ছাপার অযোগ্য ।। মাহবুব আলী













লোকটি অশ্রাব্য গালাগাল দিতে দিতে চোখ উলটিয়ে গড়গড়িয়ে থুতু ফেলে। নিজের গায়ে। তারপর বাসের ভেতরে হড়হড় বমি করে দেয়। তার সঙ্গে আসা দু-জন লোক। একজন খুব দ্রুত পাশের জানালা খুলে দিতে চেষ্টা করে। খোলে না। সে তবু হুড়োহুড়ি করতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে বিবমিষার গন্ধে বাসের পেছন দিক থকথকে হয়ে উঠেছে। এবার ক-জন যাত্রী নড়ে উঠল। কেউ দাঁড়িয়ে গেল। তারা মুখ খুলে সুপারভাইজার ও ড্রাইভারকে গাল দিতে শুরু করে।

‘কি মিয়া পয়সা দিয়া এ কোন্‌ ঝঞ্ঝাট?’

সেদিকে কারও কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হলো না। লোকটি আবার মুখ খোলে। মাঝারি গড়ন, গাঁট্টাগোট্টা, গালে সপ্তাহখানেকের ঘন দাড়ি। বাঁ গালে বড় একটি জড়ুল। তার কোনো হুঁশ-জ্ঞান আছে বলে মনে হয় না। তখনো অদৃশ্য কাউকে চিৎকার করে গালাগাল করে চলেছে।

‘ছাপার অযোগ্য। ছাপার অযোগ্য। কুত্তা, হারামির বাচ্চা, আমারে কই লই যাইতাছোস? কই, কই বে মাতারি? শালা তোর মায়ের ...। ছাপার অযোগ্য। ছাপার অযোগ্য।’

সুপারভাইজার সেদিকে তাকিয়ে চুপসে আমশি, কী করবে বুঝতে পারে না; সংকুচিত-কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তার মুখে কোনো কথা নেই। নিশ্চুপ। লোকটির সঙ্গের দু-জন খুব অসহায় চেহারা করে বসে গেছে। একজন এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে বাইরে তাকায়। হাসান দেখল, অবশেষে জানালাটি খুলেছে। সেখানে ওই লোকটিকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। গোয়ালহাটের স্টপেজে প্রায় সকল যাত্রী নেমে গেল। এখন বাস অনেক ফাঁকা। সে নেমে যাবে কি না ক্ষণেক ভেবে চুপচাপ বসে থাকল। হাতে সময় কম। সুপারভাইজার তার দিকে বার কয়েক তাকিয়েছে। ভেবেছে সেও নেমে যাবে। হাসান তার মনোযোগ ভ্রুক্ষেপ করল না। সে খুব অনায়াসে পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আনে। কয়েকটি মাত্র আছে। আলগোছে একটি জ্বালায়। বেশ আয়েশে ধোঁয়া ছাড়ে। বাসের ভেতরে বডিতে লেখা ‘ধূমপান নিষেধ’ কথাটিকে প্রচণ্ডভাবে উপেক্ষা করে। পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারে, লোকটি গালাগালি দিয়ে চলেছে। চূড়ান্ত অশ্লীল ভাষায়। সে শব্দ ছাপার অযোগ্য।

সামনে ডানদিকের সিটে একজোড়া তরুণ-তরুণী। দেখে বোঝা যায় কাপল্‌। বোধহয় অল্প কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে। মেয়েটির পরনে লাল শাড়ি। ঘোমটা ঢাকা চেহারা। অদ্ভুত সুন্দর আর মায়াবী। দু-হাতে সোনার গয়না। চোখের দৃষ্টি খুব লাজুক। তরুণটি বেশ অস্থির। সবকিছু এড়িয়ে নির্বিকার থাকার চেষ্টা করছে। হাসানের বুক ঠেলে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। তার কোনো সঙ্গী হবে না। সারা জীবন তাকে একা থাকতে হবে। নিঃসঙ্গ একাকী। তার মন উদাস হয়ে গেল। এমনিতে ট্রেন বা বাসে উঠলে মন ভারী হয়ে যায়। আজ অসি'রতা আর বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে। ইদানীং জীবনকে অহেতুক অসার আর অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। হতাশার বিষকাঁটা সবসময় বুকে জ্বলে। সে জগত সংসারে একজন অপাংক্তেয় ব্যক্তি। হতভাগ্য...পরাজিত মানুষের জীবনযাপন।

ড্রাইভার কাগজে মোড়ানো ছোট পুঁটলি থেকে একটি পান বের করে মুখে দিয়েছে। জর্দার মাতাল করা সৌরভ দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে যায়। ইতোমধ্যে বেশ ক-জন যাত্রী নেমে গেছে দেখে তার কর্কশ চেহারা আরও রুক্ষ। চেঁচিয়ে সুপারভাইজারকে জিজ্ঞেস করে, -

‘কতদূর যাবে বে?’
‘ফুলবাড়ি!’
‘কত দিছে।’
‘পঞ্চাশ টাকা।’
‘কেন অ্যাম্বুলেন্সে যেতে পারল না? এখন সব প্যাসেঞ্জার নামে গেল। তেলের পয়সা হবে বে?’
‘চলেন...চলেন। ফুলবাড়ি গেলে যাত্রী হবে।’
‘ওখানে আগে গাড়ি ধুবি। টাইম তো গেছে। শালা পাগল ছাগল লোক তোলে।’

দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা হেল্পার ঠাস ঠাস করে বাসে দুটো বাড়ি দেয়। রাস্তার সামনে স্পিডব্রেকার। বেখাপ উঁচু। বাস বড় একটি ঝাঁকুনি দিয়ে সেটি পেরোয়। তারপর গতিতে আসে। হাসান সিগারেটের শেষাংশ জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয় তখন। এখন বাসে বেশি লোক নেই। শেষের দু-সারিতে তিনটি করে সিট ফাঁকা। এবার সিটে দু-পা তুলে নিজেকে ছড়িয়ে বসা যায়। সে তেমন করে না। প্যান্টের ইস্তিরির ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাবে। সে বাইরে দৃষ্টি ফেলে দূরের সবুজ গাছপালা, ফসলের ক্ষেত আর মানুষ দেখা শুরু করে। বাস হাল্কা হয়েছে বলে দ্রুত ছুটছে। ঝাঁকুনি বেড়েছে। ওদিকে লোকটির মুখও চলছে দ্রুত।

আকস্মিক তার মনে হয়, বাসের মধ্যে সেই একমাত্র বেমানান যাত্রী। ভোরে খুব যত্নে সুন্দরভাবে শেভ করেছে। বাটারফ্লাই গোঁফে দিয়েছে মিলিমিটার ভারসাম্য। চেহারায় সাবান ঘষে ঘষে যতটুকু সম্ভব উজ্জ্বলতা আনার চেষ্টা কম হয়নি! তারপর ফিটফাট ইস্তিরি করা পোশাক। হাতে একটি নীল রঙের ফাইল ফোল্ডার। সেখানে জীবনের অনেক হিসাব-নিকাশ সংরক্ষিত আছে। অন্যদিকে বাসের বেশিরভাগ যাত্রী গ্রামীণ জনপদের সাধারণ কৃষক বা দিনমজুর মানুষ। অযত্ন আর সাধারণ বিস্রস্ত বেশভূষা। তাদের কারও কারও বিস্মিত চাহনি তাকে বেশ বিব্রত করে তোলে। একসময় নিজেকে তার ক্লাউন মনে হয়। সে নিজের মধ্যে এভাবে ডুবে ডুবে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যায়।

সে আরেকটি সিগারেট জ্বালিয়ে নেয়। জানালা দিয়ে বাইরে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ে। পেছন থেকে দুর্বোধ্য উচ্চকণ্ঠের খিস্তি ভেসে আসছে। সে-সবের ভেতর দিয়ে বাস লক্ষ্মী তলায় এসে থামে। ডানদিকের সারিতে বসে থাকা দম্পতি নেমে যাচ্ছে। হাসানের দৃষ্টি চকিতে তাদের পেছনে গেল। মেয়েটি ঘুরে তার দিকে তাকায়। সরে যাওয়া আঁচল টেনে নিচ্ছে। হাসান দেখল মেয়েটি খুব সুন্দর করে সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছে, অপূর্ব মায়াময় চেহারা। তার বুকে আর একবার বিষণ্ণতা আছড়ে পড়ে। তাই হয়তো এড়িয়ে যেতে দূরে কোথাও মগ্ন হতে চাইল সে। ক্ষেতের একধারে কয়েকটি আমগাছ। সেগুলোর নিচু শাখায় জবাই করা গরুর মাংস খণ্ড ঝুলে আছে। আজ বাজারের দিন। সে আঁতকে ওঠে। কি বীভৎস! বুকের মধ্যে অপ্রস্তুত অস্থিরতা গুড়গুড় করছে। অদ্ভুত অনুভূতি। বাস আবার চলতে শুরু করেছে। হাসান গাল ভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে সামনে তাকায়, এখনো অনেক পথ; কখন পৌঁছবে কে জানে!

বাসে শেষদিকের লোকটি এখন ঝিমচ্ছে। হাসান মাথা ঘুরিয়ে দেখে। বয়স কত হবে? ত্রিশ-বত্রিশ। হাউজিং মোড়ে যখন তাকে প্রায় ধরাধরি করে ওঠানো হয়, কেউ কেউ আপত্তি করে। জাতি গেল ধর্ম গেল...এমন অচ্ছুৎ কিছু। লোকটির মুখ দিয়ে গলগলিয়ে লালা পড়ছিল। পিচকিরির মতো এদিকে-সেদিকে থুতু ছিটোয়। মুখে ছাপার অযোগ্য বীভৎস গালাগাল।

‘শালা বাঞ্চত আমারে কী করলি? কই লবি বে...পুত? তর বইনের...ছাপার অযোগ্য। ছাপার অযোগ্য...।’

লোকটি আবার জেগেছে। গালাগাল শোনা যাচ্ছে। তারপর নিশ্চুপ। আকস্মিক আবার থুহ্‌ থুহ্‌ শব্দ। প্রচণ্ড বেগে হুঙ্কারের সঙ্গে উপরে একদলা থুতু উড়ে গেল। সামনের সিটে ও’হারা জিনসের প্যান্ট পরে বসেছিল এক যুবক। আমবাগানে উঠেছিল। চোখে মার্কারি কোটেড সানগ্লাস। হয়তো সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া কোনো ছাত্র। স্কুল ছেড়ে কলেজে এলে যেমন নতুন অহম হয়, চোখে-মুখে তেমন ভাব। শ্লেষ্মার বড় দলা তার বাহারি চুলে গিয়ে আছড়ে পড়ল। সঙ্গের লোক দু-জনের একজন প্রায় দৌড়ে গেল তার কাছে। তারপর ‘ভাই মাফ করেন ভাই...’ বলতে বলতে চুল মুছে দিতে ব্যস- হয়ে গেল। হাসান নির্বিকার দৃশ্যটি কিছুক্ষণ দেখে থাকল। নিজের মধ্যে আড়ষ্টতা এসে যাচ্ছে। একটি ভালো কাজে রওয়ানা দিয়েছে। সেজন্য ভোর থেকে যথেষ্ট সময় নিয়ে তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে কি উৎকট ঝামেলা! এখন যদি তার মাথা কিংবা গায়ে তেমনকিছু এসে পড়ে...তার সারা শরীর ঘৃণায় রি রি করে ওঠে।

সুপারভাইজার কারও আপত্তিতে কান দেয়নি। তাদের ব্যবসা করতে হয়। সেন্টিমেন্ট দেখে দিন চলে না। হাসান চুপ করে থাকে। কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি। সবকিছুতে ইন্টারফেয়ার করা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। প্রচণ্ড অনীহা। নিজেকে ইচ্ছে করেই নিষ্ক্রিয় রাখে। আসলে সে ক্রমাগত নিজের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে, এটিই এখন বড় উপলব্ধি। আজ কি যে হলো, সঙ্গের লোকটিকে সামনে দেখে জিজ্ঞেস করে বসে, -

‘কি ব্যাপার, মৃগীরোগী?’
‘না ভাই, সে বেক্‌ডি ইতিহাস। হের বউ ঘর করব না, ব্যাডায় ছাড়ে না। শ্বশুরবাড়ি গেছিল বউ আনতি। কি যে খাওয়াইছে কে জানে! দেখেন কি অবস্থা! কয়দিন কোন খবর না পাইয়া শুধু খোঁজ আর খোঁজ। আইজকা পাইছি। রাস্তায় পইড়া আছিল।’

হাসানের এত ইতিহাস শোনার আগ্রহ নেই। লোকটির বলার কি দরকার কে জানে। হাসানের আশ্চর্য সরল চোখ নাকি বাসের সবাইকে ব্যাখ্যা দেয়া? হলেও হতে পারে। লোকটি আরও কিছু বলছিল। হাসান শুধাল, -

‘এখন মামলা করবেন?’
‘হে ব্যাডায় ঠিক না অইলে কী করুম? ভাগ্না হয়। কথা বলার দরকার আছে। ডাক্তারের সাট্টিফিকেট অবশ্য লইছি।’
‘দুনিয়া বড় হারামি জায়গা। কার ভেতর কোন্‌ শয়তান বসে আছে কে বুঝতে পারে!’

হাসান নিজের কথাতে চমকে উঠল। তারপর সম্বিত ফিরে দুচোখের দৃষ্টি জানালা গলিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। সামনে এক ভাটা। মাঠ জুড়ে সাজানো কাঁচা ইট রোদ্রে শুকচ্ছে। আজ অবশ্য মেঘলা আকাশ। বাতাস স্থবির আর ভেজা ভেজা। বৃষ্টি হবে না কি? তখন বাস খানিক কাত হয়ে বেজাই মোড় পেরিয়ে যাচ্ছে। দু-ধারে ঈপিল ঈপিলের সারি। সবুজ ঠাণ্ডা ছায়া। মনের মধ্যে অকারণ শূন্যতা ভেসে ভেসে বিষণ্ণ করে তোলে। সেখানে প্রত্যাশা আর সাধের প্রজাপতিগুলো উড়তে থাকে। সে চোখ বন্ধ করে তন্দ্রাচ্ছন্ন হতে চায়। কিছু হয় না। তারপর আবার দূর-দিগন্তে তাকিয়ে কল্পনায় হিসাবের এক ছক আঁকে। এবার সফল হলে অন্তত একটি ফ্রেমে জীবন সাজানো যাবে। এ জীবন আর ভালো লাগে না।

সে কিছুক্ষণ পর আবার সামনে মুখ ঘুরিয়ে বসে। সামান্যতম স্বস্তি- পাচ্ছে না। বাস জোরে যাচ্ছে, সময় বোধহয় ধীরে। সময়মতো পৌঁছতে পারবে তো? বুঝতে পারছে অদ্ভুত অস্থিরতা ভেতরে শুঁয়োপোকার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রচ্ছন্ন কোনো ঈর্ষা করে চলেছে বিছুটি দংশন। সেই সঙ্গে নিজের সীমাবদ্ধতা আর অসফলতার পীড়ন যোগ হয়েছে।

গত সন্ধেয় তমাল এসেছিল। সে যখন সুখবর দেয়, হাসানের কাষ্ঠ হাসি ছাড়া আর কি থাকে? সত্যি এই, তার ভেতরে মাৎসর্যের যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। তমালের ভালো খবরে সে খুশি হতে পারেনি। নিজের যত সংকীর্ণতা জেগে উঠতে থাকে। সেটি নিয়ে সারারাত মনকে গালাগাল করে। সময় কেমন বিবর্ণ হয়ে যায়। দুচোখের পাতা আর এক করতে পারে না।

‘তা হলে কাল সন্ধেয় আসিস। তিন বছরের কন্ট্রাক্ট। আর হয়তো দেখা হচ্ছে না। কবে ফিরি কে জানে।’
‘জার্মানিতে তুই কী করবি? বেতন কত রে?’
‘একটা মিনারেল ওয়াটার কোম্পানির কাজ। প্যাকেজিং করা। বেতন চল্লিশ হাজার টাকা। ওভারটাইম আছে। থাকা খাওয়া ফ্রি।’
‘ভালোই তো! এত কষ্ট করে পড়লি।’
‘ও তো ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট। মাল না থাকলে যার কোনো দাম নাই। যাক তুই আসিস। বুধবার ফ্লাইট। আরও ক-জনকে বলতে হবে, যাই রে!’

তমাল যেমন ঝড়ের মতো এসেছিল, হোন্ডার ধোঁয়া উড়িয়ে পাড়া কাঁপিয়ে চলে যায়। তখনো নীলাভ ধোঁয়া বাতাসে মিশে যায়নি, হাসানের বুক ঠেলে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তমাল ভাগ্যবান। ডিগ্রি পাশ করার পর তার বাবা হোন্ডা দিয়েছে। আর সে এমএ পড়ার ইচ্ছেটুকু বলে দেখে গেছে অক্ষমতার হতাশায় আঁকা করুণ এক মুখচ্ছবি। বাবার জন্য তার দুঃখ হয়। তখনই ভেবে নেয় এ ধরনের আবদার কোনোদিন করবে না। কেননা এই জগত সংসারে সবাই ভাগ্যবান হয়ে আসে না। মনকে প্রবোধ দেয়, সুযোগ পেলে প্রাইভেটে মাস্টার্স করে নেবে। আগে একটি চাকুরী হোক।

আজ এক ইন্টার্ভিউ আছে। দিনটি বিশেষ ব্যস্ততায় চলে যাবে। সে মনে মনে সারাদিনের কাজের একটি ছক তৈরি করে রেখেছে। বিকেলের মধ্যে ইন্টার্ভিউ শেষ হয়ে যাবে। তারপর বাস ধরে ফেরা। পনেরো মিনিট পর পর বাস। বাড়িতে ফাইলপত্র রেখে একটু ফ্রেশ হবে। সন্ধেয় টিউশানি। রাতে তমালের বাড়ি। ফেয়ারওয়েলের দাওয়াত। ভালো খাওয়া-দাওয়া আছে। ইমপ্রুভড। সে কত মাস তেমন কিছু খায় না!

বাসে বসেই নিজের লোভ ও দীনতায় সে এতটুকু হয়ে যায়। সে কি ক্রমশ স্বার্থপর হয়ে উঠছে? বাবা আর ভাইবোনের কথা ভাবছে না। তারাও তো অনেকদিন তেমন ভালো কিছু খায় না। এই বিষাদ ভাবনায় মনের মধ্যে কোত্থেকে ক্লেদ এসে জমা হতে থাকে। তার খুব খারাপ লাগে। অজান্তে বুক পকেটে হাত দেয়। সিগারেটের খালি প্যাকেট শুধু উপহাস করে চলে। রাঙ্গামাটি-বিডিআর ক্যাম্পের স্টপেজে বাস এসে থামলে একবার ইচ্ছে করে, এক প্যাকেট কিনে নেয়। পরক্ষণে গুটিয়ে যায়। টিউশানি করে আয়ের ওই সামান্য কয়েকটি টাকা। খরচ হয়ে গেলে অন্যদিনগুলো কীভাবে চলবে? সিগারেট বড় শৌখিনতা। অধিকারহীন বিলাসিতা। ছেড়ে দেয়াই ভালো। তার মন আবার কালো বিষণ্ণতায় ভরে ওঠে।

সামনের স্টপেজে বাসে মোটামুটি ভিড় হয়ে গেল। দু-একজন রড ধরে দাঁড়িয়ে গেছে। কথার কলরোল। নানা ব্যক্তির বিবিধ কথা। তার ফাঁকে ফাঁকে ভেসে আসছে খিস্তি। তবে তীব্রতা কমে গেছে। হাসান লোকটির নাম জেনেছে। সুলতান। সুলতান মুলতানি গালাগাল ঝাড়ছে। তার মামা মাঝে মধ্যে মুখে তোয়ালে চেপে ধরে। গোঙানির শব্দ বড় অসহনীয় লাগে।

‘শালারা আমারে মারলি ক্যান? মাদার...। ওই মামা...মামা আমারে কী খাওয়াইছে? ক্যামুন করতাছে...ক্যামুন ক্যামুন রে...! ওই ধাগড়ির পুত্‌! মামা...মামারে...ছাইড়া দে...দে ছাইড়া শেষ কইরা দিমু। শালারা আমার...ছিঁড়তে আইছে। মা মাগো কই? আমার মা কই...মা কই...ই...ই?’

এরপর প্রচণ্ড গমকে কান্না। থুতু ছেটানোর শব্দ। মুখে তোয়ালে চেপে ধরার গোঙানি। বাসের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকা ক-জন যাত্রী মন্তব্য করে, পাগলটিকে বাসে করে কেন নিয়ে যাচ্ছে? অ্যাম্বুলেন্স ছিল না? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? হেমায়েতপুর না কি ইত্যাদি। তখন মৃদু ধাক্কা দিয়ে বাস আবার চলতে শুরু করে।

হাসানের আজ বিশেষ দিন। আজ থেকে চাকুরীর আবেদনের বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিকেল চারটা বাজলে আটাশ বছরে পা দেবে। এ ছাড়া যে স্কুলে আবেদন করেছে সেখানে হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। যোগাযোগ করেছিল। গভর্নিং বডির দু-একজন প্রভাবশালী সদস্যকে বলে রেখেছে। তারা আশা দিয়েছেন। সত্যি বলতে এ চাকুরী তার পছন্দ নয়। শিক্ষকতা। কেমন দীন-দরিদ্র পেশার নাম। যার নাই কোনো গতি...সেই করে পণ্ডিতি। তবু যদি হয়ে যায়। যদি হয়? আহা সেই যেন সত্য হয়!

এই প্রত্যাশা আর চিন্তায় সারারাত তার প্রায় ঘুম হয়নি। এক. তমালের সৌভাগ্য তাকে ঈর্ষার পীড়া দিয়েছে। দুই. সামনের সম্ভাবনাময় ইন্টার্ভিউ। এরমধ্যে কোনো অতিদূর হতে ভেসে আসা মহম্মদ রফির দর্দ ভরি গীত মনকে উন্মনা অস্থির করে তুলেছিল। কেন জানি মনে পড়ছিল কলেজে পড়ার সময় পরিচিত সেই মেয়েটির কথা। সে তখন থার্ড ইয়ারে। আর এক বছরের জুনিয়র অনুপমা মৈত্র। চমৎকার কথা বলত। বইয়ের ভাষায় গুছিয়ে গুছিয়ে। অদ্ভুত সুন্দর কণ্ঠস্বর। কৃষ্ণচূড়া ফোটার হিমোষ্ণ এক সকালে বই ফেরত দিতে এসে বলে, -

‘আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।’
‘মানে...হঠাৎ এ কথা?’
‘ন্‌...না, হঠাতই তো! সেদিন নবীন বরণ অনুষ্ঠানে মাউথঅর্গান দারুণ বাজিয়েছেন।’
‘তাই বলুন আমি না, মাউথঅর্গান।’
‘সেটাই কি শুধু!...আচ্ছা আপনি হিন্দু মিথোলজি পড়েছেন? রাধাকৃষ্ণের গল্প?’
‘না।’
‘পড়বেন? আমার কাছে আছে।’
‘সময়ের বড় অভাব। আচ্ছা দেবেন পড়ে দেখব।’
‘আচ্ছা চলি।’

তখন অনুপমার চোখে-মুখে হতাশা এসে গ্রাস করে। আর হাসান ভাবে এ রকম জবাব না দিলেই পারত। মিথ্যের জন্য কিছুক্ষণ অনুশোচনা হয়। একসময় মাউথঅর্গান প্রচণ্ড শখ ছিল। এখন স্মৃতি। সে স্মৃতি কখনো সুখের কখনো দুঃখ জাগানিয়া। যেমনভাবে অনুপমার আবেগময় ছেলেমি প্রেমপত্রের কথা। হাসান তার নিঃসঙ্গ বন্ধুহীন জীবনে সেই চিঠির কথা আজও মনে রেখেছে। সেদিন কোনো মেয়ের কাছে আসার ইচ্ছে কিংবা সুযোগকে ভয় পেয়েছিল সে। অনুপমা পরে একদিন বইটির প্রাপ্তি এবং ঠিক আছে কি না জিজ্ঞেস করে। হাসান ‘কেন ঠিক থাকবে না’ বলে অন্যপাশে চলে যায়। এরপর অনুপমা আর কথা বলেনি। হয়তো তাকে মাকাল বা অন্যকিছু ভেবে নিয়ে থাকবে। হাসান মিশ্র ভাবনায় নিজেকে গাল দেয়। আসলে সে ভীতু আর দুর্বল এক মানুষ। শুধু তাই নয়, বোকা। অনুপমা তার জীবন বদলে দিতে পারত। মেয়েটি তাকে সেভাবে চিনে নিয়েছে। তাকেও চিনিয়ে দিয়েছে। দুর্বল, ভীতু আর বোকা মানুষেরা জীবনে কিছু করতে পারে না।

রাতে বারবার সেই চেহারা মনে আসছিল। কাঁধ ছাপানো ঝাঁকড়া চুল। কোনো দেবীর মতো পানপাতা মুখ। উজ্জ্বল দুটো চোখ। সে চোখের দৃষ্টি কিছু বলতে চায়। সে কথা বুঝেছিল। সাহস হয়নি। এভাবে ভাবনার মাঝে অনুপমা সারারাত তাকে খুব জ্বালাতন করে। বিএ পাশ করার পর মা বলেছিল, এবার হাসানের বিয়ে দেব। মেয়ে পছন্দ করা আছে। মিলি। দু-জনকে বেশ মানাবে।

কোথায় সেই স্বপ্ন আর সাধ! পাশের বাড়ির মেয়ে মিলি। মায়ের সঙ্গে খুব ভাব। মাঝে মধ্যে বাসায় আসত। বাঁকা চোখে তার দিকে তাকাত। কখনো তার সঙ্গে দু-একটি কথা হলে উৎফুল্ল হয়ে থাকত সারাদিন। সেই মিলি। মায়ের কথায় হাসানের মনে রং ধরেছিল বইকি! মিলি কোনো কোনো রাতে স্বপ্নে এসে ঘোরাফেরা করে। ববিতা হয়ে গান শোনায়। হাসান সকালে ঘুম থেকে জেগে বুকের ভেতর শূন্যতার কারণ খোঁজে। হদিশ পায় না। তখন খাতা খুলে একের পর এক স্কেচ আঁকার চেষ্টা চলে। আর এভাবে দিন পার করে দেয়। কোনো ছবি ঠিকমতো হয় না। আসলে সে আঁকতে পারে না। তারপর একদিন কোথায় সব হারিয়ে গেল। অনেকটা বাছুরে প্রেমের মতো। বাবা রিটায়ার করে। একদিন মা টুপ করে মরে যায়। এখন বৃদ্ধ বাবা আর ছোট দুটি ভাই বোন। জীবনের মিঠেল স্বপ্ন আর ছবি আঁকার সুযোগ কোথায়? সর্বোপরি দায়িত্ববোধ এবং একটি সংস্থান চেষ্টা। কোথা থেকে কোথায় তাকে নিয়ে এসেছে। এখন মিলি জননী। বছর পাঁচ আগে এক ক্যাপ্টেনের তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। মিলির সঙ্গে তেমন কোনো কথা নয়, প্রেম নয় অথচ যেদিন ওর বিয়ে হয়ে যায়, তার ভেতর অর্বাচীন কোনো দেবদাস গুমরে মরতে থাকে। চেহারা মলিন হয়ে যায়। সে হয়ে যায় বিষাদিত নিশ্চুপ। তারপর একসময় ভেবে নেয়, আহা সেও ভালো...মিলি সুখী হোক। এভাবে নিজের স্বপ্ন সাধের মৃত্যুতে সে এতকাল নিজেকে করুণা করে এসেছে। তার স্বপ্ন দেখতে নেই। তবু কখনো দুচোখের পাতায় স্বপ্ন আসে। নিষিদ্ধ গোলাপের মতো একান্ত আপন। ভোরের আলোয় অনটন আর নানান অক্ষমতার ক্লিষ্ট পীড়নে যার অপমৃত্যু।

গতরাতে এমন ভাবনা বুকে ঢেউ তুলেছিল। অনেক স্বপ্ন আর দৃশ্যকথনে মুখর থেকেছে। চাকুরী হলে প্রথম মাসের বেতনে বাবার, ভাইবোনের নতুন জামা-কাপড় নেবে। ওদের কাপড় আর ব্যবহারের মতো নেই। একটু ভালো খাওয়া দাওয়া। ক্রমে সংসারের হাল মোটামুটি শক্ত হলে একদিন সুন্দর দেখে বউ আনবে। মায়ের বড় সাধ ছিল। তা ছাড়া এখন তার ইচ্ছে করে, একজন সঙ্গী; যাকে মন খুলে বলা যাবে দুঃখ বেদনা আনন্দ সুখের কথা। যাকে বুকে জড়িয়ে চলে যাবে স্বপ্ন সুখের দেশে। এ যে জীবনের ধর্ম। একে অস্বীকার করে পালাবে কোথায়?

পাগল, যদি সে পাগলই হয়, চিৎকার করে গালাগাল দিচ্ছে অজানা কাউকে। বাসের ভেতর বিবমিষার ঘনীভূত শুকনো গন্ধ। লোকজনের ভিড়। পেছনের দিক থেকে মুহুর্মুহু চিৎকার ভেসে আসে।

‘শালারা আমারে কি খাওয়াইলি? বাঞ্চত এইহানে থাম! থাম কইতাছি...কইতাছি থাম। মাদারচোৎ...রোক্‌ রোক রোককে হি হি হি! থুত্‌ থু ওয়াক থু! আমার ভাললাগে না। মুতব। মুতব...শালা পাবলিকের মুখে মুতব! হারামির বাচ্চা আমারে আর মারিস ক্যান শালা। শালা...তোর মাকে...!

প্রচণ্ড কড়া এক ধমক। তারপর স্থির নীরবতা। শুধু বাতাস কেটে যাওয়া বাসের গতির শব্দ। তার মধ্যে এক গোপন বৈঠকের মতো কিছু বিড়বিড় কথোপকথন শোনা যায়।

‘সুলতান চুপ। চুপ কর...চুপ কর বাপ।’
‘আমার বউ কই? বউ আইনা দে। আমি ওরে...। ছাপার অযোগ্য। ছাপার অযোগ্য।’

সুলতানের মুখে তোয়ালে চেপে ধরেছে ওর মামা। হাল্কা গোঙানির শব্দ আসে। হাসান খুব অস্থির। অস্বস্তির কাঁটা সারা মন জুড়ে ছড়িয়েছে। কোথায় বাসে বসে নোটবুক খুলে মন্ত্রীদের নাম মুখস্থ করবে। চুয়ান্ন হাজার বর্গ মাইলের দেশে বাহাত্তর জন মন্ত্রী। নাম দফতর কিছু মনে থাকতে চায় না। তারপর চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু...কি ফ্যাসাদ! অন্য বাসে এলেও পারত। কিংবা গোয়ালহাটে প্রায় সবাই যখন নেমে যায় তখন নেমে গেলে পীড়াদায়ক এ ঝামেলা থাকত না। মনের ভেতর ব্যর্থতার আশঙ্কা। অমঙ্গল সূচনা খচ খচ করছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পিচের রাস্তায় পা রাখতে দেখেছে তেমন অশুভ এক দৃশ্য। এক কুকুর রাস্তার ঠিক মধ্যখানে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে আছে। নিরীহ পশুটি ধারেকাছেই থাকত। দৃশ্য দেখে হাসান নির্দোষ কুকুরের মৃত্যুর জন্য দায়ী ট্রাক বা বাসের উদ্দেশ্যে গাল দিয়েছে। অবশ্য এটি দেয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল কি না কিংবা মৃত কুকুর পথের সামনে দেখে যাত্রা নাস্তি ভেবে বসবে এমন কুসংস্কার তার নেই। তবু মনে হচ্ছিল দিন ভালো যাবে না। আজ জীবনের একটি দিন। তার প্রমাণ বুঝি এই উটকো ঝঞ্ঝাট।

আচ্ছা আসলেই কি তেমন ঘটনা? শ্বশুর বাড়িতে বিষ প্রয়োগ নাকি অন্যকোনো ব্যাপার আছে? এমনও হতে পারে, সঙ্গের ওই দু-জন লোক কিডন্যাপার। তারা সুলতানকে ড্রাগ এডিক্ট করে অপহরণ করে নিয়ে চলেছে। কি জানি কী হবে? হতে দাও। তার আত্মকেন্দ্রিক মন বাইরে তাকাতে নিষেধ করে। গন্তব্য আর বেশি দূর নেই, এসে গেছে প্রায়।

হাসান বাস থেকে নেমে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। অল্প বয়সী এক কিশোর তার রিকশায় ডাকে। তখন শোনা যায় সুলতান আসলে একজন চোর। ছিনতাইকারী। হাতেনাতে ধরা পড়ার পর পুলিশি থার্ড ডিগ্রিতে ওই দশা। অনেক কায়দা করে ছাড়িয়েছে। দু-দিন প্রায় অভুক্ত ছিল। এই লোকটির উপর যা গেছে বলতে বুক কাঁপে।

হাসান শিহরে উঠল। অনেক আগে কৈশোরকালে একবার চোর পেটানো দেখেছিল। পাবলিকের মার কাকে বলে! সেটি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। এমনভাবে কেউ মানুষকে মারতে পারে? তখন দুঃখ পেলেও মনকে এই বলে প্রবোধ দেয়, অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হয়। এখন বোঝে, সমাজ অপরাধী তৈরি করে। শাস্তি দেবার কে? সুলতানের বিষয় খুব সাধারণ। ব্যতিক্রম কিছু নয়। তার ভাবনায় কিছুক্ষণ সমাজ অপরাধ বিচার ইত্যাদি বিষয় গুঞ্জন তোলে। আচ্ছন্ন করে দিতে চায়। সে সুযোগ দিতে নারাজ। আশেপাশে নিবিড় দৃষ্টি ফেলে মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে দেয়। আপন মনে শ্রাগ করে রিকশায় উঠে বসে। হাতে সময় আছে। সবে নয়টা চুয়ান্ন। এতক্ষণে ইলিয়াছুর হয়তো এসে গেছে।

উপজেলা চত্বরে এক কাঁঠাল গাছের ছায়ায় রেস্তোরাঁ। সেখানে ইলিয়াছুরের থাকার কথা। দশটায়। ইন্টার্ভিউ সাড়ে দশ থেকে। হাসান চারপাশ তাকিয়ে প্রায় জনশূন্যতা দেখল। কয়েকজন লোকের পদচারণা ছাড়া সব নীরব। একটি উপজেলায় যা কখনো দেখা যায় না। রেস্তোরাঁয় উঁকি দিয়ে হতাশ। ইলিয়াছুর আসেনি। তার একবার বসতে ইচ্ছে করল। বসল না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উপজেলা ভবনের দোতালায় উঠে গেল। দক্ষিণে রেলিং’এর খুব কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সামনে একটি জামগাছ। সেখানে দাঁড়িয়ে গাছের কয়েকটি শাখা হাত দিয়ে ধরা যায়। সে একটি পাতার উপর হাত রাখল। ধুলো জমে গেছে। আঙুলে ঘষে ঘষে যতটুকু সম্ভব পরিষ্কার করে ফেলল সে। তারপর আপন মনে অবিমিশ্র আত্মতৃপ্তি বোধ। কি ঝকঝকে পাতা! মসৃণ। আজ এ পাতাটির মতো তার ধুলো-ময়লা আবৃত্ত জীবন স্বচ্ছ আর মসৃণ হয়ে যাবে। সে অলীক কোনো স্বপ্ন নিয়ে দূরের বিস্তৃত দৃশ্যে তাকিয়ে থাকে। নানান রঙের গাছপালা নিয়ে আকাশ দিগন্তে মিশেছে। সবুজ ক্ষেত। তার মধ্যখানে একটি ইটের ভাটা। বর্ণিল পোশাকের লোকজন। সকলের কাজ আছে। তারা কাজে ব্যস্ত। ধীরে ধীরে জেগে উঠছে জীবন। কর্মচঞ্চল। উপজেলা চত্বরে লোক আসতে শুরু করে।

আকাশে ভেসে বেড়ানো ছোট ছোট মেঘগুলো এক জায়গায় জমতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে বায়ু থেকে ঈশান কোণে বিস্তৃত হয়ে আকাশ ঢেকে যাচ্ছে। খুব দ্রুত ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গেল দিনের আলো। আলোকিত সবুজ দৃশ্যাবলী ধূসর-কালো রঙের পটভূমিতে বদলে প্রায় রাত হয়ে যায়। এসবের মধ্যে কোত্থেকে এক আশঙ্কা উঁকি মারতে শুরু করে দেয়। সে চুপ করে প্রকৃতির দ্রুতলয়ের কাজ দেখে। অন্যকোনো ভাবনায় পড়তে চায় না। তারপরও অস্থিরতা দংশন করে চলে। শেষে ইন্টার্ভিউ বাতিল বা স্থগিত হয় কিনা। দুর্ভাবনায় ডুবতে ডুবতে সে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো ব্যাকুল দৃষ্টিতে কাউকে খুঁজতে থাকে। সামনের পথ আর রেস্তোরাঁয় ফেলে রাখে সতর্ক দৃষ্টি। ইলিয়াছুর কোথায় আছে? এই লোকটির সঙ্গে দেখা হওয়া জরুরি। সে আশ্বাসের কথা শুনিয়েছে তাকে।

এরপর আরও ত্রিশ চল্লিশ মিনিট চলে যায়। আকাশের ঘন ধূসর কালো রূপ হাল্কা হতে শুরু করে। তেমন বৃষ্টি হয় না। লোকজনের আগমনে উপজেলা গম্‌ গম্‌ করে ওঠে। পশ্চিমের অফিস কক্ষ থেকে মোটাসোটা এক মহিলা কর্মী ভবন কাঁপাতে কাঁপাতে নিচে নামে। তখন সিঁড়িতে হাইহিলের খট খট শব্দ খুব বিকট লাগে। হয়তো পিএ গোছের কেউ হবে। তার পেছন দিক ছন্দে ছন্দে বেঢপ কেঁপে উঠছে। হাসান সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। নিজের বিচিত্র এই রূপটি তার কখনো ছিল না। সে চমকে যায়। তবে কি তার মধ্যে মানুষের প্রতি বিতৃষ্ণা জমে উঠতে শুরু করেছে? তৈরি হচ্ছে অসূয়াকাতর কোনো দৃষ্টিভঙ্গি? সে মনে মনে তওবা পড়ে। আসতাগফিরুল্লাহ...।

অবশেষে ইলিয়াছুর আসে। তার চোখ-মুখ বেশ নির্বিকার। আগে যেমন প্রাণচাঞ্চল্য দেখা গিয়েছিল তার ছিটেফোঁটা নেই। হাসানের মনে আকস্মিক কোনো খটকা এসে ভাবনায় হোঁচট তুলে যায়। কোনো সমস্যা হলো নাকি? হয়তো তাই। দু-জনে কাঁঠাল গাছের নিচে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে। হাসান অপেক্ষা করতে থাকে।

‘কখন এসেছিস? নাস্তা?’
‘না খেয়ে বেরিয়েছি। শুধু চা খেতে পারি। তারপর সব ঠিক আছে তো নাকি?’
‘ঠিক বলতে...আচ্ছা বলছি, চা নে।’
‘তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনো ফ্যাঁকড়া হয়েছে!’
‘তাই তো রে ঠিক ধরেছিস, আরে এক ক্যান্ডিডেট নিজেকে সেট করে ফেলেছে। সরকারি পার্টি করে। টাকার জোরও কম না। দু-লাখ ডনেশন দিয়েছে।’
‘তা হলে তো পলিটিক্স না করা ভুল হয়ে গেল। টাকাও তো নেই। কেন যে দরখাস্ত করলাম! তিন শ টাকা ব্যাংক ড্রাফট অহেতুক খরচ।...লোক দেখানো ইন্টার্ভিউ?’
‘ঠিক তাই, এসব হলো ফর্মালিটি। চিন্তা করে দেখ, স্কুলের শিক্ষকতা; সেখানেও এমপি মন্ত্রী নাক গলাচ্ছে। আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।’

ইলিয়াছুর চা শেষ করে পকেট থেকে বাদাম বের করেছে। পট পট করে বাদাম ভাঙল। চোখে-মুখে অস্থিরতা। মনে হয় খুব ব্যস্ত। এরমধ্যে সামান্য জোরে বাতাস বইতে শুরু করে। হয়তো আশেপাশে ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। এদিকেও ছিটেফোঁটা ঝরে পড়ছে। ভেজা ভেজা বাতাস। হাসানের মধ্যে অস্থির অক্ষমতার তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। দু লাখ কেন, সে দশ হাজার টাকা জোগাড় করতে পারবে না। তার চেহারা অসম্ভব গম্ভীর আর বিমর্ষ কালো। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। নিজেকে পুনরায় এ সমাজে অনাবশ্যক অপাংক্তেয় ভেবে হতাশ হয়ে পড়ল। তার কাঁধ ঝুলে গেছে নিচে।

‘তা হলে ইন্টার্ভিউ দিয়ে কী হবে? দেব না? শুধু শুধু প্রস্তুতি নিলাম। বাসভাড়াও খরচ হলো।’
‘দিবি না কেন? এসেছিস যখন ফেঁসো কর। অভিজ্ঞতা হবে। বলা যায় না নম্বরে হয়ে যেতে পারিস।’
‘তুই আবার এসব সাজানো নাটকে অভিনয় করতে বলছিস?’

এতকিছুর পরও নাটকে অভিনয় করতে হলো। ইন্টার্ভিউ বোর্ডে উদ্ভট সব প্রশ্ন আসে। সে নিশ্চিত যে সকল প্রশ্ন করা হলো তার নব্বই শতাংশের উত্তর প্রশ্নকর্তা নিজেই জানে না। সে বেশ মজা করে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দেয়।

‘ডাব না খেলে কী হয়?
‘নারিকেল।’
‘কেন জলশূন্যতা দূর করা যায় না?’
‘সেক্ষেত্রে স্যালাইন নেয়া যেতে পারে।’
‘এক ব্যাগ বাজার আর এক বোতল পানি মিলিয়ে কী হয়?’
‘স্রেফ পাগলামি।’
‘আপনি না হাঁটলে কী করতেন?’
‘দৌড়তাম।’
‘শিক্ষক হলে আপনার প্রথম কাজ?’
‘ছাত্রছাত্রী কালেকশন ও ক্লাস নেয়া।’
‘মাদার মাদার হু কুইন মাউন্টেন ডু। কোন্‌ টেন্‌স?’
‘স্ট্রেঞ্জ টেন্‌স।’


সে যখন ত্রিশ মিনিট পর ইন্টার্ভিউ কক্ষ হতে রাস্তায় বের হয়ে আসে, বেশ ফুরফুরে মেজাজ সেখানেই আছড়ে পড়ে। এতক্ষণ নিজের সঙ্গে পরিহাস ভালোই লাগছিল। আসলে কিছু তো হচ্ছে না। সে ধীরে ধীরে এই ভাবনায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শেষ দুপুরের সূর্য কিছু হেলে পড়েছে। বৃষ্টির পর তার আলোয় সবকিছু চকচকে লাগছে। গাছের ছায়াগুলো দীর্ঘ লম্বা। সে বালুময় মাঠের মধ্যে নিজের ছায়া দেখে। দীর্ঘকায় ন্যুব্জ মানুষের এক আকার। এই কি সেই? ভেঙে পড়া ক্লান্ত শ্লথ ছায়া। কোথায় চলেছে...নাকি পিছিয়ে পড়ছে? তার বুকের ভেতর অদ্ভুত বিষণ্ণ ঢেউ খেলে যায়। কিছু হবে না। সে বিকেলের বাস ধরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সন্ধেয় টিউশানি আছে। মাথা খারাপ করা গবেট এক ছাত্র। তাকে পড়াতে হয়। সক্ষম লোকের সন্তান। এরাই একদিন চাকুরী পাবে। বড় বড় সিদ্ধান্ত নেবে। সে মাঝে মধ্যে পড়াতে পড়াতে ক্লান্ত হয়ে যায়। এই কাজ করতে মন চায় না। কিন্তু উপায় নেই। মাস গেলে কিছু পয়সা মেলে। এখন পয়সা প্রায় শেষ। সে রুপোর বাটি আর সোনার চামচ নিয়ে জন্মায়নি। তার দুর্ভাগ্য। এ সময় চকিতে সুলতানের কথা মনে আসে। কেন জানি মায়া হয়। সেটি নিজের জন্য না কি লোকটির, কে জানে! তার মনে হয় কেউ যদি তাকেও বোধশক্তিহীন পাগল করে দিত! সে আকস্মিক বিদ্যুৎ চমকানো অনুভূতি নিয়ে প্রচণ্ড এক গাল দিয়ে বসে। কেন...কার উদ্দেশ্যে কে জানে! তখন প্রায় নির্জন রাস্তার একপাশে জড়সড় পড়ে থাকা এক নেড়িকুকুর চোখ মেলে তাকায়। পশুটি হয়তো ছাপার অযোগ্য এমন উৎকট গাল কখনো শোনেনি।                      

SHARE THIS

Author: