পাঞ্চালী রাহা ।। অবন্তিকা পাল



বজবজ সংলগ্ন প্রান্তিক বাসস্টপে নেমে দন্তিণদিকের একটা রিকশা নিয়ে আলীর মোড় যাবো বললে রিকশাওলা আপনাকে নামাবে সেখান থেকে শওকত আলীর খাসীর দোকান, একটা নামহীন কামারশালা, একটা জুতা সেলাই পালিশ এবং বকুলের হাতরুটির ছাউনি পেরিয়ে গলিপথে পায়ে হেঁটে আরও সিকি কিলোমিটার গেলে, আমাদের মেস মেস বলতে সুসজ্জিত দোতলা একটি বাড়ী বাইরে থেকে প্রাচীনত্বের ছাপ স্পষ্ট সঙ্গে পারিপাট্যেরও ছোটখাটো বাগান, তাতে মরশুমি ফুল দেবদারু গাছের প্রহরায় মস্ত লোহার গেটের ভেতর ঢুকলে সামান্য শোরগোল কানে আসে, যা এই নিরবচ্ছিন্ন নীরব-যাপনে কিছুটা হলেও উদযাপন সহযোজন করে ফেলে প্রায়শ আমার পছন্দের কারণটা অবশ্য আলাদা মন্ডলকাকু তাঁর খয়েরি ছোপ ছোপ দাঁতগুলো অনেকখানি বার করে বলেছিলেন - তুমি তো আবার গিটার ফিটার বাজিয়ে গান ফান গাও শুনেছি তোমাদের মেসের ছাদ থেকে গঙ্গা দেখা যায় মায়ের মুখ রাখতে একটু পড়াশোনাতও মন দাও

আমার জন্ম যেহেতু তিস্তার খুব কাছে, এবং ছোটবেলার একটা ছোট অংশ যেহেতু জেম্মা আর জেঠাইদের সাথে ফারাক্কায় কেটেছে, তাই নদীর মায়া এখনও আমাকে রাতবিরেতে তাড়া করে বেড়ায় মণ্ডল কাকুর বাটা কোম্পানির সূত্রে পরিচিত স্টাফ অলকেশের শ্বশুর বাড়ি ওই এলাকাতেই ওঁর সাথে গিয়ে দেখে এসেছিলাম প্রথমবার মায়ের নয়, আসলে পিসি দিদার মৃদু আপত্তি ছিল আমাকে দূরে রাখার ব্যাপারে মণ্ডল কাকু ফের দাঁত বার করে বলেছিলেন - তোমার মা মেয়েছেলে মানুষ তার দিবারাত্র চাকরি, টিউশন, সংসার, একাই তো টানছে মেয়েটা পনেরোটা বছর ভসচাজ্জিদা বেঁচে থাকলে কী আর...! আমার মেসে যাওয়ার সাথে বাবার অকালমৃত্যুর কী সম্পর্ক এইটা ভাবতে ভাবতে বইখাতাগুলো এক জায়গায় জড়ো করেছিলাম জামাকাপড় মা ইতিমধ্যেই দুটো কিটস ব্যাগে ভরে রেখে গেছে পিসি দিদাকে মাইনরিটি এলাকার প্রসঙ্গটা আদৌ বলা যাবে না বয়সে মায়ের চেয়ে স্রেফ বছর পঁচিশ বড় হলে এরা আসলেই সেই মানসিকতায় পুষ্ট, যাঁরা আজও বিশ্বাস করেন দেশভাগের জিন্নাহ একাই ছিলেন গলির মধ্যে ঢুকতেই শওকত আলীর অলকেশ বাবুর দিকে হাত তুলে বললেন - সেলাম বাবু

গরীবের রাস্তায় অনেকদিন পর যে! অলকেশ বাবু সংক্ষেপে আমার পরিচয় দিলেম । শওকত আলী খুবই হাসিমুখে বললেন- আরে আরে সেলাম ছোটবাবু । কানও দরকার হলে আলী ভাই রইল । আমাদের গেট খোলার শব্দে এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক দৌড়ে এলেন । দুহাত বুকে এনে অলকেশ বাবুকে নমস্কার জানিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন - আপনি কি পার্থ দা? আমি বেশ হতকচিত । এত সিনিয়র কেউ আমাকে দাদা বলছে ! অলকেশবাবু আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন - এখানকার কর্মচারীরা বোর্ডারদের দাদা বলে থাকে । ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন - কি ফালু, ভাল তো? বৌদির শরীর ভাল? ফালুর গায়ে গোলাপি ফতুয়া আর ঢোলা সাদা পাজামা। গড়নটা বেশ রোগাটেl ঘাড় হেলিয়ে হ্যাঁ-সূচক ভঙ্গী করলেন এই ফালু নামের জনৈক ভদ্রলোক । অ্যাপারেন্টলি দেখে স্বল্পভাষী আর বিনয়ী বলেই মনে হয় । আপাতত আমি একটা রুকস্যাক আর দুটা বড় ব্যাগ এনেছি । পরের উইক এন্ডে বাকি দুটা ব্যাগ নিয়ে আসব, এখন পর্যন্ত এমনটাই পরিকল্পনা । এখনই তো ক্লাস পুরোদমে শুরু হচ্ছে না । রুকস্যাক ছাড়া বাকি দুটো ব্যাগ একপ্রকার জোর করেই ফালুদা নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিলেন। বাড়িটায় ছেলেদের থাকার জন্য মোট ছখানা ঘর। ভেতরে তিন দেওয়াল লাগোয়া তিনটি সিঙ্গেল বেড, খাট সংলগ্ন একটা পুঁচকে আলমারি, আর একটা করে কাঠের টেবিল-চেয়ার। সদর দরজা দিয়ে হলঘর পেরিয়ে সদর দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি বরাবর উঠতে উঠতে এই বাড়ীটার মানচিত্র বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। আমার ঘর তারমানে দোতলায়। করিডোর - প্রতিম বারান্দা দিয়ে তিতিরের চেয়ে ছোট একটা চুড়িদার পরা মেয়ে খপখপ এঁটো থালাগুলো একের পর এক চাপিয়ে নিয়ে এগিয়ে আসছে। শনিবার দুপুর তাই বেশিরভাগ ছেলেই বাড়ি গেছে, নয়তো অফিসে- জানালেন ফালুদা দোতলার প্রান্তিক ঘরের চাবি ঘুরিয়ে ব্যাগ সমেত ঢুকলাম আমরা ডানদিকের বিছানা দেখিয়ে বললেন- এইটা আপনর বেড পার্থ দা এখন আলমারির চাবিটা রাখুন ঘরের ডুপ্লিকেট চাবিটা কাল রাতের মধ্যে পেয়ে যাবেন অলকেশবাবু ঘর ও বারান্দার চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছেন ফালুদার দিকে তাকিয়ে বললেন - বাহ বেশ নিরিবিলি কিন্তু তোমাদের বাড়িখানা হে আগে তো কখনও ভেতরে আসি নিআমরা যখন কলেজে ঢুকেছি, এতো ভাল ভাল সব সিস্টেম ছিলও না। ছাত্রনেতাকে ধরে করে হোস্টেল পেলে ভাল, না পেলে নোংরা মেসবাড়িসে একেবারেই যাচ্ছেতাইযাদের বাপের পয়সা ছিল, ছেলেকে আলাদা বাড়ি ভাড়া করিয়ে রাখতযাক গেআয় পার্থ, নিচে গিয়ে টাকা পয়সা মেটাই। আমায় আবার মেয়েকে নিয়ে বিকেলে নাচের ক্লাসে যেতে হবে। এ মাসের থাকাখাওয়া সমেত তিন হাজার টাকা অ্যাডভানস মা আগেই অ্যাকাউন্ট- ট্রান্সফার করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আজ দুমাসের ডিপোজিট মানি দিতে হবে। মেস ছাড়ার সময় ওটা রিফান্ডেবল। আমি রুকস্যাক থেকে মায়ের খামে গুছিয়ে দেওয়া দশটা পাঁচশ টাকা আর দশটা একশ টাকার নোট বার করে ফালুদার হাতে দিলাম। সদর দরজায় ঢোকার মুখেই একটা পার্টিশন করে টেবিল চেয়ার ও আলমারি পেতে এই চিলতে অফিস ঘরটা বানানো হয়েছে। ফালুদা দুটো আলাদা আলাদা বিল কেটে দিলেন। অলকেশ বাবু বললেন- হারাসনি,ওপরে গিয়ে আলমারিতে তুলে রাখবি, আর ফালুদা জিজ্ঞেস করলেন - অ্যাকাউন্ট কি তুমি দ্যাখো ভায়া? ওই...বৌদি আর এই বয়সে...আমারও তো এখন ষোলো বছর হলও- একই রকম নিরীহ গলায় ফালুদা উত্তর দিলেন। অলকেশবাবু বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন - মা কে ফোন করে দিস কিন্তু।

মার ফোন সেরে তিন নম্বর সিঁড়ির ধাপে পা রেখে মনে হলো, এবার কিছু না খেলেই নয়। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে রওনা দিয়েছি গতকাল রাতে। শিয়ালদায় নেমে অলকেশ বাবুর জন্য স্যান্ডুইচ আর জলভরা সন্দেশ। তারপর ফের লোকাল ট্রেন। মাঝে পেটে পড়েছিল দুটো বিস্কুট আর বার দুয়েকের চা। ফালুদা কে জিজ্ঞেস করলাম সাড়ে তিনটার সময় কিছু পাওয়া যায় কি আর? বলল ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছি মনাকে দিয়ে। তারপর পিছু ডেকেই প্রশ্ন করলেন - পার্থদার কি গিটার বাজানো হয়? হেসে, হ্যাঁ বললাম। পাড়ায় আমাদের চারজনের যে একটা ব্যান্ড আছে তাও। আঠারজন ছেলের মোট তিনটে কমন বাথরুম। এইটা একটু চাপের। তবে সবটাই অভ্যাসের ব্যাপার। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি মনা নামের ওই বাচ্চা মেয়েটা আমার ঘরের সামনে থালা হাতে দাঁড়িয়ে। বললাম - ও কি তুমি টেবিলে রেখে যাও নি কেন? রাশভারী মেজাজে জবাব দিল- ঘরে কেউ না থাকলে ঢোকার নিয়ম নেই। এই লিকলিকে চেহারায় অমন কণ্ঠস্বর শুনে বেজায় হাসি পেয়ে গেল। থালায় ভাত শুক্তো আর আলু পটল। মনাদেবী জানালাম ফালু কাকা বলেছে কাল থেকে মাছ। মনাকে জিজ্ঞেস করলাম এই আমার ঘরে আর কে কে থাকে রে? একই অকটেভে কোনরকম মডুলেশন ছাড়া উত্তর দিলো - সৈকত দাদা, কলেজে পড়ে, বাড়ি গেছে, আর রামকৃষ্ণ দাদা, টিউশন করে, কম্পিউটার শেখে, রাতে আসবে। আমি বললাম - তুই হাসিস না? ইই্‌ বলে দৌড়ে পালালো।

রামকৃষ্ণ দা ন'টা নাগাদ ফিরল। যারা খারাপ ইংরেজি বলে তাদেরই যে কেন কথায় কথায় ফটর ফটর করে ইংরেজি বলা স্বভাব! তুমি তো ভাই একদম ড্যাশিং পুশিং ছেলে! ধুউউউর। মনে হলো, বরং গিটার নিয়ে একবার ছাদে ঘুরে আসি। চারটে লাইন মাথায় ঘুরছে বিকেল থেকে। পুরোটা সুর করা হয়ে গেলে তিতিরকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাব। পাগলীশুনে খুশি হয়ে যাবে। অবশ্য যদি মণ্ডল কাকু সামনে মাধ্যমিক বলে ওর মোবাইলটা কেড়ে না নিয়ে থাকেন। খুসট বুডটা। তোর পথঘাট জুড়ে হ্যালোজেন আর প্রাসাদে নিয়ন আলো/ তবু স্বপ্নেরা নীল স্বপ্নেরা লাল ঝলমলে জমকালো/ আমি এখানে গাইতে এসেছি তোকেই নদী জন্মের গানে / আজ পোড়া এ জীবন খুঁজছে আমায়, আমি জীবনের মানে।

দিন চারেক যেতে না পেতেই দোতলার ঘরের জন্য পাঁচেকের সাথে দিব্যি আলাপ জমে উঠেছে। পাশের ঘরের অনির্বাণ দা খুব মজার। সেও আমার মতই এমবিএ পড়তে কলকাতায় এসেছে। তবে আমার চেয়ে দু'বছরের সিনিয়র। ওর বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুর। অনির্বাণ দার স্টকে দুর্দান্ত সব জোকস- সবিতা ভাবী থেকে সান্তাবান্তা, কী নেই! আশরাফ বিএসসি ফাইনাল ইয়ার। ভীষণ সুইট। সবচেয়ে বড় কথা, আমার গানের একজন পটেনশিয়াল শ্রোতা হয়ে উঠেছে মাত্র কয়েকদিনে। কাল বিকেলে আমার সদ্য বানানো 'হলুদ চিঠি' শোনাচ্ছিলাম। আশরাফের হাততালি আর থামেই না। ও খুব ইংলিশ ব্যান্ড শোনে। ওর কাছ থেকেই কথায় কথায় জানলাম - বৌদি , মানে যিনি এই বাড়ির মালকিন, নিচে একদম পিছনদিকে বড় একটা ঘরে থাকেন। আর্থ্রাইটিস বা ওই জাতীয় কোনও ক্রনিক অসুখ আছে। ফলে বেরোন না। ফাল্গুনির নাম একদা ফালুদা রেখেছিল এই মেসেরই কোন বিচ্ছু বোর্ডার। ফালুদা ছেলেদের সাথে কম কথা বললেও মানুষ ভালো। নির্বিবাদী। ভদ্রলোক তাঁর কলেজ জীবনে এই মেসে এসেছিল। তারপর আর ফিরে যায় নি। সম্ভবত বাবা মা কেউই নেই। বিয়ে তো করেনি বলাই বাহুল্য। নিচের বোর্ডার কিরিটির সাথে ওর বেশ ঘনিষ্ঠতা আছে। সেও এই মেসে বেশ পুরনো, হাইস্কুলের টিচার। যুগলে রোজ রাতে ফালুদার চিলেকোঠার সংসারে বসে গঞ্জিকা সেবন করে থাকে।

শুধু জামাকাপড় আর পুরনো সুর করার খাতাটার জন্য দশ-দশ কুড়ি ঘণ্টার ট্রেন জার্নি ওয়ার্দি হবে বলে মনে হলো না। গুড ফ্রাইডে সমেত পরপর তিনদিনের একটা ছুটি অ্যাভেইল করতে চাইছে। কিন্তু আজকেই জানতে পারলাম শনিবার আমাদের ক্লাস তো আছেই, উপরন্তু প্রতি সোমবার ন'টা থেকে প্র্যাকটিকাল ক্লাস না করলে পরীক্ষায় বসা নিয়ে ঝামেলা করবে। এমতাবস্থায় পিসি দিদার টেলিফোনিক কান্না থামানো ছাড়া আর কোনো গতি নেই। আশ্বস্ত করলাম, খুব শিগগির গরমের ছুটি পড়ে যাবে এই বলে। ও'দিকে বৃহস্পতিবার সকালেই পাথতাড়ি গুটিয়ে সৈকত হাওয়া। রামকৃষ্ণ দা শুনলাম শুক্রবার সকালের ব্যাচ পড়িয়ে ওখান থেকেই সোজা নৈহাটি ফিরবে। অনির্বাণ দা ওকে অলরেডি বার তিনেক জিজ্ঞেস করে ফেলেছে গুড ফ্রাইডে এ বছর কী বারে! বেচারা দুবার উত্তর দিয়েছে। তারপর বকরা বানানো হচ্ছে বুঝতে পেরে এই মারে কি সেই মারে। আমি প্রায় কেউ না থাকার অদ্ভুত ফাঁকা সময়ে একলা ফোকলা গান গেয়ে আর গান শুনে কাটিয়ে দেবো সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশরাফ বনজভি আর কার্পেন্টার্স - এর দুটো সিডি রেখে গেছে। শনিবার আধবেলার ক্লাস সেরে বিকেলে ইন্সটিউটের বন্ধুদের সাথে আরসালানের উপাদেয় বিরিয়ানি সাঁটিয়ে হেলে দুলে মেসে ঢুকলাম সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ। রাতে খাওয়ার খুব একটা স্পৃহা নেই। রাতে মনাকে ডেকে একটা রুটি দিতে বললাম। মনা আসলে বকুলদির পঞ্চম সন্তান। বয়স যখন বারোওর পরে আরও একটা ভাই আছে মনা ক্লাস সিক্সে পাশ করতে পারে নি বলে বকুল-দি আর স্কুলে পাঠায় নি। মেসে রাতের রুটি বকুলদির দোকান থেকে আসে। সোয়া দশটা নাগাদ হাত মুখ ধুয়ে ঘরে এসে গান শুনতে শুনতে ল্যাদ খাবো ভাবছি, হঠাৎ দরজায় টোকা। দেখি ফালুদা। বলল - আপনাকে বৌদি একবার ডেকেছেন। এতো রাতে ? হ্যাঁ । কিছু দরকার আছে বললেন। বেশ, বলো চেঞ্জ করে যাচ্ছি। ফালুদার চোখ একটু লালচে। বোঝাই যাচ্ছে মালকিনের হুকুমে ছিলিম টানতে টানতে উঠে আসতে হয়েছে বেচারা কে। বারমুডা ছেড়ে একটা পাজামা গলালাম। এইসব আমাদের মফঃস্বল সংস্কৃতি। আর মায়ের কড়া শাসন , ইত্যাদি প্রভৃতি। অপরিচিতের সামনে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সর্বত্র আলাদা আলাদা ড্রেস কোড। মেনে চলে ক্ষতি যে বড় একটা হয়েছে, তা কিন্তু নয় আজ মেসে প্রায় কোনো সাড়াশব্দ নেই। বোধ করি পূর্ণিমা পড়ে গেছে। নিচে বারান্দার জানলা দিয়ে মিঠে আলো নেমেছে ফালুদার টেবিলে। দেখি মনা গেট খুলে বেরোচ্ছে। বললাম - বৌদির খাওয়া হয়ে গেছে কিনা জানিস? বলল - জানিনা মা জানে। ঘুষি পাকিয়ে বললাম - দাঁড়া তোকে কালকেই স্কুল পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ইহ্‌ বলে মায়ের দোকানের দিকে চম্পট দিল। বাড়ির এই দিকটায় আমি গত ছ'দিনে একবারও আসিনি। ছেলেদের তিনটে ঘর পেরিয়ে সরু প্যাসেজ হয়ে একদম পেছনের দিকে খুব বড় আরেকটা ঘর। দরজা থেকে শোনা যাচ্ছে ঘরের মধ্যে পুরনো টিকটক ঘড়ির আওয়াজ। পিসি দিদার ঠিক এমনই একটা ঘড়ি আছে। বিয়েতে পাওয়া। আস্তে আস্তে টকা দিতেই, সম্ভবত ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলো কেউ। ঢুকলাম। একি রে বাপ! ঘর যে অন্ধকার। কিন্তু মেসে নতুন, তাই আগ বাড়িয়ে কিছু বলা সমীচীন হবে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। নরম গলায় কেউ বললেন- বসো। আরে বসবো কি! কোথায় বসবো তাই তো দেখতে পাচ্ছি না বাল করে। ক্রমে চোখ সয়ে যেতে বুঝলাম, ঘরে খুব আবছা একটা আলো আছে। শীতাতপ যন্ত্র চললে যেমন নীলচে সবুজ আলো হয়, সেই ধরণের। মিনিট চারেক হয়ে গেছে। কৌতূহল নিয়ন্ত্রণের তো একটা সীমা থাকে। কিন্তু কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না। বৌদি কি তবে কোনো পর্দার আড়ালে থাকেন? আচমকা গালে একটা স্পর্শ অনুভব করলাম। না মোটেই শীতল নয়।  বরং  ট্রেনে ওঠার আগে মা আর পিসি দিদার আড়ালে তিতির যেমন করে ছুঁয়েছিল, অনেকটা সেইরকম। পেলব আর উষ্ণ। আমার রক্তস্রোতের মধ্যে দিয়ে একটা ঠাণ্ডা কিছু ক্রমশ পায়ের দিকে নামছে। চোখ বুজে রইলাম। অর্জুন! এলি তাহলে! আমি বুজে আসা গলায় বলার চেষ্টা করছি-আপনি ভুল করছেন ম্যাডাম। শব্দ খুব একটা বেরোচ্ছে না। গোঙানির মতো শোনাচ্ছে নিজের কানেই। হাতের স্পর্শ এবার ঠোঁটের ওপর। শ-শ-শ। তোকে চিনতে পারবো না আমি। সেই চোখ জোড়া, সেও রোগাটে গড়ন, গলার বাঁদিকে সেই মেটেরঙা তিল। আমাদের তো এক সাথে পালানোর কথা ছিল তাই না অর্জুন! রাহা বাড়ির দমবন্ধ-প্রাচুর্য থেকে আমাকে নিয়ে যাবি বলেছিলি, নদী পেরিয়ে। এই বারো-ষোলোর চৌহদ্দিতে একের পর দালাল আর খদ্দের ঢুকছে। আমি অপেক্ষা করছি অনেকগুলো বছর অর্জুন। কেবলই ভুল হয়ে যাচ্ছে। আ-আমার নাম-পার্থ! সব গল্পের শেষটা তো একরকম হয়না। তুই লিখেছিলি। নন্দিন এলো রাজার গুহায়। এই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা অন্ধকারটুকু সরিয়ে, চাঁদের আলোতেও দিন নেমে এলো বৈ কী!  আমি এখানে গাইতে এসেছি  তোকেই নদী-জন্মের গানে/ আজ পোড়ো এ জীবন খুঁজছে আমায়, আমি জীবনের মানে...

দরজায় প্রচণ্ড দুমদাম শব্দ। বিছানা থেকে নামতে পারছি না। পায়ে বিন্দুমাত্র সাড় নেই। অন্যান্য পেশীগুলোও আড়ষ্ট হয়ে আছে। কোনোক্রমে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দেখি আটত্রিশটা মিসড কল। মা, এয়ারটেল, রামকৃষ্ণ দা, আর অবশ্যই তিতির। সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে দরজা খুললাম। নিচের তলার কিরিটি দা এতক্ষণ  ধাক্কা দিচ্ছিল খুব জোরে। পাশে রামকৃষ্ণ দা, প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লো ঘাড়ের উপর। কী হয়েছিল কী তোমার!  আমি তো ভাবছিলাম পুলিশে খবর দিবো। তারপর ফালুদাকে আস্ক করলাম। কাল খুব ভোরে টিউশন তাই আজ নাইটে মেসে ফিরতে হলো। লাস্ট  ওয়ান আওয়ার দেকেই চলেছি। ফালুদা  অবশ্য বলছিল-বোধ হয় টায়ার্ড, ঘুমোচ্ছে। তুমি নাকি দুপুরে খেতেও ওঠোনি! দেখো ভাই পার্থ, দিনকাল যা পড়েছে। কেস ফেস দিও না। টানা বক্তৃতা দিয়ে দুম করে খাটে বসে পড়লো। আমি বেভুলের মতো দাঁড়িয়ে আছি। বারান্দা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সন্ধ্যে নামছে। রবিবারের সন্ধে। অর্জুন...ফাল্গুনি...কিরিটি...এবং পার্থ...আমার কান্না পাচ্ছে। গা গরম লাগছে একটু একটু। তিতিরকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।

ফালুদা মাথায় হাত দিয়ে, কিছু খান, পাঠাচ্ছি, বলে কিরিটিদার সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। দিন ফুরনোর আগে, হলদেটে বিকেলের আলোয় মুহূর্তের জন্য একবার দেখতে পেলাম, ধূসর কেশ, ফাল্গুনীর  গলার মাঝখানে, সামান্য বাঁদিক ঘেঁষে ,একটা লাল তিল।

SHARE THIS

Author: