বীর মুক্তিযোদ্ধা নুর
হোসেন
হাই কোর্টের রায় প্রাপ্ত
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা
ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নং
৩৯৪৬২১৮,ভারতীয় তালিকা
নং:১৯২৯৬
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের
দুই (০২) তারিখে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হরিনা আর্মি ক্যাম্পে ভর্তি হই। সেখানে
দেড় (১.১/২)মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ১নং সেক্টরের অধীনে ক্যাপ্টেন মাহফুজ,
ক্যাপ্টেন এনাম, ক্যাপ্টেন সামছুল হুদা মেজর রফিকুল ইসলাম এবং
ল্যাপটেন্যান্ট ফারুখ এর নেতৃত্বে যুদ্ধের সবগুলো অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। বাংলাদেশ
ভারত বর্ডারের পাশাপাশি ভারতের সাবরুম বাজার, মনু বাজার ও হরবাতলী এই তিন জায়গায় আমাদের
ক্যাম্প গঠন করা হয়। সেখানে আমরা ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন এনাম, ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা, লেপ্টেন্যান্ট ফারুক, হাবিলদার মেজর নুরুল আলম, সুবেদার হাফিজ ও হাবিলদার সেরে বিল্লাল সহ এদের
নেতৃত্বে আমরিঘাট, আন্দার মানিক,
বাগান বাজার, হলদিয়া ডেবা, ছিকনছরা, রামগড়, তবলছড়ি, বিলাইছড়ি,
কালাপানিং, ফংবাড়ি, চামলাইশ্যা, কইলা, কাঠাঁলছড়ি, ও চা বাগান সহ
বিভিন্ন জায়গায় পাকবাহিনীর সাথ সম্মুখ যুদ্ধ করি। প্রায় সময় আমার নিজ নেতৃত্বে
অপারেশন হতো। আমরা আমাদের ক্যাম্প হতে সন্ধ্যায় ৫টা-৬টা এবং বেশির ভাগ সময় ভোর ৩টা
-৪টায় শত্রুপক্ষকে তছনছ করে দিতাম। পরে সিভিলিয়ানদের কাছে জানতে পারতাম যে এতে
অনেক পাকবাহিনী নিহত ও আহত হয়েছে এবং আরো বিভিন্নভাবে খবর পেতাম যে, রাজাকার আলবদর, আলশামস, মুজাহিদরা হানাদার বাহিনীর কাছে বিভিন্নভাবে
তুলে দিত আমাদের মা- বোনদেরকে। কোন অপারেশনের পূর্বে আমরা যখন পাঞ্জাবীদের অবস্থান
সনাক্ত করতে ১০-১১ টার দিকে সিভিলিয়ান সেজে রেকি করতে যেতাম তখন দেখতাম স্কুল কলেজ
পড়ুয়া ঐ ধরনের মেয়েদেরকে শুধুমাত্র আন্ডার ওয়ার পরিয়ে গোসল করাতে নিয়ে আসত। এই রকম
আরো অনেক ঘটনা আছে যা বলে প্রকাশ করার মতো নয়। ঐ রাতে আমরা পাকবাহিনীর উপর
ত্রিমুখী হামলা চালাইল তখন অনেক পাকবাহিনী আহত ও নিহত হয়। অনেক সময় আমরা কিছুটা
দূরত্ব বজায় রেখে এম্বুসে থাকতাম। পাকবাহিনী যখন আমাদের জায়গায় উপস্থিত হত তখন
আমরা একদিক থেকে হামলা চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিতাম। সেখানে তাদের অনেক সৈন্য নিহত
হতো। যুদ্ধকালীন সময়ে হাবিলদার সেরে (বিল্লারের) নেতৃত্বে আন্দার মানিক স্থানে
একটি এ্যাম্বুস বানাই। সেখানেও পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয় এবং ৭ জন পাঞ্জাবী
নিহত হয়। এর কয়েকদিন পর আমরা সেখানে আবার এ্যাম্বুস বসাই। তখন ঐ এ্যাম্বুসের
কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন হাবিলদার মেজর মজিবর। কিন্তু ঘটনা চক্রে হাবিলদার মেজর
মজিবর সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তখন সেখানে আমরা নিজ নেতৃত্বে যুদ্ধ হয়। ঐ ঘটনার
কারণে কিছুদিন পর ক্যাপ্টেন শামশুল হুদা শহীদ হন। আমরি ঘাট নামক স্থানে আমরা একটি
এ্যাম্বুস বসাই। সেখানে কয়েকজন পাঞ্জাবী নিহত হয়। সেখান থেকে একজন পাঞ্জাবীকে মৃত
অবস্থায় মুনবাজার ক্যাম্পে আনা হয়। এভাবে এ্যাম্বুসে অনেক জায়গায় পাঞ্জাবীদেরকে
মারা হয়। একদিন ক্যাপ্টেন মাহফুজ আমাদেরকে ডেকে বললেন যে, ছিকন ছড়ায় যদি কোন এ্যাম্বুস বসানো হয় তাহলে
আমাদের কোন জওয়ান ঐখান থেকে ফিরে আসতে পারবেনা। কারণ নকশা অনুযায়ী ঐ জায়গাটা ছিল
খুবই বিপদজনক। তখন লেঃ ফারুক সুবেদার হাফেজ সাহেবকে বললেন, ঐ ছিকন ছড়ায় আমার জওয়ানেরা এ্যাম্বুস বসাবে।
কিন্তু সুবেদার হাফেজ সাহেব তাহা প্রত্যাখ্যান করলেন। প্রত্যাখ্যানের পর লেঃ ফারুক
তাহা মানলেন না। তখন লেঃ ফারুকের নির্দেশে আমি হাবিলদার মেজর নুরুল আলমকে ডেকে
আনলাম। অবশেষে হাবিলদার মেজর নুরুল আলম তার প্রস্তাব মানলেন। তখন আমরা বিকাল ৫টার
দিকে ছিকন ছরার দিকে রওনা হলাম এবং খুবই গোপনে ও সতর্কভাবে এ্যাম্বুস বসাইলাম।
আমাদের সাথে দুইজন সিভিলিয়ান ছিল। তারা আমাদেরকে পথ দেখিয়ে দিত। আমরা যে রাস্তা
দিয়ে প্রবেশ করেছিলাম ঐ রাস্তায় আমাদের পায়ের চিহ্ন দেখে হানাদার বাহিনীরা আমাদের
ঘেরাও করে ফেলে। কিন্তু সেটা আমরা জানতাম না। যখন আমাদের উপর ত্রিমুখী হামলা শুরু
হয় আমরা নিরুপায় হইয়া এ্যাম্বুস রাখিয়া একটি খামার বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। তখনও
ত্রিমুখী হামলা চলছিল। তখন বুঝতে পারি যে, পাকবাহিনী আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। সেই দিন আমার সাথে হাবিলদার মেজর নুরুল আলম,
আবুল মনসুর, আজিজুল হক বামনসুন্দরের বেলায়েত সহ আরো ১১ জন
যোদ্ধা ছিল।
আমরা তখন বাঁচার কৌশল
অবলম্বন করি। পাকবাহিনী যে পাহাড়ের যে ক্যাম্পে ছিল আমরা ঐ পাহাড়ের গোঁড়ায় আশ্রয়
নিলাম। সেখানে দু’রাত একদিন
পাকিস্তানিদের ঘেরাওদের ছিলাম। সারাদিন সেই স্থানে থেকে রাত্রে ঐ জায়গায় জলিল
নামের একজন লোক আসিয়া আমাদেরকে রাত্রের অন্ধকারে পথদেখাইয়া দেন এবং ভারতের মনু
বাজার ক্যাম্পে পৌছাঁইয়া দেন। এর কয়েকদিন পর আমাদেরকে ভারত থেকে বাংলাদেশে
প্রবেশের স্বীকৃতি দেয়। তখন আমরা বাজারে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে বাংলাদেশ
প্রবেশ করি এবং বাংলাদেশের শুভপুর ব্রিজ, ছিনকি আস্তানা, জোরারগঞ্জ,
মিরসরাই সহ বিভিন্ন
জায়গায় অবস্থান করি।
বাঁশবাড়িয়া হইতে কুমিরা
ঘাঁটঘর ও কুমিরা টিবি হাসপাতাল এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে আমাদের মুখোমুখি শেষ হয়
যুদ্ধ হয়। সেই ১৪ই ডিসেম্বর। আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে হয়ে বাংলাদেশ আক্রমণের
লক্ষ্যে তাদের সপ্তম নৌবহর নিয়ে বাংলাদেশের একটি সাগরে (যেটাকে আমরা বার সাগর
বলতাম) অবস্থান নেয়। ঠিক ঐদিনই রাশিয়া তাদের অষ্টম নৌবহর নিয়ে সেখানে আসে। ফলে
আমেরিকা আক্রমণ না করে ফিরে যায়। আর যদি রাশিয়া তাদের অষ্টম নৌবহর নিয়ে না আসত
তাহলে আমেরিকা বাংলাদেশের উপর আক্রমণ চালিয়ে যেত। সেই দিন পাক বাহিনীর সাথে আমাদের
বিমান হামলা, ট্যাংক হামলা সহ
তুমুল যুদ্ধ হয়। সেইদিন আমাদের প্রায় ১৫০-২০০ গজ পিছনে থাকা মিত্র বাহিনীর ১৫০-২০০
সৈন্য নিহত হয়। এটি ছিল আমাদের স্মরণীয় যুদ্ধ। সেদিন আমিও মারাত্মক ভাবে আহত হই
এবং আমাদের অনেক সৈন্যও আহত-নিহত হয়। সেদিন আমাদের ২(দুই) জন সৈন্যও শহীদ হন।একজন
শহীদ কামাল অন্য শহীদ আবুল কালাম। তার দুইদিন পর অর্থাৎ ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী
হানাদার বাহিনী আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
সাব সেক্টর-৩ এর
ক্যাপ্টেন এনাম, ক্যাপ্টেন মাহফুজ,
ক্যাপ্টেন শাসসুল হুদা ও
ল্যাপ্টেন্যান্ট ফারুখ এদের কমান্ডে মুনবাজার ক্যাম্প, হরবাতলী ও সাবরুম বাজার (চার বাগান) ক্যাম্পে
ছিলাম। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসনেও সাব সেক্টর-৩ এ মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্বে
ছিলেন।
যুদ্ধের ৪০ বছর পর এখন
অনেক ঘটনাই মনে নেই, যা আছে তা লিখেও
শেষ করা যাবে না।
বিভিন্ন তালিকায় আমার
নম্বর গুলো দেওয়া হলোঃ মুক্তিবার্তা নং- ০২০৩০৪১০৭৯, গেজেট নং- ৪৬৩৪, ভারতীয় তালিকা নং- ১৯২৯৬, ই-বি নং- ২১৮, যুদ্ধকালীন ক্রমিক নং- ১০৭১, ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নং- ৩৯৪৬২১৮, সেনা গেজেট নং- ১৩৯৪১, যুদ্ধাহত গেজেট নং- ২২৯৫।