সময়ের প্রয়োজনে
যারা এতোকাল মিছিলের তামাসা দেখে
মুখ ঢেকে হেসেছে, তারাই ডাকবে মিছিল রাজপথে।
ভাবতে অবাক লাগেÑ
আকাশের রোদ্দুর দেখে যারা কস্মিনকালেও
ছাতাবিহীন বাড়ায় না পা রাস্তায়
জানালায় বৃষ্টির ঝাট দেখে কাঁশে খকখক
নাক ঘষে রুমালে, তারা দেবে নদী পাড়ি।
লঞ্চে বা স্টিমারে নয়, পালতোলা নৌকোতে নয়
গুপ্তচরের মতো একেবারে খাঁসা ডুবসাঁতারে।
আপেল কাটতে গিয়ে যাদের
হৃৎকম্পন বেড়ে যায়, হাত ফসকে পড়ে যায় চাকু
সময়ের প্রয়োজনে তারাই নেবে তুলে সুতীক্ষ্ম
দক্ষতায়
গ্রেনেডের মতো মারাত্মক মারণাস্ত্র গুলো।
যারা মাছ খেতে গিয়ে
কাঁটা দেখে হাপিয়ে ওঠে, পিতার আঙুল না ধরে
স্কুলে যেতে পায় ভয়, মায়ের আঁচল ছেড়ে একাকী ঘুমোতে
শঙ্কিত, তারা কাটিয়ে দেবে রাতের পর রাত নিঃসঙ্গ
বনজঙ্গলে
অনাহারে-অর্ধাহারে কাঁধে রাইফেল আর চৌদিকে
অতন্দ্র দৃষ্টি রেখে।
কেন না, তাদের স্বদেশ এখন
অজস্র মানুষরূপি হায়েনার হাতে জব্দ
কেন না, তাদের মায়ের মুখের হাসি এখন
বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে
কেননা, তাদের বোনের অশ্রু এখন
নরসুন্দার জলের মতো সহজলভ্য, আর তাদের বাবার
মসজিদে যাবার রাস্তায় কাঁটাগুল্মের ঝোপ
নির্বিঘেœ উঠেছে বেড়ে।
রক্তফিনকীস্নাত সবুজ জামা
ভালবাসার জন্য মানুষ কী না পারেÑ
কী না
পারে বলুন?
সাত সাগর তেরো নদী পার!
হোহ... সে তো
সামান্য, ফুলের রেণুর মতো যৎসামান্য।
হানাদার বাহিনীর হাতে
ধরা পড়েছিল একজন
সোনার মানুষ, মুক্তিকামি সোনার মানুষ।
শত অত্যাচার, তবু
মুখ খুললো না সাহসী সে তরুণ।
যদিও বেয়নেটের খোঁচা
লাগছিল উরুতে, বুকে স্টেনগান ধরা
মুখের উপর কটু প্রশ্নÑ
‘আমাদের জিজ্ঞাসার
জবাব চাই, অগত্যা গুলি করে মারবো তোমায়।’
চূড়ান্ত নির্ভীক বলে, বুকভরা
খাসা দেশপ্রীতি ছিল বলে
নিচু হয়ে চুমু খেল
স্বদেশের মাটিকে, প্রেয়সীর গালে শেষ চুম্বনের মতো।
তারপর উঠে দাঁড়ালে
সটান, ঝাকড়া চুলের বাবরি নাড়িয়ে বল্লে
‘যথেষ্ট প্রস্তুত আছি, আমার রক্ত
প্রিয় দেশটাকে দেবে স্বাধীনতা’।
বাতাসের কলরব
থামলো হঠাৎ। ছিঁড়ে গেল মালার আদলে ওড়া
পাখিদের ঝাঁক; ভিজে গেল ঘাস, শ্যামল মাটি।
ভেজা পতাকার মতো
রক্তফিনকীস্নাত সবুজ জামা, আর
নক্ষত্ররূপী জ্বলজ্বলে জামার বোতাম।
ঘাতক সংহরণ
ভষ্মচাপা অগ্নি না হই, পাথর চাপা
দূর্বা চাই না
পথের কুকুর হতেও রাজি, বুক পেতে লই
বুটের লাথি
তবু আমি করুণা চাই না।
ঘাতক আমায় করুণা দেখায়, ভাবতে গেলেই
বমি আসে।
গাল পেতেছি, জুতোর বাড়ি, মুখে আমার
ছেটাও থুথু
ফাঁসির দড়ি ঝুলাও যদি, গলায় বেঁধে
মৃত্যু নেবো
তবু তোমার ক্ষমা চাই না।
ঘাতক আমায় করবে ক্ষমা, হাসবো বলে
দাঁত মেজেছি।
ছড়িয়ে দাও কাঁচের কুচি, নগ্ন পায়ে
হাঁটবো তাতে
কাঁটাতারে বিদ্ধ হয়ে থাকতে রাজি
উলটো ঝুলে
তবু মাথা নত আর করি না।
ঘাতক আমায় মুক্তি দেবে, নাক ঝাড়তে
রুমাল খুঁজি।
ফুলের বাগান গুড়িয়ে দাও, ছিনিয়ে নাও
গায়ের জামা
থালার অন্ন লুটতে পারো, বাঁচতে চাটবো
রূক্ষ ধুলো
তবু পায়ে পড়ে আর কাঁদি না।
ঘাতক আমায় করবে দয়া, আশা করাই
ভীষণ ফাঁকি।
প্রশ্ন যুগোপৎ
ঃ কেন ডেকেছো আমায় বলো?
দাঁত ব্রাশ করবে, আমপাতা পাড়া চাই? অথবা নিমের সরুডালÑ
দিতে হবে যুগোপৎ মেসওয়াক বানিয়ে?
ঃ না।
ঃ একেবারে মগডালে পেকে আছে
বুনো-টক কুল, ডাল ধরে নাড়া দেবো স্বশক্তি হাতে? কঞ্চিবাঁশের
চিমটি দিয়ে আমলকী কামরাঙা, শাখায় চড়ে
পাকা জলপাই দিতে হবে পেড়ে? কাঁটার আঘাত উপেক্ষা করে
রক্তিম গোলাপ, কাকডাকা প্রভাতের শিউলি-বকুল?
ঃ আরে... না... না!
ঃ তবে কেন, তবে কেন ডেকেছো আমায়?
ঃ বন্দুক কাধে যখন ঘুরে বেড়াও বনজঙ্গলে,
রাজপথে
মিছিল ডাকো মুষ্ঠিবদ্ধ হাত, ফাটাও গ্রেনেড লুণ্ঠক শাসকের
লুণ্ঠিত পণ্যসমেত ট্রাকে,
অরাজক স্বৈরাচারীর মাথা মাড়িয়ে দিতে
হয়ে ওঠো মড়িয়া, অন্ন-বস্ত্র কাঁধে ছুটে চলো শরণার্থীশিবিরেÑ
তখন আমারে তোমার মনে কি পড়ে?
অনন্তকাল দহন
ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
- অনন্তকাল।
বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
-অনন্তকাল।
তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
-অনন্তকাল।
তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
-অনন্তকাল।
লাভলী বুবু
সংসার-সুখ সইল না
লাভলী বুবুর কপালে। স্বামী তাকে
দিয়েছে তালাক, ফিরে এল পিতৃগৃহে জীবনের বাকী কটা দিন
শুভ্র পোশাকে কাটাতে, ডানা কাটা পাখির মতন
চির বন্দিনী গৃহ-পিঞ্জিরায়।
যখন ছিল ছোট মেয়ে, পড়তো শিশুস্কুলে
ঘুড়ি উড়ানো লাটাই এর মাঞ্জা দেওয়া সূতো,
বাঁধতো তা দিয়ে
গঙ্গাফড়িং এর লেজ। যতক্ষণ ফড়িং এর দেহে আছে
প্রাণ
এ বাধন ততক্ষণ হতো না তো খোলা।
কলাগাছ কেটে এনেÑ
তুলে ছেটখোল, পুকুরের তরতাজা চারপেয়ে ব্যাঙ
ঠ্যাং তার বেঁধে রাখতো চুবিয়ে কলের নালায়।
দেহান্তর
ছিল একমাত্র মুক্তির পথ, অনন্যোপায়।
ঠাট্টা করে বলতেন মেজোকাকীÑ‘ব্যাঙ বেঁধে কাজ নেই
নিজের স্বামীটিরে বেঁধো শক্ত শিকলে
যেন ওই ফড়িং এর মতো মরে গেলেও দিতে না হয় ছেড়ে।’
কাজ ছিল আরও একটা, প্রজাপতি ধরা। কেটে নিয়ে
ডানা দুটি বইয়ের পাতার ভাঁজে সংরক্ষণ।
মা বলতেন রাগ করেÑ ‘প্রজাপতির অভিশাপ
দেখিস সুখ তোর সইবে না কপালে।’
জানি না তো অভিশাপ
কার ছিল এতো নিষ্ঠুর, কেন শাড়ির আঁচল দুর্বল অপদার্থ
ফড়িং-বাঁধা মাঞ্জা সুতোর তুলনায়। কেন ছেটখোল
ছিঁড়ল না
তবু গীট গেল খুলে, মরণের পরে নয়
জীবিতকালেই।
ইটচাপা হলুদ ঘাসেরা
বাঁশবনে গুই সাপের হাঁ-করা মুখ দেখে অকস্মাৎ
যারা দেয় আপ্রাণ দৌড়
আমি তাদের শঙ্কাচ্ছন্নতায় মুচকি হাসি। সন্ধ্যার
অশ্বত্থ শাঁখে
নাকী সুর শুনে জুতো খুলে ছুঁড়েছিলাম ঢিল
শাঁখচুন্নিদেরÑ সেই সুবাদে খোয়া
গেছে
বাঁ পায়ের একপাটি নাগড়া চটি। যাক, দুঃখ নেই তাতে।
একটা সময় ছিলÑ
গোরস্তানের মাঠে ঝুঁকে থাকা তাল গাছটায়
পারিনি চড়তে কিছুতেই
অথচ এখন তরতর উঠে যাই
দেবদারুর চূড়ায় তোয়াক্কা না করে বিষ পিঁপড়ের
কামড়। সময়
মানুষকে করতে শেখায় সব।
আকাশে উড়ছে শকুন
বাতাস দ্বিখ-কর চিৎকারে। ওরা মৃত্যু ভালবাসে
এবং চায় ভেজাতে চঞ্চু জীবন্তের রক্তে। আমাদের
চৌদিকে
গাঢ় আগুনের আঁচ, বরফে মশাল
জ্বলছে ভীষণ দাউ দাউ।
আমার কণ্ঠে তাই বজ্রপাতের মতো
তুমুল হুংকার, হাতের পতাকা যেন জ্বলে ওঠা বাতিস্তম্ভ।
আমাদের মুমূর্ষু মানুষগুলো
জলে ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ আঁকড়ে ধরে তৃণ উঠে
বসবেই
একদিন, আর আমি বলে রাখিÑইট চাপা হলুদ
ঘাসেরা
ইট ঠেলে নিশ্চিত মাথা তুলবেই আকাশে।
ভিনদেশে বিপর্যস্ত
মা আমাকে তার মাতৃসুলভ আচরণে
স্নেহের হাতে তুলে খাইয়ে দিতে চাইতো, আমি দেইনি সম্মতি কখনো
তার বুড়ো আঙুলের নখটা কেমন মড়া ঝিনুকের
ফ্যাকসা খোলসের মতো ছিল বলে।
শৈশবে স্কুলে পৌঁছবার রাজপথে
যেদিন প্রথম দেখেছিলাম শিয়ালের থেতলানো দেহ
টানা তিনরাত ঘুমোতে পারিনি দুঃস্বপ্ন দেখার ভয়ে,
পারিনি করতে
আহার স্বাভাবিক। চোখের সামনে শুধু উঠতো ভেসে
বিচ্ছিন্ন মস্তক একটা মরা শিয়াল যার উসকোখুসকো
চামড়ায়
জমে আছে রক্তের স্তূপ আর তকতকে নীল মাছি।
খুব বেশি খুতখুতে
স্বভাব ছিল আমার। বাবা একবার আমার গামছা দিয়ে
মুছে ছিলেন তার শস্যক্ষেত থেকে ফিরে আসা
ঘর্মাক্ত পিঠ,
সেই অপরাধে তার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার
করে দিয়েছিলাম মূর্খের অপবাদ দিয়ে। এক বিছানায়
ঘুমোতে গিয়ে
আমার যে ছোটভাইটা গায়ের উপর তুলে দিতো পা
আমি এক চড়ে তার কান থেকে রক্ত ঝরিয়ে
বুঝিয়েছিলাম
ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে যাওয়ার খেসারত।
এখন আমার ঘুম আসে না, ঘুম আসে না রাতে
ছাড়পোকা আর মশাদের উৎপাতে। উৎকট গন্ধে
বন্ধ দম, শৌচাগারের পাশে বিছানায় নেই গা ঢাকা দেবার মতো
টুকরো কাপড়। শীতে জুবুথুবু হয়ে যখন কুকড়ে যাই
তোকে বড়ো মনে পড়ে, তোকে বড়ো মনে পড়ে ভাইরে। ঘুমঘোরে একটি পা
গায়ের উপরে তুলে দিবি না আমায়
একটু আরাম উত্তাপ? বল, তুই করবি না
ক্ষমা আমায়...?
ওরা যখন আমাকে নিয়ে এসেছিল ভিনদেশে
বলেছিল কাজ দেবে পাঁচতারা হোটেলে, নিদেনপক্ষে মুদির দোকান তো
জুটবেই কপালে। সূর্য ওঠার আগে
শাবল ক্ষন্তা আঁকশি হাতে লেগে যাই কাজে,
নগরের নর্দমা
শোধন এখন আমার কাজ।
যে হাতে ধরিনি গরুর দড়ি গোবর চনার গন্ধ লাগবে
বলে
সে হাত ধরে পঁচা ইদুরের লেজ, পলিথিনে মোড়া
মাছি ভনভন করা মাছের পুরনো আঁশ। পরিত্যক্ত
আবর্জনা
তুলে নিই পিঠের ঝুলিতে। বড়ো অসহায়, বড়ো অসহায় লাগে মা,
মনে হয় মরে যাই; না গেলে কাজে নিতান্ত বুভূক্ষু
কাটে দিন, পানিটাও এইদেশে কিনে খেতে হয়, টাকা ছাড়া জোটে না
কান চুলকানোর কাঠিটি পর্যন্ত।
একবার, শুধু একবার, মা তোমার গোবর
গুলে গৈঠা বানানো হাতে
একমুঠো ভাত খাইয়ে দিয়ে যাও।
বাবা, ও বাবা, আমার গায়ের
সবচেয়ে সুন্দর যে জামাটি
তাতে মোছো তোমার ভাত খেয়ে না ধোয়া হাত। তোমার
সফেদ দাড়ির ভাজে
তরকারির যে ঝোল লেগে থাকে
সেই ময়লাটি জিহ্বায় চেটে তুলে নিতে বড়ো ইচ্ছা
জাগে আমার।
অহিংসোক
জাহাজডোবা নাবিকের মতো বিধ্বস্ত, কম্পিত পা
দাঁড়িয়েছি তোমার সামনে। বুভূক্ষু এক ভিখারীর
সুরে বলেছিÑ
‘তোমার অনেক ডাঙা, আমায় একটু আশ্রয় দেবে?’
জবাব দিলে
‘দুনিয়াতে লোক তো অনেক আছে, ওদের কাছে যাও।’
মরু সাহারার তৃষিত বেদুঈন, আঁজলা করে হাতের তালু
বসেছি তোমার সামনে। যেন সিদ্ধিলভিতে দেবীর পায়ে
প্রণাম
‘তোমার রঙিন ফোয়ারা, আমায় একঢোক জল দেবে?’
জবাব দিলে
‘দুনিয়াতে লোক তো অনেক আছে, ওদের কাছে যাও।’
যুদ্ধাহত যোদ্ধার মতো ক্লান্ত এবং আধবুজা চোখ
হাটু গেড়েছি তোমার সামনে। কপাল ফাটা কয়েদির
কণ্ঠে বলেছি
‘তোমার সুতি আচল, আমার মাথায় পট্টি দেবে?’
জবাব দিলে
‘দুনিয়াতে লোক তো অনেক আছে, ওদের কাছে যাও।’
বনপোড়া হরিণীর মতো নিরুপায়, শঙ্কিত মুখ
দাঁড়ালে আমার সামনে। নির্যাতিত অসহায় সুরে বললে
‘আমার অনেক বিপদ, আমায় তুমি বাঁচাও।’
আমি তখন পারিনি বলতে
‘দুনিয়াতে লোক তো অনেক আছে, ওদের কাছে যাও।’
চোখের বদলা চোখ যদি হয় আমরা তবে অন্ধ
হয়ে যাবো
পায়ের বদলা পা যদি হয়Ñআমরা তবে পঙ্গু হয়ে যাবো।
ইতিহাসের আঙুল বাংলার নাম লেখে
বাড়ির মানুষ কোথায় উধাও, বিজন হাহাকার...!
কাঠের দরজা খোলা, হাওয়ার তোড়ে
ঠুকছে মাথা পাল্লাগুলো তার।
রক্তমাখা মেঝে, বুলেট বোমার ঘোরে
আছড়ে পড়ছে দশটি দিকে দীর্ঘশ্বাস কার...?
শোষণক্লিষ্ট দেশটা যখন স্বাধীন হতে শেখে
মদ্যমাতাল টলিত পায়ে এখানে যেই থামা
আঁতকে উঠি বক্ষ আমার বুলেটবিদ্ধ দেখে।
রক্তফিনকী গড়িয়ে এসে ভিজিয়ে দিলো জামা
ইতিহাসের আঙুল তখন বাংলার নাম লেখে।
ত্রিদীপ
এক.
বুকের ভেতর প্রজ্জ্বলিত বারুদের ক্ষোভ, আগুন যদি না জ্বলে
তবে নিজেকে পুড়িয়ে যোগাবো আলো।
জীবনকে ঢেলে সাজাবার ডাক দিয়ে যাইÑ
‘পথ নাই আর পথ নাই
অন্ধকারে অগ্নীশিখা জ্বেলে দূর করতেই হবে কালো।’
দুই.
দুর্ভিক্ষের আঁচড় লেগেছে যাদের গায়, তারা কি তবে
নিঃসম্বল হয়েই মরবে সবে....?
ক্ষুধার্তের বোবা কান্না আর বঞ্চনার দীর্ঘশ্বাস
শুনেও
ত্রিদীপ হাতে ক্রুদ্ধ দেবতা দেবালয়ে নিরব
দাঁড়িয়ে রবে...!!
তিন.
জালিমের দল ছাউনী গেড়েছে আমাদের অঙ্গনে
প্রদীপের মতো উপকারী আলো বিলাবার দিন আর নয়...
বারুদোত্তাপে জ্বলে উঠবার এসেছে কঠিন সময়।
ব্যর্থ ডুবুরী
চেয়েছিলাম একটি বেগুনী ফুল, তুমি এনে দিলে ঝুলবারান্দায়
ঝুলিয়ে রাখার মতো দুটো অর্কিড-চারা নারকেলের
খয়েরী মালায়।
সকাল বিকাল আমি জল ঢালি খুব যতনেÑ আর তুমি
অফিসে যাবার আগে একবার পাতায় পাতায়
বুলিয়ে যাও হাত, ফিরে এসে আরবার ধরো। যেন পিতা
তার চঞ্চল কন্যার ববকাট চুলে স্নেহের আঙুল
চালায়।
যেদিন ফুটলো প্রথম ফুল তুমিই খুশি
হলে সবচেয়ে বেশি।
আমাকে একেবারে কোলবালিশের মতো আড়কোলে তোলে
কপালে খেলে খপাৎ খপাৎ চুমু, আর বার বার তাকালে
হালকা হাওয়ায় কাঁপা প্রজাপতির পাখার মতো
ছিটছিট অর্কিড পাপড়িগুলোর দিকে।
আমি তো জানি কতো যে ভালো তুমি বাসো আমায়। তাই
আমার
একাকীত্ব কাটিয়ে দিতে দিলে উপহার
খরগোশ একজোড়া, একটি ধবধবে সাদা
অন্যটি সাদায় কালোয় মিশ্রিত
যাদের লালন করি আমি আপন শিশুর মতো
গালে গাল মিশিয়ে যেন আমিই তাদের মা। মুখে তুলে দেই কতো
চাকচাক করে কাটা গাজরের ফালি, বাধাকপির কচি সবুজ পাতা।
আমার কোন আবদার রাখেনি অপূর্ণ তুমি। আমিই কেবল
পারিনি...
মনে কি পড়ে... চেয়েছিলাম
পদ্মার ইলিশ-সর্ষে ভাজি? তুমি আমাকেই নিয়ে গেলে পদ্মায়
জোয়ারের বেলা জেলেদের নৌকায়
উঠে নিজের হাতে ধরলে ইলিশ। যে ইলিশ ভেজেছি
পহেলা বৈশাখে উত্তপ্ত উনুনের পাশে দাঁড়িয়ে আর
আঁচলে মুছেছি
গলার ভাঁজে জমা রূপালি মালার মতো ঘাম। তখন তুমি
কোমর জড়িয়ে ধরে কামড়ে দিলে কান, আর হাতের আঙুলে
এক চিমটি সর্ষে ইলিশ মুখে নিয়ে বললেÑ
‘বড়ো মধুর হয়েছে আমার
রাধুনীর রান্না।’Ñমনে কি পড়ে? মনে কি পড়ে?
অথচ আমি বারোটি বছর ধরে
তোমাকে প্রতিদান কিছু দেবো বলে কতো যে চাই যেমন একটি সন্তান,
তবু পারি না দিতে। হাজার হাজার মাইল সাঁতরে এসে
আমি যেন
অতলান্তিক সমুদ্রপুরী থেকে শূন্য হাতে উঠে আসা
ব্যর্থ ডুবুরী কোন।
তুমি যখন আমাকে খুব খুব খুব বেশি ভালোবাসো...
ব্যর্থতার গ্লানী আর অপারগ অপরাধের ভার
বুকে নিয়ে গলায় কলস বেধে ডুবে মরতে ইচ্ছে করে
আমার।
বাতায়নে একজন বসে
দিগন্তে ঝরোঝরো বৃষ্টির জলকণা
আকাশের চোখ ফেটে ঝরে অবিরাম
ইলেকট্রিকের ব্যাপ্তদুরন্তর তারে ভেজা কাক
সারি সারি ঘর বাড়ি জব্দ, বন্দি মাঠঘাট
বাতায়নে একজন বসেÑ দীঘল চুল ভিজে জমাট।
মেঘের স্তম্ভ যেন দাম্ভিক মোষের পাল
বারংবার করে খেলা বিদ্যুল্লতা স্বরব
শহরের চৌদিকে বইছে ধরণীর দীর্ঘশ্বাস
বর্ষামুখর সঙ্গীত সাঙ্গ ক্যাসেট প্লেয়ারে
বাতায়নে একজন বসে বিশুষ্ক একা ঘরে।
কেউ কি দাঁড়ালো দ্বারে ধূসর বর্ষাতি গায়ে
ভেজা পথ হেঁটে কালো চোখে তাকালো পথিক
হৃদয়ে যক্ষের নিবেদন, কবেকার হাহাকার
বৃষ্টির অগণিত নখ, গাঢ় অন্ধকার দিন
বাতায়নে একজন বসেÑ অপার উদাসীন।
এমন দ্বিপ্রহরে কোথাও যাবার নেই সাধ
ব্যাঙের কোরাস বাজে বেহালার সুর সম
অন্ধকার নেমে আসে আরও ঘোরতর হয়ে
যূথীর বিধুর গন্ধ বাতাসকে ভারী করে
বাতায়নে একজন বসেÑ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে।
শেষ সাধ
বড়ো সাধ ছিলো একবার জীবনে শুধু একবার
আমার স্বজনদের লাগি আমার স্বদেশের লাগি
উজ্জ্বল কিছু একটা যাবো করে। দিবা-নিশি বহুবার
ভেবে ভেবে ঘুমের মাঝে শ্বাসরুদ্ধ উঠেছি জাগি
দুঃস্বপ্ন দেখার মতো। তারপর মনে হলো
আমার জীবন গেছে চলে, হলো না কিছুই করা
আমার স্বজন আমার স্বদেশ আমারে বেসেছে ভালো
প্রতিদানে তার দেইনি কিছুই পায়নি কিছুই
বসুন্ধরা।
যখন ফুরাবে এ পথচলা মৃত্যুর শেষে
শ্বশান কাঁদিয়ে জাফরানী চিতা নিভে যাবে
আমার দেহের ধূসর ছাই তোমরা উড়িয়ে দিও ঘাসে
মৃত্তিকা উর্বর হবে আমার স্বদেশ আমার পৃথিবী
কিছু পাবে।
গুরু, একটু
অলোক দাও...
তোমার পদধ্বনিতে ঘুমভাঙানিয়া সুর, তোমার চিন্তিত নিশ্বাস
যেন দুঃখ-তাড়ানিয়া গান, তোমার মশাল
জগতের যাবতীয় অন্ধকার দূরীভূত করে গেছে চিরকাল।
আজ দুর্দান্ত দুর্দিনের ধোয়াটে অন্ধ গুহায়
গুরু, একটু আলোক দাও... তোমার অনল
থেকে যেন বঞ্চিত না হয় আমার মশাল।
বজ্র পড়ুক যুদ্ধবাজের মাথায়
বজ্র পড়ুক যুদ্ধবাজের মাথায়, ঢালছো যারা স^চ্ছ জলে সর্পবিষ
তাদের আমি ঘেন্না করি। অভিযোগের ধিক্কারেতে
বারে বারে ফেটে পড়ি
অশুভ হাত করলে আড়াল আঁধারনাশক প্রদীপ্ত শীষ।
নীল আকাশে উড়ন্ত নয়, রক্তভেজা পাখির পালক ভালোবাসে
কূপম-ূক শিকারীরাই। আমি তো নই তাদের মতো,
হয়তো বা তাই
পঙ্কিলতা ঝেরে ফেলে মানবতার পক্ষে দাঁড়াই।
জোনাক-আলোকে করো না বোতলবন্দি, ক্রুদ্ধ হয়ে রুদ্ধ করো না আর
কবির মুক্তকণ্ঠ। এসো অভিমানের তীক্ষ্ম ছুরা
নর্দমাতে ছুঁড়ে ফেলে
অশ্রু ঢেলে আবাদ করি বন্ধুত্বের পতিত খামার।
আমাকে আমূল বিদ্ধ করো ত্রিশূলে, যন্ত্রণাতে মূর্ছা পরে কাতর স্বরে
বলবো তবু ন্যায় বিরোধী যুদ্ধের চেয়ে আত্মহত্যা অনেক
ভালো।
রুদ্রদিনের আলোকছটায় পরাজিত হোক রাতের কালো।
তামার বিষ
যে টুকু অর্থ পেয়ে মানুষ অমানুষ হয়ে যায়
সে টুকু অর্থবিত্ত দিও না আমায়।
বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছেÑ “তামার বিষ”
সেই তামার বিষে যেন না ধরে আমায়।
এতো টাকা দিয়ে আমি করবো কী, যে টাকা পেলে
নিজের উত্তরাধিকার নাম লিখাতে যায়
অলস ভবঘুরে আর বখাটেদের খাতায়
এতো ধনের মালিক তুমি করো না আমায়।
টাকার অহংকারে বউ ছুটবে হাটে, গয়নাঅলার সাথে
বলবে কথা হেসে
শাড়ি চুড়ি জুতোর দোকান, বিক্রেতারা দাঁড়িয়ে গা ঘেসে
ভাবি ডেকে জুতো বিক্রির ছলে হাত বুলাতে চাইবে
পায়Ñ
অর্থের কুপ্রভাব যদি পেয়ে বসে আমায়।
ভাত ছিটালে কাক আসে, টাকা উড়ালে মেয়ে মানুষের
হয় না অভাব
ঈষৎ হেসে তুলে দেবে সবুজ গেলাসে রঙিন সরাব
নগরনটীর দল। কিছু তোষামোদকারী চাটুকার
সামনে দেবেই স্যালুটÑ পেছনে লাত্থি দেখাবে অবলীলায়।
এতো দৌলত দিয়ে আমি করবো কী, তামার বিষে
যেন না ধরে আমায়।
সময়টা ঘর বাঁধবার
সময়টা ঘর বাঁধবার। খুব বেশি শীত নেই এখন
এমন কি খুব বেশি গরমও না। এখনো বৃষ্টি ঝরে না
তেমনÑ
তাই পথে নেই কাদা, হাটুজল।
শুষ্কতাও এতো বেশি যায়নি বেড়ে
দিকে দিকে ধুলো আর ধুলো উড়বে কেবল।
সময়টা ঘর বাঁধবার। ফাগুনের হাওয়া লেগে কাঁপছে
ভূবন
ডালে ডালে পাখি আর বনে বনে জন্তুরা
সঙ্গী খুঁজতে ব্যাকুল এখন।
গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন মিস্তিরি, কখন যে কার ঘর বাঁধবার
পড়ে প্রয়োজন...!
ইট-কাঠ-লোহা আসছে দেদার। যাতায়াতে বাধা নেই
নেই অসহ্য দূর্গমতা পথের
গলিতে গলিতে ঘুরছেন ঘটক সাহেব, উপযুক্ত
কপোত-কপোতী পেলে বেঁধে দেবেন জোড়। নতুন সম্বন্ধ
মানেই
নতুন একটি ঘর।
ঘটক কি তবে মিস্তিরি...? নাকি দুজনেই ঘর বাঁধবার কারিগর...!
শোনা যায় ঘোষণাধ্বনি, বাতাসের বুক চিড়ে
কারও মৃত্যু সংবাদ শুনিয়ে যাচ্ছে মাইক। একটি
নতুন করে
ঘর বাঁধতে হবে। নতুন একটি কবর মানে নতুন একটি
ঘর।
আজরাইল কি তবে ঘটক, নাকি মিস্তিরি...? নাকি ওরা সকলেই
ঘর বাঁধবার কারিগর..!
ফেরারী সেই হেমন্ত
এলো হেমন্তে নবান্নের দিন, ফিরে এলো অঘ্রাণ
ফেলে আসা স্মৃতিগুলো উঁকি দেয় বুঝি, পাই তার ঘ্রাণ
কুয়াশার চাদর বিছানো ভোর, মিষ্টি হিমেল হাওয়া
কমলা বিকেল, সোনা মাখা পাকা ধানে মাঠ ঘাট ছাওয়া
ঝুলি হাতে আলে আলে ঘুরতাম ধান কুড়ানোর দল
দাঁত দিয়ে কাটতাম ধানের গোছাÑ চুরিবিদ্যা সফল।
লিপি আপু ছিলো যেন দলটার অঘোষিত সরদার
শিষ্যরা প্রাণপণ মানতাম সুকঠিন নির্দেশ তার
ইঁদুরের গর্তে ভয়ার্ত ঢুকোতাম অনুসন্ধিৎসু হাত
মুঠি মুঠি ধান দিতো ধরা, যেন আশ্চর্য যাদুর দোয়াত
সেই ধান ফেরিওয়ালাদের দিয়ে কিনতাম নাড়–
নারকেলি আইসক্রীম, তিলের মোয়া, নিমকির খেড়–।
লিপি আপু কৌশলে কিনতো নিজের লাগি
প্লাস্টিকি-বালা
লালরঙা লিপস্টিক, কাচের চুড়ি কিংবা গীলটির মালা
একবার সমস্ত সংরক্ষিত ধান বেঁচে দিয়ে শেষে
খেলেছিলাম চড়ুইভাতি পুকুরের উঁচু পাড়ে বসে
লিলি আর লিপি আপু নিলো ভার রান্নার সমস্ত ফর্দ
যোগালাম কাঠ-খড়ি, হাড়ি-পাতিল আমরা কয় মর্দ।
মাটির চুলার মাঝে ধরিয়ে আগুন শুরু হলো রান্না
ধোঁয়া আর পেঁয়াজের ঝাঁজে চোখ ফেটে এলো যেন
কান্না
খাবার খাওয়ার বেলায় দেখি আহা... ভাত হলো জাউ
ডালে নুন বেশি, মাংসের তরকারী ঝালে হাউ-ফাউ
তবু হলো বেশ মজা, মজা করে বনভোজন আহার
ফেরারী সেই হেমন্ত, প্রাণোচ্ছ্বল দিন বুঝি ফিরবে না আর।
রিকশাতে একদিন
রিকশাতে একটা মেয়ে একটা ছেলের কাঁধে মাথা রেখে
ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল।
আর ছেলেটা মেয়েটার চুল-ওড়া কপালে চুমু খেতে
খেতে
নরম শরীরে শরীর ঘষছিল।
রিকশাটা চলে গেল আমারই চোখের সম্মুখ মাড়িয়ে।
মুহূর্তে আমি যেন তলিয়ে গেলাম, পুরাতন স্মৃতির
আড়ালে গেলাম হারিয়ে।
মনে পড়ে তার মুখ তার চোখ, যাকে আমি প্রাণপণ বেসেছি ভালোÑ
আহা, সেই কবেকার কথা এমন মধুর দিন আমারও তো ছিল।
রিকশাতে একটা মেয়ে একটা ছেলের কাঁধে মাথা রেখে
ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল।
পূর্ণিমায় প্রণয়মাতাল
পূর্ণিমায় তুমি আমি এক আঙিনায়, যেন ছোট্ট পুকুরে
প্রণয়মাতাল দু’টি হংসবলাকা
আজ শুধু সারা রাত হাতে হাত, জলের সঙ্গে যেমন
শরীরে শরীর সন্ধিবদ্ধ জলতরঙ্গ
তুমি মানে বারোহাত শাড়িময় আপাদমস্তক ঢাকা এক
নারী।
চাঁদের আলোতে রুপালি পুকুরঘাট, ভাঙাগলায় প্রেমিকার
নাম ধরে গান গায় প্রেমিক কোকিল
আমার বাহুতে মাথা রাখো তুমি, আমাদের বুকের ভেতর
রক্ত হঠাৎ ছলাত ছলাত করে
তুমি মানে রোমাঞ্চ-চঞ্চল প্রেমের সূত্র জানা
চপলা ঘরণী।
এসো পাশে ঘেঁষে ঘেঁষে বসি, খোঁপার বাঁধন খুলে দাও যদি
ব্যর্থ হবে আমার সন্ন্যাস-আরাধনা
প্রদীপ্ত চাঁদের মতো হাসি হাসব দু’জন, পলক না পড়া চোখে
দেখব তোমার ঠোঁটের কারুকার্য
তুমি মানে ধরণীর ঘরসংসারে চিরযৌবনা স্বর্গীয়
অপ্সরা।
আকণ্ঠ করেছি পান মহুয়ার মদ, তোমার হাসির ঝঙ্কারে
ভেঙে যাক আজন্ম নিস্তব্ধ নীরবতা
ঘনীভূত হোক দু’জনার নিঃশ্বাস, জঠরে তোমার উঠুক বেড়ে
আমার রক্তবীজের স্বাস্থ্যবান শিশু।
তুমি মানে চিতাবাঘিনীর মতো সঙ্গমপ্রিয় লক্ষ্মী
রমণী।
গোপনে বিপন্ন
সোনার পিঞ্জিরা রেখে উড়ে যায় পোষা পাখি
সোনার কী দাম আহা রইল তবে
ঘরের বধূই যদি গেল চলে পৃথিবী ছেড়ে
রুপালি খাটটি না হয় পড়ে থাক নীরবে।
মেঘ কেন মিশে যায় গহিন নীলিমায়
হাসে না হাসনাহেনা বিপন্ন বাগানে
জাল ছেঁড়া মাছ দেখায় লেজের দাপট
চলে গেল যে তার লাগি মন কাঁদে গোপনে।
সে যদি গেলই চলে একাকী নিস্বর্গে
আমার থরোথরো বুকে কে ঘুমাবে খোঁপা খুলে
এতই যদি রবে অটুট তার অভিমান
আমার চুরুটের ধুঁয়া প্রজাপতি হবে কার চুলে!!
ফিরতে পারিস যখন তখন
তোর চোখের মাপের আকাশ আমার নেই
তাই পাখনা মেলে উড়তে বলি না তোকে
ইচ্ছে হলে যা খুশি তা করিস, পূর্ণ অধিকার দেই।
তোর মনের মাপের উঠোন নেই এ বুকে
তাই নীড় সাজিয়ে বসতে বলি না তোকে
স্বাধীনতা দিলাম, বাসা বাঁধিস যার খুশি তার ডালে।
কিন্তু বলি শোন, আমার আকাশে কোনো বন্ধন নেই
সোনার খাঁচার দ্বার রেখেছি খুলে
ফিরতে পারিস যখন তখন তোর আকাশে দুরন্ত ঝড় এলে।
বিপ্রতীপ
খাঁচার পাখি সুখ খুঁজতে পালিয়ে গেলো বনে
মুক্ত বনে খাঁচার কথাই পড়ছে কেনো মনে!!
ঘরের বধূ ঘর ভেঙেছে শান্তি খুঁজতে শান্তি
শান্তি তো নেই, স্বামীর স্মৃতি বাড়িয়ে দিলো ক্লান্তি।
হারিয়ে গেলেই বুঝতে পারিÑ যা ছিলো তাই ভালো
যা ছিলো না খুঁজতে তাকে গিয়েই তো হারালো।
কলতলাতে
নারীটি ছিলো কলতলাতে বসে, পাখিটি ছিলো
সজনে গাছের ডালে
দেয়াল টপকে আমি দিয়েছি উঁকি, কাসার কলস
পূর্ণ হলো কল-উপচানো জলে।
নারীটি ঢালছে ভেজা শরীরে জল, পাখিটির ডাক
হঠাৎ গেলো থেমে
দাঁড়িয়ে আছি কাকতাড়–য়া যেন, মন অজান্তে
পড়েছি বাধা প্রেমে।
কলতলাতে সাবানের ঘ্রাণে দিশেহারা হয়ে রই
আমার যেথায় যাবার কথা, যাওয়া হলো আর কই...!!
খাঁ খাঁ
আমার এই খাঁ খাঁ বুকে মুখ লুকাবার
সে তো রইলো না
আমার রংচটা আম কুড়ানোর দিন ফিরিয়ে দেবার
সে তো রইলো না
যার এলোচুলে খেলা করে শৈশবের প্রজাপতি
যার ঘাসে ঢাকা সবুজ বুকে নাক ঘসেছি আমি
সে তো রইলো না, সে তো রইলো না।
কে আমায় ফিরিয়ে দেবে চুরি যাওয়া কৈশোর
লাটাই ঘুড়ি
কে আমায় নিয়ে যাবে কাশবনের সাদা সমুদ্রে
বাহুতে ধরি
যার নিঃশ্বাসে বিরাজিত বৃষ্টির গন্ধ
যার দৃষ্টিতে কাজল দীঘির গহিনতা দেখেছি আমি
সে তো রইলো না, সে তো রইলো না।
মেঘবালিকা
শ্রাবণ এলেই ভিজে ওঠে মনের উঠোন
থিকথিকে ভাব কাদাজলে
শ্রাবণ এলেই মনটা কোনো এত্তো ব্যাকুল
অশ্রু ঝরে দু’চোখ গলে।
সন্ধ্যেবেলায় দাড়িয়ে থাকি জানালা খুলে।
মেঘবালিকার পায়ের নূপুর ঝংকার ওঠে
বৃষ্টি ঝরা টিনের চালে
শ্রাবণ এলেই ভিজে ওঠে মনের উঠোন
অশ্রু ঝরে দু’চোখ গলে।
নূপুর পরা ভেজা পায়ে আসবে কি সে কাদাজলে?
প্রকৃতি কি বাজায় বাঁশি, বেহালার সুর
দাঁড়িয়ে থাকি জানালাতে
ভেজা পায়ে আসবে কি কেউ জমাটবাঁধা অভিমানে
সন্ধ্যেবেলায় কুপি হাতে।
সেই যে কবে এসেছিলে বৃষ্টি ঝরা শ্রাবণ রাতে।
শাড়ির আঁচল সরিয়ে দিয়ে উষ্ণবুকে খুঁজেছি ওম
তখন তুমি এক নিমিষে পাথর গলে হয়েছো মোম।