে গিয়ে বুঝতে পারছি ;
আমি আকাশ থেকে পড়বার ভাব ধরলাম না; কিন্তু চোখ বড় করে বলালাম; হঠাৎ
আমাকে নিয়ে !!
-হ্যাঁ।
-গল্পে তো লিখি বিষ খেয়ে মরে যাচ্ছি; কিন্তু তা লিখতে গিয়ে কি আমাকে
বিষ খেতে হয়;
-বুঝলাম কিন্তু বিষের স্বাদ যে কেমন; সেটা না জানলে কি লিখতে পারতেন
?
-তা পারতাম না; তবে গণিকা বৃত্তির ব্যাপারটা আন্দাজে লোকমুখে শুনে
লিখেছি।
-তাই !!
-হ্যাঁ
আমি নতুন প্রজেক্ট নেবার আগে শিডিউল দেখতে গিয়ে বারবার করে দেখছিলাম;
সুশি কি আমাদের প্রজেক্টে অন্তর্ভুক্ত হয় কিনা। সুশির জন্য কেমন একটা টান যেন আমার
মনে অনুভব করতে পারলাম। সুশি কাজে না এলে আজকাল ছবি তোলার কোন মুডই আমার মাঝে
থাকেনা। আর মুড থাকলেও দেখা যায় অকারণেই এক শট তিন-চারবার করে দেয়া লাগছে।
কদ্দিন নিউমারলজি নিয়ে ঘাটাঘাটি করে দেখলাম আমার লাইফে কি কোন
প্রেম-ট্রেম আছে কিনা। কিন্তু আমি ভালো গণনা করতে পারিনা বলে পুরোটা বুঝে উঠতে
পারিনা। তবে যেটুকু বুঝি আছে কিছু একটা। আমার সর্বশেষ প্রজেক্টের কাজ একটু বেশি
ছিল ছবি প্রিন্ট করাতে ছ’বার সাউথ হিলসে যেতে হলো যে কারণে চেহারা রোদে পুড়ে
তামাটে হয়ে গেল। ছবির কাজ একাই সব করতে হচ্ছিল। সুশিও মাঝে মাঝে আমায়
সময় দিতো; রাস্তায় আসার কিংবা যাবার পথে, কিন্তু কোন পার্ক কিংবা রেস্তোরায় নয়;
আমি কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম সুশি আমাকে একটু একটু করে চিনে নিচ্ছে; কিন্তু সেটা ও
বুঝতে দিতে চায়না।
নতুন প্রজেক্টে সুশি আর আমি দুজনেই থাকলাম কিন্তু প্রজেক্ট একটু
প্রত্যন্ত অঞ্চলে পড়ে গেল। যাবার কিংবা আসবার সমস্যা না থাকলেও ওখান থেকে কাজ শেষ
করে বাড়ি ফিরতে গেলে রাত অর্ধেক হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে তাই কর্তৃপক্ষ ওখানের একটা
গ্রামে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। শুরু হলো আমাদের নতুন প্রজেক্ট।
ছয়
আমি প্রজেক্টের কাজে যতটুকু মনোযোগী হলাম; তারচেয়ে কম মনযোগী হলাম
সুশি’র প্রেমে পড়ার দিকে। কেননা আমি দেখতে চাইছিলাম সুশি কি আমাকে পছন্দ করে কি
না; কি জানি জীবন নাট্যের রাজপুত্রকে আগেই পেয়ে গেছে কিনা কে জানে?
ওর কাজ থাকতো সন্ধ্যের পর তাই সন্ধ্যের পর আমি যখন মুক্ত বিহঙ্গ তখন
ওর কাজে নিজেকে খানিকটা সময় ওর কাছাকাছি রাখতাম।
ও ব্যাঙ্গ করা হাসি হেসে বলতো; থাক আমাকে উপকারের শোধ দিতে হবেনা।
মেঘালয়ের পাহাড় ভেদ করে চাঁদ উঠতো চারপাশে; তার ঘোলাটে আবরণে পুরো
পাহাড় জুড়ে রহস্যময়তা বিরাজ করতো; আমরা সবাই চারপাশে গোল হয়ে আড্ডা দিতাম অনেক রাত
অবধি; এ তল্লাটে আইসক্রিম বা কফি পাওয়া যেত খুব কম; আমার তৃষ্ণার্ত মন তাই মাঝে
মাঝে সুশির খোলা গলায় গাওয়া গানের নদীতে ডুব দিতো;
সুশি ভালো গান গাইতে পারতো; জানিনা কেন যে জীবনের লক্ষ্যে গানটাকে
সঙ্গী না করে এই ঘুরে বেড়ানো আর শিশুদের নিয়ে মহা গ্যাঞ্জাম মূলক কাজের পিছু
ছুটছে। একদিন এই নিয়ে বলেই ফেললাম আপনি এতো ভালো গাইতে পারেন গান-টান গেয়েই তো
জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতেন এখানে শুধু শুধু পড়ে আছেন কেন?
-কেন যে পড়ে আছি সেটা জানিনে। তবে ভাল লাগে এই ছোট ছোট বাচ্চাদের
সাথে থাকতে ওদের মাঝে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে তাই হয়তো। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম এটা
আসলে কথার কথা বলা হলো।
প্রজেক্টের মাঝামাঝি পাতাঝরা দিন যাচ্ছিল তখন; সেই সব দিনগুলিতে
কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভাবনার নদীতে খেয়া বাইতাম; আমি বুঝে উঠতে পারলাম না আসলে আমিই
কি ভালোবেসে ফেললাম সুশিকে না সুশিই ভালোবেসে ফেললো আমাকে।
দিন শেষে, কাজ শেষে হবার পর প্রতিদিন আড্ডা বসতো। সেই প্রতিদিনকার
আড্ডাটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো দিনের পর দিন। তিন মাসের প্রজেক্ট; এর মাঝে কারো বাড়ি
যাওয়া হবেনা। তাই আমররা সবাই সবার মাঝেই ডুবে থাকলাম। মনে হচ্ছিল যেন এটা একটা
পরিবার।
সুশি এসেছে ঢাকা থেকে আমি এসেছি শিলিগুড়ি থেকে; দুজনার দুই দেশ হলেও
কথা আর আচরণে পার্থক্য করা যায়না। আমাদের মধ্যে সেক্রিফাইস আছে সমান-সমান।
আমরা মাঝ রাতে তারা গোনা কিংবা কানামাছি খেলার আয়োজন করাতাম। আমাদের
মাঝে রবীন্দ্র, ভলেটেয়ার কিংবা সত্যজিৎ ও শার্লক-হোমস নিয়ে জোর তর্ক হতো। আমরা
নিজেদের জীবন-যাত্রা নিয়ে মুখে যতই উদাসীনতা দেখাতাম আসলে মনে মনে সবাই তৈরি
হচ্ছিলাম ভবিষ্যতের জন্য।
আমাদের রোজকার খবর; দূর পাহাড়ের গায়ে সকালে বৃষ্টি হবে কিংবা নিচে
পানি নেই; দুপুরে খাওয়া মিলবে না। রাতে শুধু খিচুরি খেতে হবে কিংবা আজ নিচের বাজার
থেকে রান্নার সরঞ্জাম কিনতে হবে, এই সব খবর সুশি প্রতিদিন কাজে যাবার আগে লিখে
আমার দরজার সামনে রেখে যেত।
আমার লাইসেন্স নেই তাই বুঝে শুনে বাইক চালাতে হবে, কিংবা নিচে গারো
পল্লীতে ঢোকা যাবেনা এই জাতীয় কথা নিয়ে রোজ শাসাত আমায়;
টিম লিডার পারুল আপা; কিংবা প্রজেক্ট ম্যানেজার বিভাস বাবু আমার
কাজের প্রশংসা করলে সুশি’র সেটা ভালো লাগতো না ক্ষেপে গিয়ে বলতো ছবি তোলার জন্য
চাই সফট হাত; এই রকম কঠিন হাতে ভালো ছবি হয়না; ছবি তোলার জন্য চাই প্রকৃতির মতো
মন; যেখানে দুঃখরাও করবে স্বপ্ন বুনন। আমি একদিন বললাম তোমার হাত খুব সফট্ তাইনা?
আমরা তখন আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছি ও বলল ছুঁয়েই দেখ না সফট্ কি,না! আমি বললাম
নাহ্ আর একদিন ছোঁব।
আমাদের বেশি কষ্ট হতো নিচে পানি আনতে যেতে;
আমার স্নান করা নিয়ে ওর আপত্তি ছিলো; ঝর্ণার জলে স্নান করলে ঠাণ্ডা
লেগে যাবে; বিভাস বাবু বলতো গেলে যাবে তাতে তোমার কি সুশি ও বলতো আমার কিছু না
হলেও আপনার প্রজেক্ট থেমে থাকবে তো বিভাস বাবু আবার ক্ষেপানোর জন্য বলতো থেমে গেলে
যাক না, আর ভালো লাগেনা কি বল? সুশি বলতো তাই বলেন তো আমি কমিটির কাছে জানাই
আমাদের ভালো লাগছে না এই প্রজেক্ট! এই সব কথা প্রায়ই চলতো।
আমার আপত্তি ছিল ওর চুল বাধায়; খোলা চুলে তোমাকে ভুতনি’র মতো দেখায়;
ও বলতো -দেখালে দেখাক তোমার তাতে কি?
-তুমি এত ফরসা হইলা ক্যান এই কথা বলে সুশি'কে রোজ খেপাত বাবুর্চি
মিরাস আলী; মিরাস আলী না থাকলে বোধহয় এই প্রজেক্টে আমাদের চেহারা কাঠপাতা হয়ে যেত।
একদিন সুশি; হাতে করে পায়েস নিয়ে হাজির, বললো নিজে রেঁধেছে; খেতে
গিয়ে,দেখি মিষ্টিহীন। পায়েস নিয়ে সে,কি হাসা-হাসি; আমি সে-সময় খুব গানের পাগল
ছিলাম একদিন কান লাগানো ইয়ারফোন সহ এম.পি.থ্রি প্লেয়ার ছুড়ে একদিন নিচে ফেলেছিলো ।
হেমন্তের প্রথম দিন ও একটা কবিতা আবৃত্তি করছিলো। খুব সম্ভবত প্রেমের কবিতা; আমি
মিস করেছিলাম সেদিন কানে এম.পি.থ্রি প্লেয়ার ছিলো; সেদিন থেকে একটা আফসোস আমার মনে
জায়গা করে নিয়েছিল; ওর নিজের লেখা ওই একটাই কবিতা ছিল যে। আমি ওই কবিতা শত চেষ্টা
করেও ওর মুখ থেকে আর শুনতে পাইনি; পড়ে জেনেছিলাম ও আমাকে শোনাতেই সেদিন আবৃত্তি
করেছিল;
নবান্ন উৎসবের দিন ও এসে বললো কান্ত আজ তো তোমার ছুটি; স্যার বলেছে
তুমি আজ আমাদের সাথে ঘুরতে যাবে; আমি বললাম না আজ আমি তোমার সাথে একা ঘুরবো; যাবে
আমার সাথে;
-লোকে দেখলে বলবে কি
-লোকের কথায় কি যায় আসে। আমরা দু-জন কলিগ। তাছাড়া তোমার-আমার
ব্যাপারটা সবাই জানে; ও বললো জানলেই কি এটা তো সিনেমার পর্দা না; এটা গ্রাম
বাংলার গেয়ো মাঠ-ঘাট এখানে এসব কেউ দেখতে চায়না।
সুশি একা যাবেনা আমি জানতাম; তাই বিকেলে ওকে বললাম ঠিক আছে আজ তাহলে
চড়–ই ভাতি হোক;
দিনগুলো এভাবেই শেষ হয়ে গেল। আর শেষ হয়ে এলো আমাদের প্রজেক্ট।
সাত
প্রজেক্টের শেষ দিন। বিকেল এই গ্রাম আর সবুজ পাহাড় ছেড়ে বাড়ি ফিরবো।
আমাদের চোখ গুলো কতদিন পর সেই পুরনো মানুষদেরকে দেখবে সে আনন্দের পিনগুলো নাচছিলো
ভেতরে ভেতরে
ব্যাগ গুছিয়ে সবুজরঙা একটা পাঞ্জাবী পড়ে আমি ঘর থেকে বের হলাম। বিভাস
বাবু আমাকে পেমেন্ট দেবার চেক দেবে বলে সেই সকাল থেকে ডাকছেন।
সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টায় আজ আমাদের প্রজেক্টের শেষ কাজ হবে। আমি চেক
নিয়ে ঘরে আর ফিরলাম না। পারুল আপা আমার ক্যামেরা নিয়ে গেছে সেই ভোর বেলা তার খোজে
সামনে এগিয়ে গেলাম।
মেঘ নেই আজ; রোদও নেই। উঁচু পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে সুশি ক্যামেরা
হাতে দাড়িয়ে;
কাছে যেতেই ও বলে উঠলো কান্ত তুমি আমাকে একটা আকাশ কিনে দেবে ; আমি
সেখানে তোমার তোলা সমস্ত ছবি দিয়ে একটা গ্যালারী বানাবো। আমি হেসে বললাম দেব। তবে
আকাশ কেনার টাকাটা কিন্তু তোমাকেই দিতে হবে , আমাদের কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো।
আমাদের পুরো টিমের অর্ধেক এই পাহাড়ের গায়ে দাড়িয়ে আছি; কেউ কেউ ছবি তুলে নিচ্ছেন
কেউবা সাদামাটি , কিংবা বুনো ফুল ব্যাগে ভরছেন। সবাই কিছুটা মগ্ন হঠাৎ গুলির শব্দে
সবাই সচকিত হলাম; বর্ডার থেকে গুলি আসছে; বর্ডার ছয়শো গজেরও কম দূরত্বে। আমি ভয়
পেয়ে গেলাম গুলির আওয়াজ ক্রমশই বাড়ছে। সবার ভেতরে তখন একরকমের উত্তেজনা দেখা গেল।
আমরা নিচে নামবার জন্য পা বাড়ালাম। পাহাড়ের চারপাশে তখন নীরবতা নেই বললেই চলে;
আমরা সবাই পা চালিয়ে নিচে নামতে লাগলাম; অচেনা জংলী ফুল আমাদের পা ছুঁয়ে যাচ্ছিল;
সবার মাঝে একটা উত্তেজনা বেড়ে যাচ্ছে; আমরা সবাই সেই উত্তেজনা নিয়ে গতি বাড়াচ্ছি
ক্রমশই।
টিমের যারা এখানে আছে তারা এই মুহূর্তে কে কার আগে নিচে নামবে তারই
প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। এই মুহূর্তেই একদল লোক হাতে অস্ত্র উঁচিয়ে
ধেয়ে আসতে লাগলো; দেখে মনে হলো ওরা চোরা-কারবারি বর্ডার ক্রস করবার সময় হয়তো ধরা
খেয়ে গেছে; আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম; ওরা গুলি ছুড়তে শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। আমি
সুশির হাত ধরে দৌড়ে দিলাম; আচমকা পেছন থেকে ক’জন ঝাঁপিয়ে পড়লো আমাদের উপর; আমি তাল
সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে গেলাম বুনো গাছের উপর। পিছু ফিরে দেখি সুশি নেই;
নেই !! পাশে নেই !! চোখ যতদূর যায়। শুধু এক মুহূর্ত ওর আর্ত চিৎকার
শুনলাম; আমার পেছনে যে বড় খাদটা ছিল সেখানটায় গিয়ে দেখি; প্রায় দুশো গজ পাহাড়ের
নিচে পড়ে আছে সুশি। তারপর আমার চোখে পৃথিবী আধার হয়ে আসতে লাগলো। আমি খুক সম্ভবত
বুনো গাছের পাশেই ঢলে পড়েছিলাম।
আট
আমার চারপাশের জটলাগুলো ক্রমশই কমে যেতে লাগলো। সুশি’র লাশ নিয়ে ওরা
চলে গেছে সেই কখন; কিন্তু আমি যেতে পারিনি; আমি থেমে গেছি; আটকে গেছি।
নোনা জলের তাণ্ডবে বার বার মনে হলো; আলো ছাড়ব; মায়া ছাড়ব,
পৃথিবী,ছেড়ে দেব; আর ফিরব না কোনদিন এই পৃথিবীতে; এই পৃথিবী খুব খারাপ। তিনি উপর
থেকে খেলা শুরু করবেন; তারপর ইচ্ছে মতো খেলবেন; আনন্দ পাবেন বেদনা উপহার দেবেন।
পাহাড়ের উপরেই যখন প্রথমবার জ্ঞান ফিরলো তখনই সুশি’র কথা আবার আমাকে বিবশ করে দিল।
আমি জ্ঞান শূন্য ছিলাম তিনদিন। চোখ মেলবার পর থেকে আমার মুখে কথা
ফোটেনি বেশ ক’মাস।
আর কোনদিন কোন সবুজের বনে যাইনি; খুব দূরে দূরে থাকি; সেই ক্যামেরা
আর কাঁধে তুলিনা অনেকদিন হয়ে এলো। নীরব পথ পেলেই সুশি এসে দাড়ায়। আমি পথ চলতে
পারিনা। আমি ঝরনার জলে স্নান করতে পারিনা; ওর শাসন আমাকে এখনো মনে করিয়ে দেয়।
হুইস্কির বোতলে ওর ইচ্ছে গুলো ক্রমাগত ঘুরপাক খায়; আমি তীব্র
যন্ত্রণা নিয়েও আপন করে ভাবতে চাই সব বেদনা ঘেরা স্মৃতি গুলোকে। ওর বিদায়ের পর
থেকে আজকের এই দুপুর পর্যন্ত আমি পাথরে গড়া ভাস্কর্য হয়েই ছিলাম; খানিক আগে সেই
কথার পুনরাবৃত্তি; যে কথাটা সুশি আমায় বলেছিল , সে কথাটাই আজ অন্য কারো মুখে শুনে
ভেতরটা নাড়া দিয়ে গেল; কিছুটা উন্মাদনা আমার মাঝে প্রকাশ পেল। আকাশ মাঝে ভেসে উঠলো
সুশি’র কণ্ঠ; সেই যে, শেষ দিনের আগের দিন ওর সাথে বাইরে বেরুতে না পেরে মন খারাপ
করেছিলাম। তখন ও বলেছিল -দেখো আমি যদি কোথাও হারিয়ে যাই; তোমার বিষণ্ণতা ঘুচাতে
এমন একজনকে পাঠাবো; যে তোমাকে ভালোবাসবে আমারই মতো; শুধু তুমি তাকে চিনে নিও।
গ্যালারির একপাশে বসে ছিলাম এতক্ষণ।
আবার কেউ একজন ছবি কিনতে এসেছে। আমি সুশি’র জগত থেকে ফিরে এলাম।
দৌড়ে গেটে এলাম; রন্তু ওই মেয়েটি কোথায় ?
- দাদা চলে গেছে তো!
আমি অসহায়ের মতো বললাম কি বলিস! কোনদিকে গেছে
-তা তো বলতে পারবোনা।
আমি পিছু ছুটলাম গেট পেড়িয়ে একদম বাইরে;
পথে নামলাম কাঠ রোদ্দেুর আমার সারা গায়; ওকে খুঁজে পেতেই হবে; আমার
চোখ আজ রোদের ছেলের গায়ে আঁক কষবে বিষণ্ণতা তাড়াতে কিন্তু ওকে পাবো তো!!