“ সেই যে সমুদ্র ছলোছল উপল বেলায়
পাতার নৌকো এক ভাসিয়েছিলাম দূরে,
অজানা নোঙ্গরে এ মন নিয়েছিলো ঠাই
কোনো এক অঘ্রাণ পূর্ণিমা নিশি বাসরে।”
অথৈ জলে ভাসতে চেয়ে, ভাসাতে চেয়ে, কতোশত ঝিমধরা রোদ্দুর দিনে ঝিনুক খোলে সাজানো বুনো অর্কিড দোলানো সাগর পাড়ের রেস্তরাঁয় বসে চেয়ে রইতাম, ভাটার উল্টোস্রোতে ভেসে আসা খয়েরী-নীল-সবুজ রঙিন সুরার বোতল ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে আসতো ভেঙে টুকরো টুকরো পাথরের মসৃণতায় সেজে। তোমরা নাম দেবে এর অচিন দ্বীপের উপকথা? ভুল সে জেনো। গোটা এক বিশ্ব জনতার মাথা নুইয়ে যেতো তার অন্তর জুড়ে থাকা নিঙৃত মৌন মুখর ধ্যানমগ্নতায়।
অতলান্ত তিমুর সাগরের পরিসীমাহীন নীল জলরাশির বুকে জেগে থাকা ছোট্ট দ্বীপদেশ — পূর্ব তিমুর। মানচিত্রে অষ্ট্রেলিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার মাঝখানে ছোট এক কুম্ভীরাকৃতি অস্তিত্ব। ইন্দোনেশিয়ার হাজারো দ্বীপের মধ্যে অন্যতম একটি দ্বীপ। তৈল সম্পদের প্রাচুর্য আর ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বৃহৎ পরাশক্তিগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ এক অবস্থান। কারণ, এই দ্বীপদেশটি থেকে একই সাথে অষ্ট্রেলিয়া আর এশিয়া মহাদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব। এমনকি রাজধানী দিলির পাশের কয়েক মাইল দূরের দৃশ্যমান পাহাড়- অরণ্যসংকুল দ্বীপ আতাউরোর খোলা সাগরের দিকটিতে আমেরিকান গোপন সাবমেরিন ঘাটি থাকার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট সবার কাছে সেখানে।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী প্রেসিডেন্ট রামোস হোর্তা, বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রাইম মিনিস্টার ( পরে প্রেসিডেন্ট) জানানা গুসমাও এর স্বপ্নের দেশ পূর্ব তিমুর। সরকার বিরোধী বিদ্রোহী গেরিলা সশস্ত্র বাহিনীও মেজর রেনাদিওর নেতৃত্বে প্রবল প্রতাপে বিদ্যমান ছিলো সদ্য স্বাধীন দেশটিতে। কয়েকবার তারা হামলাও চালিয়েছে হোর্তা আর জানানার বাসভবনে। রেনাদোর অনুসারী সংখ্যাও একেবারে কম ছিলো না। পথের মোড়ে মোড়ে তরুণেরা মডার্ন আর্ট সহযোগে লিখে রাখতো, “ ভিভা, রেনাদো।” মানে, বেচে থাকো, রেনাদো। চে গুয়েভারার অসম্ভব ভক্ত তিমুরের বিপ্লবী জনতা। পোশাকে, পোষ্টারে, দেয়াল চিত্রে চে’র জয়জয়কার সেখানে। চে’র বিপ্লবী সুদর্শন পটচিত্রের ভক্ত আমি ছাত্র জীবনে খুব ছিলাম। তারপর বাস্তবের ধাক্কায় কবে যে কেটে গেছে সেসব ভাবালুতা, জানতে ও পারিনি। তিমুরীজ তরুণ-তরুণীদের চোখেমুখে চে’র স্বপ্ন বাস্তবায়নের অদম্য আকাঙ্ক্ষা আমায় যেন ফিরিয়ে দিতো সেই কুমারীবেলার মায়া অঞ্জন মাখা দৃষ্টি।
পূর্ব তিমুরের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা চিরকুমার রমণী মোহন হোর্তা থাকতেন আমার বাসা থেকে মাইল খানেক দূরে সমুদ্র ছোঁয়া মেইন রোড ধরে গিয়ে ৫/৭ মিনিটের পাহাড়ি পথের ধারে, তার কয়েক কামরার খড়-বাঁশে বোনা শৈল্পিক কুঁড়েঘরে। পথের বাঁকে এক তিমুরীজ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ট্যাচুর প্রান্তে গুটিকয় সশস্ত্র জোয়ান সেনাসদস্য ছিলো তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত। এছাড়া আর কোনো প্রোটকল মেইনটেইন করতে হতো না দেশটির প্রেসিডেন্টের দেখা পেতে। চলাফেরার রাস্তাতেই প্রায়শই উনার দেখা পেতাম কয়েকজন সেনা প্রহরার গাড়ীতে। শহর থেকে দেখা যেতো সন্নিকটের পাহাড়ে গোলাপি বর্ণের প্রাসাদোপম প্রেসিডেন্ট’স প্যালেস। উনি সেখানে থাকতে পছন্দ করতেন না।সমুদ্র পাড়ের কুঁড়েঘরের সাদামাটা জীবনই উনাকে টানতো বেশি। নিউ ইয়ার পার্টিতে আলাপ পরিচয় উনার সাথে আমার, ফটোশুট। একেবারে নিরহংকার মানুষ, তবে উনার তখনকার সঙ্গিনী ইন্দোনেশিয়ান মধ্যবয়সী মহিলা যথেষ্টই আকর্ষণীয়া ছিলেন।
প্রাইম মিনিস্টার জানানা গুসমাও অবশ্য স্ত্রী অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক কৃষ্টি আর ৩ ছেলেকে নিয়ে পাহাড়ের ওপরে বানানো বাড়ীতেই থাকতেন। কারণ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার কারণে তিমুরের তাপমাত্রা প্রায়শই ৪০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের এপাশে ওপাশে ওঠানামা করে। পাহাড়ের ওপরে উচ্চতার কারণে বেশ শীতল পরিবেশ। তবে, একবার সশস্ত্র গেরিলা বাহিনীর প্রাণঘাতী হামলা হলে সেই পাহাড়ি বাসায়, উনারা সপরিবারে নেমে এলেন আমার বাসার খুব কাছের সাগর পাড়ের সুপার শপ লিটা স্টোরের পাশের এক বাসায়। উনার ৩ ছেলেই ৭,৫,৩ এরকম বয়েসী আলেকজান্ডার (এলেক্স), কেও লাক (Kay Olok) আর জনি আমার কর্মস্থল ডিলি অস্ট্রেলিয়ান স্কুলের ছাত্র ছিলো বিধায়, প্রতিদিন ই প্রায় দেখা হতো প্রাইম মিনিস্টার পরিবারের সাথে স্কুলে, বাচ্চাদের আনা নেয়ার সময়। জানানা লম্বা গড়নের সুদর্শন দিলখোলা টাইপ মানুষ, তুলনায় কৃষ্টি একটু পদমর্যাদা সচেতন হয়ে চলতো। জানানা যখন কারাগারে বন্দী ছিলেন স্বাধীনতা পূর্ববর্তী কয়েক বছর, তখন উনার জীবনী মূলক বই লিখতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক কৃষ্টি সোর্ডের সাথে প্রেম- বিয়ে -সংসার। প্রায় বছর দুই আগে কৃষ্টি স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে কেমোথেরাপির ফসল ওর সোনালি ঘন কেশরাশি বিহীন মুণ্ডিত মস্তক ফেসবুকে দেখে দুঃখিত হয়েছিলাম অনেক। তবে আশার কথা যে, ক্যান্সার এর সঙ্গে যুদ্ধে ও বিজয়ী হয়েছে। বহুদিন থেকে আমার পড়ার অপেক্ষায় পড়ে আছে ওর লেখা “ A woman of independence ( a story of love and the birth of a new nation) “ বইটি। কবে যে অনলাইন পাঠের হাতছানি এড়িয়ে বসা হবে বইটি নিয়ে আমার, বিধাতা জানেন কেবল।
আমার দীর্ঘ ৫ বছরের স্মৃতিময় প্রবাস পূর্ব তিমুর যেন আফ্রিকার গহীন প্রান্তের চেয়েও অচেনা কতো প্রান্তর, পাহাড় -জলরাশি -বনান্তের নির্জনতা সঙ্গোপনে নিজের প্রাণে লুকিয়ে রেখে স্নিগ্ধ হাসি হেসে চলে তারাভরা আকাশের নীচে একা আনমনে। ঔপনিবেশিক পর্তুগীজ শাসকেরা সম্পদ লুট আর শাসনের বিনিময়ে যেখানে রেখে গেছে অফিশিয়ালি পর্তুগীজ ভাষার ব্যবহার, কিছু পর্তুগীজ রন্ধন শৈলী, ছুরি-কাটা চামচের নিখুঁত আহার প্রণালী আর রাশি রাশি তালগাছের সারি। “ তোয়াসাবু” নামের তালের রসের তাড়ির নেশায় মত্ত রাখতে সরল দ্বীপবাসীকে। এমনকি কচি তালের শাঁস বা পাকা তাল খাওয়ার উপায় টুকু ও অজানা তাদের আজ ও। ঝরে যায় নিজ মনে ম ম গন্ধের পাকা তাল কতো বিজন অরণ্যানীতে।
কোনো বৈসাবি বা বিজু উৎসব নয়, তবু প্রতি সাঁঝে আকাশে সন্ধ্যাতারা লাজুক চোখ মেলে তাকালে, সাগর মেখলায় ও জ্বলে ওঠে শত লন্ঠনের আভা। দরিদ্র দ্বীপবাসীর আহার তালিকায় প্রোটিনের মূল যোগান আসে ভাটার টানে সাগরের কিনার পানি কমে গিয়ে জেগে ওঠা পাথরের মাঝে মাঝে আটকে পড়া স্বচ্ছ টলটলে জলের বুকে সঞ্চারমান ছোটো থেকে মাঝারী মাছ, কাঁকড়া, শামুক, ঝিনুক, সি-কিউকামবার, সি-উইড এসব টাটকা সামুদ্রিক খাবার। সন্ধ্যা নামার আগেই আবাল-বৃদ্ধ- বনিতারা হারিকেন হাতে নেমে পড়ে ভাটার সাগরে। তীর থেকে শুধু দেখা যায় ওদের হাতে ঝোলানো আলোর কাঁপা কাঁপা আভাস। ওরা ক্ষুধার অন্ন যোগানে মগ্ন থাকে আপন মনে, কিন্তু, তীরের পথিক জানে, কি অপরূপ সে শোভা রক্তরাগ সন্ধ্যার পটে সাগর জল ছলচ্ছল আলোক মালার। কতো তফাৎ এ মনোরম সাঁঝ বেলার সাথে ড্রয়িংরুম বিলাসী বিজলী বাতি জ্বলা সুরভিত চায়ের কাপে আটকে পড়া মানবিক স্বপ্নচারী জীবনের, তা জানা হয়ে উঠবেনা কোনোদিনই কোনো নাগরিক ম্যাচ বাক্সের বাসিন্দার।
ব্রয়লার ফাঁপানো ঝিমানো মুরগী খাওয়া জীবন নয় তাদের। সব দেশী মোরগ-মুরগী। তেনারাও আবার মাটিতে বা খোপে নয়, নিখাদ অরণ্যচারীর মতো গাছের ডালে রাত্রিযাপন করেন। মোরগকুল অবশ্য মুরগীদের চেয়ে বেশী প্রেস্টিজিয়াস সেখানে। কারণ, কক-ফাইট বা মোরগ লড়াই তিমুরীজদের অতীব প্রিয় খেলা। ছুটির দিনে তো বটেই, এমনিতেও ফাঁক পেলেই যুদ্ধবাজ মোরগদের পরস্পরের সাথে লড়িয়ে দিয়ে গোল হয়ে মেতে ওঠে উত্তেজনায় দর্শককুল। মেয়েদের এ খেলা দেখা সম্পূর্ণ রীতিবিরুদ্ধ সেখানে। তাই আমি অনেকদিন দেখতে যাবো যাবো করেও পাছে ওদের রীতি কে অসম্মান করা হয়, এই আশঙ্কায় আর যাইনি মোরগ লড়াই খেলা উপভোগ করতে। আরেক কিসসা, যে কোনো পশু জবাই করার বেশ খানিকক্ষণ আগে সেটার কান কেটে ফেলে ওরা, যাতে রক্তপাতে নির্জীব পশুটিকে বেশী ধস্তাধস্তি ছাড়াই জবাই করা যায়।পশুর চামড়া ছাড়ানোর বিদ্যা হয় ওদের জানা নেই, আর তা না হলে এতো ঝামেলা করতে চায় না হয়তো, তাই রোম চামড়া সহই বড় বড় চাকে কেটে নিয়ে বিক্রি করে জবাইকৃত পশুর মাংস। কতোদিন দেখতাম আমার গাড়ীর সামনে চলা মোটর সাইকেলের পেছনে কোনো গৃহকর্তা আস্ত পশম শুদ্ধ গরু -ছাগলের ঠ্যাং ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাজার থেকে।
বাংলা ভাষায় বেশকিছু পর্তুগীজ শব্দ মিশে আছে। তাই, তিমুরীজ ভাষা “ তেতুন “ এও মিষ্টির প্রতিশব্দ মিডার। আমাদের গ্রামাঞ্চলের মিঠাই /মিঠার প্রতিশব্দ আর কি। ওদের বহুল ব্যবহৃত কথা হোলো, “ লা মিডার “। মানে, মিষ্টি কিছু খাবোনা। একেবারে মিষ্টি অপছন্দ ওদের। তাই হয়তো ওবেসিটি প্রব্লেম কম তিমুরীজদের মাঝে। ওদের প্রিয় আমাদের কলমি শাক, তবে তা চাষ করে রাস্তার পাশের নর্দমার আর্দ্রতায়। ওদের ভাষায় কলমির নাম, “ কাঙকুন “, ভাতের সাথে খুব প্রিয় খাবার ওদের। ওরা কখনোই হাত দিয়ে ভাত খেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না, চামচ লাগবেই। যদি নিতান্তই চামচ না পায় হাতের কাছে, তবে হাতে পরিষ্কার পলিথিন জড়িয়ে ভাতের গ্রাস মেখে খায়, তবু হাত নয়। আবার ওরা রাস্তায় ধুলো ওড়া কমাতে নিজ নিজ বাড়ী বা দোকানের পাশের ড্রেন থেকে ময়লা পানি জেরিকেনে তুলে তা ছিটিয়ে দেয় প্রতি বিকেলে রাস্তায়। কোনটা যে ওদের চোখে পরিচ্ছন্নতার নমুনা, আর কোনটা নয়, তা বুঝতে অসুবিধা হতো আমার। আরেক প্রিয় শখ তিমুর বাসীর, সন্ধ্যালগ্নে গাড়ীর পরিত্যক্ত টায়ারে দাউদাউ আগুন জ্বালিয়ে তা ঘিরে উল্লাসে মেতে দারুপান। এসব টায়ারে বৃষ্টির পানি জমে ডেঙ্গুর প্রকোপ ও কম ছিলো না সেখানে। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুর পাশাপাশি সেখানে নতুন করে আবির্ভাব হয়েছিলো মশা বাহিত আরেক রোগ “ চিকন গুনিয়া “। মশারী টানাতে আমার চিরকালীন চরম অনীহা আর আলসেমির কারণে একবার চিকন গুনিয়া রোগে আক্রান্ত হই আমি সেখানে। প্রতি জয়েন্টে জয়েন্টে এমন ব্যথা হয় এ রোগে যে, আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় পঙ্গু বা ক্রিপলড হয়ে পড়ে বেশ কিছুদিনের জন্য। ডাক্তাররাও প্রথমে বুঝতে পারছিলেন না আমার অসুখের ধরণ সেখানে। পরে হাসিবের মহিলা কলিগ শ্রীলঙ্কান ডঃ মানেল বলেন যে, এরকম নামের একটা অসুখ আছে। আনকমন অসুখ বিধায় ইন্টারনেট ঘেঁটে প্রতিকার খুঁজতে হয়। ম্যালেরিয়ার ওষুধই ভিন্ন ডোজে ব্যবহার করতে হয় চিকণ গুনিয়া প্রতিসমে।
আমার বাসা থেকে মিনিট পাঁচেকের রাস্তায় সুপার শপ লিটা স্টোরের উল্টোপাশের রাস্তায় ছিলো কাচা বাজার, সাগরের তীর ঘেঁসে একসারি দোকান, প্রথমে খড়ের ছাউনি দেয়া চারদিক খোলা চালাঘর ছিলো ওগুলো, পরে সরকার থেকে টিনের চাল আর পাকা মেঝে করে দিয়েছিলো। মূলতঃ মেয়েরাই সবজীর দোকানী। বেচা কেনার অবসরে তারা বসে তাস খেলতো আর বয়স্করা পান চিবুতো। ক্রেতা সমাগম কম থাকলে দোকানের ভেতরেই শুয়ে ঘুমিয়েও নিতো, তখন ডাকাডাকি করে তুলে কোনো জিনিস কেনার আগ্রহ কেউ দেখালে ভয়ানক বিরক্ত হতো দোকানী নারীরা। বাজারের সওদার পাশাপাশি ছিলো সেখানের বেশ কয়েকটা ফ্রান্জিপানি বা কাঠ গোলাপ গাছে সারা বছর থোকায় থোকায় ফুটে থাকা অজস্র ফুলের ঝিম ধরানো সুবাস। তিমুরীজদের জন্য কম দাম,আর “ মালাই “ মানে বিদেশীদের জন্য বেশী। মালাই আবার দু’রকম, মালাই মুতিং মানে সাদা চামড়ার বিদেশী, আর মালাই মেতাং মানে ইন্ডিয়ান ধরণের বাদামী চামড়ার বিদেশী। যেহেতু মালাইরা ডলারে বেতন পায়, তাই তাদের কাছে দাম একটু বেশী, খুব যে বেশী তাও নয়, যেমনঃ ৮/১০ টা বেগুন হয়তো দুই ডলার। শসা, টমেটো, ক্যাপসিকাম, তরমুজ, বীনস কয়েক রঙের, (যেমনঃ সাদা,কালো, খয়েরী, বাদামী), এ্যাভোকাডো, ডালিম, আম,কাচা কাঁঠাল, পেঁপে, জাম্বুরা, আতা, কাসাভা, ব্রেড ফ্রুট এসব বাজারে উঠতো প্রচুর। পঞ্চাশ সেন্টে এক পলিথিন ব্যাগ ভর্তি কাচা কাঁঠাল, পাকা খাওয়া যায় সেটা, ওরা জানতো ই না।একবার আমি একটু পাকা এক কাঁঠালের কোষ তুলতে বললে ড্রাইভার নাজারিও আর কাজের মেয়ে সেলিনার সে কী হাসি, আমার এই উদ্ভট খাবারের বায়না দেখে। পাকা কাঁঠাল কেউ খেতে পারে, ওদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না।
অনেক বড় সাইজের ভেতরে গাঢ় কমলা রঙ পেঁপে ছিলো খুব মিষ্টি। আমার পেছন আঙিনায় আমার নিজহাতে লাগানো গাছে এতো ধরতো যে, নিজেরা খেয়ে শেষ করতে না পেরে কাছের অরফানেজে পাঠিয়ে দিতাম। কাচা পেঁপের তরকারীতে সেলিনা কিছু পেঁপের ফুল ও দিতো, খেতে খারাপ লাগতো না।তিমুরীজরা অনেক খেতো পেঁপের পাতা রান্না করে, ম্যালেরিয়া নিধন হয় এতে শুনেছি।অনেক ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিলো তো সেখানে। আতাফল দু’রকমের ওখানে, একটা আমাদের দেশেরটার মতো, আরেকটা বড় চাল কুমড়া সাইজের। ওরা আতা কে আতা, জাম কে জামুন বলে। এগুলোও অনেক মিষ্টি। কিন্তু, আম আর ডালিম ছিলো কেমন কাঠখোট্টা রসকষহীন। হাসিব মাঝে মাঝে পাহাড়ি কোনো এলাকায় ট্যুরে গেলে রসালো আম পেলে কিনে আনতো। আমাদের বাসায় ও একটা আম গাছ ছিলো। চলে আসার আগের বার থেকে সেটায় ঝাঁপিয়ে রসালো মিষ্টি আম ধরা শুরু করেছিলো। কয়েক কার্টুন ভরে যেতো নিজেদের গাছের আমে।
আঙিনা পার হয়ে গেটের কাছে ছিলো মাঝারী সাইজের জাম গাছটা। টপাটপ ঝরে পড়া আধা আঙুল সাইজের পাকা মিষ্টি জামগুলো তেমনি পড়ে থাকতো। আমার ফিলিপিনো বাবুর্চি রুডলফো আমাকে কোনোদিন একটা জাম ও মাটি থেকে তুলে খাবার অবকাশ দিতো না। বিপুল উৎসাহে গাছে উঠে হাত দিয়ে জাম পেড়ে পলিথিন ব্যাগ ভর্তি করে দিতো। অতো জাম নিজেরা খেয়ে শেষ হতো না, বন্ধু-বান্ধবদের বিলাতে হতো।…….ভর ভরন্ত ছিলো সেখানে অদিতা, আমি, হাসিব, দারোয়ান দোয়ার্তি, ড্রাইভার নাজারিও,হাউস কিপার সেলিনা, ফিলিপিনো কুক রুডলফো, পোষা কুকুর স্পাইকি মিলে পাচিল ঘেরা বড় আঙিনার একতলা দুইসারি ঘরের সংসার, বিশ্ব সংসারের তালগোল এড়িয়ে। আর খবরাখবর নিতে নিত্য আসতো হাসিবের সহকর্মী আলসিনো আর আমার বন্ধু ডোমেনিকান নান সিস্টার মেরী এন। কোনোদিন সেখানে একদিন আগের রান্না খাবার পরদিন খাওয়ার চিন্তা করতে পারিনি। বরং, সপ্তাহে ২/১ দিন বাসার ডাইনিং টেবিলে পরিপাটি সাজানো খাবার ফেলে হুটহাট পরিবার মিলে বেরিয়ে যেতাম রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। জাপানিজ, চাইনিজ, কোরিয়ান, থাই, ভিয়েতনামিজ, ইন্দোনেশিয়ান, লাওস, অস্ট্রেলিয়ান, বার্মিজ,ইন্ডিয়ান, বাংলাদেশী, এরকম নানা স্বাদের রেস্টুরেন্টের যখন যেটাতে খুশী। শুধু খাবারে নয়, রেস্তোরাঁ গুলোর ডেকোরেশন এবং কর্মীদের পোশাক, কায়দা কানুনেও থাকতো তাদের ফেলে আসা স্বদেশের ছায়া। যদিও হাসিবের চাকরীর সুবাদে আমাদের সেখানে যাওয়া, পূর্ব তিমুর হেলথ মিনিস্ট্রির চীফ এডভাইসার ছিলো সে। কিন্তু, আমি ব্যক্তি জীবনে ক্যারিয়ারের ইঁদুর দৌড়ের বাইরেও যে মানুষের একটা জীবন থাকে, যেখানে রোদ-বৃষ্টি, আলো-ছায়া, নিঝুম দুপুর, চাঁদনী রাতের মায়া, সন্ধ্যার অস্তরাগ সুর, পাহাড়িয়া বাতাসের উথালপাথাল কান্না আর অবুঝ সাগর জলের তটে আছড়ে পড়া অকারণ ঢেউয়ের অভিমান বেজে যায় আনমনে মহাকালের বুকে, সেই অনাস্বাদিত সোয়াদ খুঁজে পেয়েছিলাম সেই রুখু পাহাড়ের সাগর ঘেরা ছোট দেশটিতেই। যদিও আধাবেলা চাকরী করতাম ডিলি অস্ট্রেলিয়ান স্কুলে, হেলথ মিনিস্ট্রিতেও ইংলিশ পড়াতাম মাস ছয়েক।
আমাদের বাড়িতে ঢুকতেই বিশাল ঝাঁকড়া লটকন জাতীয় ফলের এক গাছের ডালে ছিলো কাঠের মই দিয়ে ওঠা অদ্বিতীয়ার ট্রি- হাউস। মেয়ে আমার ওর ভিনদেশী বান্ধবীদের নিয়ে সংসার সাজাতো সেই খেলাঘরে। দড়ির মাথায় বেতের এক ঝুড়ি ঝোলানো ছিলো ওর দরকারি জিনিসপত্র ওঠানামা করানোর। বড় হতে হতে একদিন আকাশ ছুঁয়ে গেলেও মেয়ে কি আমার স্বপনে খুঁজে পাবে তার সেই পাতার আড়ালের খেলার সংসারের নির্মল পিছুডাক?
হেল্পিং হ্যান্ডরা সারাক্ষণ ঝাড়ু দিয়ে রাখতো উঠান জুড়ে থাকা খসে পড়া পাতাগুলো। তবুও পাতা ঝরা দিন এলে রবিবারের ছুটিতে যেদিন ওরা সেজেগুজে চার্চে যেতো, পাতারা মওকা পেয়ে ঝরে ঝরে প্ল্যাটুন ধরে পাহাড়ি হাওয়ার সাথে গোল্লাছুট খেলতো উঠানের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। রোদেলা খোলা বারান্দায় বসে দুর্বোধ্য এক আবেগে আমি চেয়ে দেখতাম বাতাসের সাথে পাতাদের খুনসুটি। অল্প বয়সী নারকেল গাছ দুটোর ঝিরিঝিরি দোলা, ব্রেড ফ্রুট গাছের বড় বড় পাতার ফাঁকেফাঁকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সুনীল আকাশে ছিটেফোঁটা মেঘের আলপনা, থোকা থোকা রঙ্গন ফোটা গাছের ছায়ায় বুলবুলি দম্পতির ভালোবাসা আদর। আমার ছিমছাম বারান্দার কার্নিশ থেকে থাই ডিজাইনের বহুরঙা ল্যাম্প আর বাঁশের চাইম সহ বার্ডস হাউসের ঝুলানো বাসায় ডিমে তা দেয়া অথবা সদ্য ফোটা ছানাদের আধার মুখে উড়ে আসা চড়ুই পাখিদের নিঃকোচ আনাগোনার দৃশ্যাবলীর মাঝে হারিয়ে যেতে যেতে। সেখানেই নিরিবিলি এক প্রহরে লেখালেখির ভুবনে হাতেখড়ি আমার।
আমার পাখ-পাখালি ঘেরা বারান্দা থেকে দেখা যেতো পাহাড়িয়া নিসর্গপটে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত গ্রীষ্ম- বর্ষা-শীতের রঙ বদলের খেলায় আকাশ বধুর নানা রূপে নানা সাজে মান-অভিমানের গীতি আলেখ্য। অফিসিয়ালি চার ঋতুর দেশ হলেও আসলে সারা বছরজুড়ে গরমের দাপুটে গ্রীষ্মকাল এবং অল্প সময়ের কিছু বর্ষার দেশ তিমুর। ডিসেম্বর এর দিকে একটু হিম হিম ঠাণ্ডা পাহাড়ি বাতাস সামান্য শীতের আমেজ আনে মাত্র সেখানে। এরকম গরমে দেহ মনে প্রশান্তিদায়ক হিসেবে উঠোনের পেছন দিকটায় রূপোলী-লাল রঙা মাছে ভর্তি সিমেন্টে বাধানো আধা গভীর চৌবাচ্চার বুকে নানা রঙা আকশের প্রতিচ্ছায়ায় মা মাছেরা পোনাদের নিয়ে অক্লান্ত ডুব সাতারে ব্যস্ত থাকতো রাত দিন। পাউরুটির টুকরো ছুড়ে দিলেই লুকোচুরি বাদ দিয়ে পানির উপরে ভেসে উঠে ঠুকরে খেতো তারা। মাছেদের পছন্দের তালিকায় আরো ছিলো লেটুস। কিন্তু, আমাদের পোষা কুকুর স্পাইকির মোটেও রুচি ছিলো না বাজারের ডগফুডে। একদম খাটি বাঙালী মাছ-গোশ, ভাত-সবজি পছন্দ ছিলো স্পাইকির। বাসার সবাই কাজ শেষে ফিরে এলে অপেক্ষায় অধীর স্পাইকি দু পায়ে ভর দিয়ে বাকী দু’পা আমাদের গায়ে তুলে গাল চেটে আদর সম্ভাষণ জানাতো দৌড়ে এসে।আমি খুব ভয় পেতাম ওর এই গায়ের উপর আসা। বাকীরা পাল্টা আদর করতো ওকে। অবশ্য স্পাইকির খাবার আমি নিজ হাতেই দিতাম বেশীর ভাগ সময়। স্পাইকি ছিলো স্বাস্থ্যবান কুকুর। তিমুরীরা কুকুর খায়।প্রায়ই গেটের বাইরে রাস্তায় হেটে যাওয়ার সময় তিমুরীরা ওদের ভাষায় বলতে বলতে যেতো, এই কুকুরটা মোটাতাজা, ওকে খেতে খুব মজা হবে। তাই স্পাইকিকে চোখে চোখে রাখতে হতো আমাদের সবার। ৫ মাস বয়স থেকে আমাদের পরিবারে বড় হওয়ায় বাংলা কমান্ড বুঝতো স্পাইকি। সপ্তাহান্তে বিপুল উৎসাহে অদিতা আর হাসিব ডগ শ্যাম্পু দিয়ে স্পাইকিকে গোসল করাতো। স্পাইকির কাছে এটা ছিলো জীবন মরণ সমস্যা। বাসার ৫/৬ জন মিলে সারা বাড়ী আর উঠানে ওর পিছে দৌড়ে ওকে বন্দী করে তবে গোসলখানায় নিয়ে যেতে হতো ওকে। সপ্তাহের অন্য যে কোনো সময় “ গোসল “ শব্দটা স্পাইকির সামনে উচ্চারণ করলেই ও পাগলের মতো সারা বাড়ী দৌড়ে অস্থির হতো। তিমুর ছেড়ে আসার সময় আমার এক ফিলিপিনো কলিগের জিম্মায় স্পাইকিকে দিয়ে এলে ও মানুষের মতো জোরে চীৎকার করে বুকফাটা কান্না কেঁদেছিল। সেখানে পরিবারের আমরা ৩ জন, হেল্পিং হ্যান্ড ৪ জন আর স্পাইকি সবার জন্য এক রকম খাবার বরাদ্দ ছিলো। অবশ্য আমার মেয়ে অদিতা ওয়েস্টার্ন খাবারে অভ্যস্ত হওয়ায় নানা দেশী খাবার ওর জন্য বায়না মতো সময়ে বাবুর্চি রুডলফ রান্না করে দিতো। আর ছিলো প্রচুর পার্টিতে নিমন্ত্রণ। রুডলফের বানিয়ে দেয়া গরমাগরম চীজ স্টিকস আর স্যামন ফ্রাই নিয়ে অধিকাংশ পার্টিতে এটেন্ড করতাম আমি। কখনো সখনো সাথে নিতাম সিরাজ রেড ওয়াইন।কতো বিভিন্ন দেশীয় পার্টিতে যে গেছি সেখানে হিসাব করা মুশকিল।
আসলে সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ হিসাবে ইউনাইটেড নেশনস পিস কিপিং মিশন থেকে শুরু করে রেডক্রস কমিটি অফ জেনেভা, ওয়াটার এইড, সেভ দ্য চিলড্রেনস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু, ইউনিসেফ এরকম প্রচুর আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত গোটা বিশ্ব থেকে আগত মানুষে ভরপুর ছিলো তিমুরের রাজধানী ছোট্ট শহর ডিলি। আর, কর্মকর্তাদের সন্তানেরা আমার কর্মস্থল ডিলি অস্ট্রেলিয়ান স্কুলের স্টুডেন্ট ছিলো বলে আমার পরিচয়ের পরিধি অনেক বড় ছিলো। এই চাকরীটা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো সেখানকার ছোটো কিন্তু যথারীতি দুই গ্রুপে বিবদমান বাঙালী কমিউনিটির অহেতুক বিষয়াদি নিয়ে টেনসড সিচুয়েশনে মাথা ঘামানো থেকে বিরত থাকতে। সহজ সরল তিমুরীদের কাছে ইন্দোনেশিয়ার সুরাবাইয়া দ্বীপ জাহাজের রুটে পড়ায় সেখান থেকে ইলেকট্রনিক্স এবং সোফা, বেড এরকম নানা ঘর গেরস্থালী পণ্য সুলভে কিনে এনে ইচ্ছামতো চড়া দামে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া স্বল্প শিক্ষিত বাঙালী ৫/৬ জন ব্যবসায়ীদের দুই গ্রুপের মুখ না দেখাদেখি কোন্দলে জর্জরিত সেখানকার বাঙালী কমিউনিটি। তাদের মধ্যে নীরব প্রতিযোগিতা ছিলো পিস কিপিং মিশনে যাওয়া বাঙালী উচ্চ পদস্থ পুলিশ অফিসারদের সাথে দহরমমহরম নিয়ে। “ কাহারো অন্তরে প্রবেশ করিতে হইলে উদরের দরজা দিয়া প্রবেশ করিও “------এই সূত্রানুযায়ী বহু জাঁদরেল বাঙালী পুলিশ অফিসার এবং তাদের স্ত্রীরাও দাওয়াত খাওয়ার সাপেক্ষে সেই কোন্দলের এপক্ষ- ওপক্ষ অবলম্বন করতেন বছর খানেকের জন্য সেখানে অবস্থানের সময়। মোটামুটি দীর্ঘস্থায়ী সরকারী মন্ত্রণালয়ের চীফ এডভাইসার হিসাবে আমার হাসব্যান্ড হাসিবই সেখানে প্রথম নিয়োগপ্রাপ্ত বাঙালী এবং আমাদের পাঁচ বছরের সেখান অবস্থানকালে আমরা যতদূর সম্ভব এই কোন্দল এড়িয়ে দুই গ্রুপের সাথেই শান্তিপূর্ণ ভাবে চলার চেষ্টা করেছি। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে প্রচুর ভুগতে হয়েছে ব্যবসায়ী লোকেদের ২/১ জনের স্বল্প শিক্ষিত স্ত্রীদের ঈর্ষার আগুনে। তবে তা ড্যাম কেয়ার করে চলার মতো মনোবল সব সময়ই আমার ছিলো। আমার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে জব, হেলথ মিনিস্ট্রিতে ইংলিশ টিচিং, অস্ট্রেলিয়ান ডঃ ড্যানের পরিচালিত “বাইরোপিতে ক্লিনিক “ এর সবগুলো ইউনিটের লোগো ভলান্টিয়ার হিসাবে ডিজাইন করে দেয়া এরকম বহু কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম আমি। তবুও সুযোগ পেলে ঈর্ষার আঁচড় কাটতে ছাড়েনি বাঙালী কিছু রমণী মনের।
তবে, সেখানে পরিচিত হই জাতিসংঘ মিশনের প্রধান বাঙালী ভদ্রমহিলা আমিরা হকের সাথে। তিনি পরে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও নিযুক্ত হন। যে কয়বার দেখেছি, বয়-বাবুর্চি থাকা সত্ত্বেও অতিথি আপ্যায়নে উনি নিজ হাতে যত্ন করে রান্না করতেন। উনি আমার খুব কাছের মানুষ হেলথ মিনিস্ট্রির এডভাইসার সাইকোথেরাপিস্ট ইন্ডিয়ান ডঃ সুষমার বান্ধবী হওয়ায় আমিও ২/১ বার উনার বাসায় একান্তে ডঃ সুষমার সাথে নিমন্ত্রিত ছিলাম। একেবারে নিরহংকার, কর্মঠ একজন মহিলা তিনি। বহু কিছু শেখার আছে উনার কাছ থেকে। আর, ডঃ সুষমার হাতের মজাদার ইন্ডিয়ান রান্না যে কতোদিন খেয়েছি তার লেখাজোকা নেই। ইন্ডিয়ায় পরিবার রেখে তিমুরে একা থেকে হেলথ মিনিষ্ট্রির এডভাইসারের জব করতেন তিনি। আমার মায়ের বয়সী, কিন্তু কাছের মানুষ। পরস্পরের বহু একলা লাগা সময়ের সাথী ছিলাম আমরা দু’জন। ছিমছাম এক কম্পাউন্ডে ছবির মতো সাজিয়ে বাস করতেন ডঃ সুষমা। আমার বেশী পছন্দ ছিলো ওর নিজ হাতে করা সবজি বাগান আর ঘরের গোসল খানার পাশাপাশি বাইরে ওর বাঁশ গাছ সমৃদ্ধ ছোট্ট বাগানওয়ালা খোলা ছাদের আকাশ দেখা যায় এরকম গোসল খানাটি। এছাড়াও ইউনিসেফ, নিউজিল্যান্ড রাষ্ট্রদূত, ইউ এন এইড, অষ্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রিন্সিপাল মিস সারাহ এরকম বহু প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের পরিবারে মূলতঃ যাতায়াত ছিলো আমার সেখানে। খুব সহজেই যে কোনো পরিবেশে মানিয়ে চলার ক্ষমতা বিধাতা দিয়েছেন আমার মধ্যে। আমি সেজন্য জীবনের কাছে কৃতজ্ঞ।
আমার বাসা থেকে ২০ কদম দূরে ছিলো ডিলি শহরের প্রধান সড়ক। সেখান থেকে দেখা যেতো খোলা সাগরের বুকে ডিলির পার্শ্ববর্তী দ্বীপ আতাউরো। সপ্তাহে একদিন ডিলি ছেড়ে জাহাজ যেতো আতাউরোতে। প্রচুর ভিনদেশী মানুষ সেদিন যেতো সেই নিসর্গ মণ্ডিত দ্বীপ পরিভ্রমণে। অনেকেই জাহাজের আয়েশি কেবিনে না বসে খোলা ডেকে দাঁড়িয়ে সাগরের শোভা দেখতে দেখতে যেতে পছন্দ করতো। অনেক কমলা রঙা লাইফ জ্যাকেট, কিছু লাইফ বোট থাকতো যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে। উথাল পাথাল সে সাগর পরিভ্রমণে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিলো জাহাজের পাশে পাশে উড়ুক্কু মাছের ঝাঁকের বেশ খানিকক্ষণ বাতাসে উড়ে তারপর আবার জলের বুকে ফিরে সাতার কাটার দৃশ্য। আকারে খুব বেশী বড় হতো না উড়ুক্কু মাছেরা। আবার যতোখানি বড় ছিলো তারা, জাহাজের ডেকের উচ্চতা থেকে আরো ছোটো দেখাতো তাদের। আতাউরো দ্বীপ ছিলো সভ্যতার ছোঁয়া থেকে দূরে নিসর্গ মণ্ডিত এক অচিন প্রান্তর। সেই নির্মল জীবনের স্বাদ নিতে ভ্রমণকারীদের কেউ কেউ পুরো হপ্তা রয়ে যেতেন আতাউরোতে অবকাশ যাপনে। পরের সপ্তাহের জাহাজে আবার ফিরতেন ডিলিতে। তবে অধিকাংশ ই সেদিনই বিকেলবেলা একই জাহাজে ফিরে আসতেন। আসন স্বল্পতার কারণে আতাউরোর কোনো লজে থাকতে হলে আগে থেকে বুকিং দিতে হতো ফোনে। আমরা বার দুয়েক দিনব্যাপী ভ্রমণে, আর দুইবার মতো থেকে যাওয়া ভ্রমণ করেছিলাম আতাউরোতে।
এমন না ছোঁয়া কুমারী সাগর জলের স্বচ্ছতায় রোদ ঝিকমিক কিনার পানিতে নিশ্চল তারা মাছদের (star fish) শুয়ে থাকা আর বর্ণীল মাছেদের জলকেলি দেখতে দেখতে আর ফিরে আসতে ইচ্ছে করতো না সভ্যতার নিগড় বাঁধা জীবনে। এমন সাগর -পাহাড় -অরণ্যের নিসর্গ সুধাপান চাইলেই কি পাওয়া যাবে আর কোনোখানে? বাঁশে বোনা লজগুলোতে সমুদ্র ধারে সারাদিন ঢেউয়ের অবিরাম আছড়ে পড়া সুর শুনতে শুনতে গাছে বাঁধা দড়ির হ্যামোকে শুয়ে নিজের প্রিয় বইয়ের পাতায় ডুবে যেতে যেতে জীবনের গাঢ় আস্বাদ নেয়া যেন স্বপ্নলোকে কাটানো এক নিশ্চিন্ত নির্ভার কবিতার ছন্দিত প্রহর। আবার ইচ্ছে হলে লজের কমন খোলা বারান্দার মতো বাঁশে বোনা সিটিং রুমের মেঝেতে পাতা ফোমের আসনে গা ডুবিয়ে সেলফে সাজানো বই-ম্যাগাজিনে চোখ রেখে ভিনদেশী তরুণ -তরুণীর প্রেমোচ্ছাস বাঙালী অনভ্যস্ত চোখে সয়ে গেলে প্রাণের স্পন্দনে ছুঁয়ে যেতো শুধু একরাশ সিগাল ওড়া ঝকঝকে রৌদ্রদিনে আকাশ-সাগরের প্রেম প্রেম অভিমানের গান।
লজের খোলা কমনরুমের মাঝখানের বেতের নিচু টেবিলে চা-কফি, ফ্লাক্সে গরম পানি দেয়াই থাকে সারাক্ষণ, প্রয়োজন মতো বানিয়ে নিলেই হলো। ঠিক সময়ে দুপুরের অর্ডার মাফিক খাবার সার্ভ করতো সদা হাস্যোজ্জ্বল তিমুরী ট্রাডিশনাল পোশাক পড়া লজের মহিলা কর্মীরা। কিন্তু সাগর তীরের সেই একখণ্ড জনবসতি ছাড়া পুরো দ্বীপ জুড়ে ছিলো পাহাড়ের পর পাহাড়। প্রথমবার গিয়ে আমরা ভেবে নিয়েছিলাম, দ্বীপের জনবসতি নিশ্চয়ই পাহাড়ের বুকে হবে। কিংবা হয়তো পাহাড় পেরিয়ে যেতে হবে লোকালয়ে। ভাবিনি শুধু সাগর পাড়েই ঘর বেধে থাকে তারা। কোথাও কোনো পথ নির্দেশও ছিলো না। অনুমানে ভর করে আমরা ৩ জন আর আলসিনো ছিলো চালকের আসনে, চারজন মিলে আমাদের ফোর হুইল ড্রাইভ পার্ল কালার মার্সিডিজখানি নিয়ে সোজা রওনা দিয়েছিলাম পাহাড়ি পথ ধরে। তিমুরী হলেও আলসিনোর ও সেটা প্রথম ভ্রমণ ছিলো আতাউরো দ্বীপে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে চলছি তো চলছিই একটার পর একটা পাহাড় ডিঙিয়ে। কোনো জনমানব বা লোকালয়ের দেখা নাই। একসময় মনে হতে লাগলো যেন ধু ধু রোদে ঝলসানো পাহাড় ভুলভুলাইয়া হয়ে গিলে খাবে আমাদের ক্ষুদ্র অস্তিত্ত্ব। অন্তত ২০ টা নির্জন পাহাড় পেরুনোর পর আমি রমণীসুলভ নার্ভাসনেসে বারবার তাড়া দিচ্ছিলাম, চলো, ফিরে যাই যে পথে এসেছি। আমার ভয় হচ্ছিলো হঠাৎ কোনো কারণে গাড়ীখানি বিগড়ে গেলে ভয়ানক অসুবিধায় পড়তে হতে পারে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, এমন জনমানবরহিত পাহাড়ের বুক চিরে সুন্দর পাকা রাস্তা চলে গেছিলো অজানায়। পরে ধারণা করেছি, সম্ভবতঃ দ্বীপের অপর পাড়ে মার্কিন গোপন সাবমেরিন ঘাটির রসদ যোগানোর জন্য এতো আয়োজন সেই নির্জন পাহাড়ে।
ঘণ্টা দুয়েক ড্রাইভের পর পাহাড় থেকে সমতলে ফিরে এসে দেখি, জাহাজ ভেড়ার জেটির তীরবর্তী রাস্তা ধরে কিছুদূর গেলেই ছোট্ট জনবসতি আর বাজার।আতাউরো দ্বীপের হস্তশিল্প কেন্দ্রে দ্বীপবাসিনী মেয়েরা তিমুরীজ কাঠ খোদাই নানা ধরনের মূর্তি, হ্যান্ডলুম কাপড় আর নানাবিধ অলংকার তৈরি করতো। দ্বীপের নেটিভ গাছের লাল আর ছাই রঙা ফুলের বীচির অদ্ভুত সুন্দর ডিজাইনে গাঁথা মালা বেশ কয়েকটা কিনে এনেছিলাম আমি নিজের ব্যবহারের আর আত্মীয়- বন্ধুদের উপহার দেবার জন্য। এরপরের বার গিয়ে এক ছায়াঘন বিকেলে হাটতে বেরিয়েছিলাম দ্বীপের জনবসতিতে। শান্ত গৃহকোণের বাগান আর রাস্তার ধার ঘেঁসে কতো যে নাম না জানা বৃক্ষ ও ফুল -ফল চোখে পড়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। আরো দেখা হয়েছিলো বাজারে সওদা করে ফেরা বিভিন্ন বয়সী দ্বীপ-বাসিনীদের সাথে। কাঁধে ঐতিহ্যবাহী তিমুরী ঝাঁকা ঝুলিয়ে গল্পে মশগুল সুখ সুখ হাসিতে তারা ফিরছিলও সাগর তীরে যার যার কুটিরে। আমি তাদের ছবি তুলতে চাওয়ায় আরো বিস্তৃত ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো তাদের লাজরাঙা হাসিমুখ সন্ধ্যারাগের রক্তিম লালিমায়। রাতের খাবার আর গল্পগুজব শেষে বাঁশ-বেতের তৈরি বেডরুমের বিছানায় ঘুমাতে গিয়ে দেখি পাহাড়ি বন থেকে নেমে এসেছে শত শত লাল কেন্নো। পা রাখা যায় না মেঝেতে এতো বেশী তারা সংখ্যায়। কোনোরকমে মশারীর ভিতরে আশ্রয় নিলাম। মশারীর গা বেয়েও হেটে বেড়াতে লাগলো তারা। যদি একটা ও মশারীর মধ্যে ঢুকতে পারে তবে আমার কর্ণকুহরে ঢোকার সুযোগ তারা ছাড়বে না, এই ভয় মনে নিয়ে কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়লাম। মশারী গুলোও আবার হেলথ মিনিষ্ট্রির লোগো দেয়া বিনামূল্যে বিতরণের। আবাসিক লজে এলো কি করে সেই মশারী,সেটাও প্রশ্ন।সকালে উঠে দেখি, শুধু পায়ের নীচে চাপা পড়ে মরা কয়েকটি ছাড়া আর কোনো কেন্নোর চিহ্নই নেই কোথাও। যেন রাত্রির দুঃস্বপ্নের মতোই আবার তারা ফিরে গেছে বন পাহাড়ি অভয়াশ্রমে। দ্বীপের বুকে গহীন কালো রাত নেমে এলে তারাও গুটিসুটি পায়ে ঝাঁক বেধে নেমে আসবে আলোর সন্ধানে।
বাংলাদেশ থেকে পূর্ব তিমুর যাওয়ার সময় ভেবেছিলাম, সেখানে গিয়ে প্রয়োজনীয় পোশাকআশাক কিনে নেবো। দেশের প্রায় সব জামাকাপড় বড় কয়েকটা সুটকেসে আটাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মশারীতে ভরে গ্রামের লোকদের দিয়ে দেয়ার জন্য আম্মার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ও মা, তিমুর যেয়ে দেখি ডিলির মেইন রোডে ৫/৬ টা ইন্দোনেশিয়ান টপস আর জিন্সের দোকান ছাড়া আর কিছু নেই। তাও কোয়ালিটি ভালো না, উচ্চমূল্য আর প্রায় সবগুলোই জিরো সাইজের।বয়স্কা তিমুরীজ মহিলারা ট্র্যাডিশনাল ড্রেস পড়ে। কিশোরী আর তরুণীরা ওসব দোকানের মূল ক্রেতা। বছর খানেক কেটে যাওয়ার পর খেয়াল করলাম, আসলে জাহাজের কন্টেইনারে বিদেশ থেকে আসা সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড় ওদের নিত্য ব্যবহার্য পোশাকের প্রধান উৎস। ডিলি শহরের ২/৩ জায়গায় সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়ের মার্কেট। আমি আবার ফ্যাশনেবল কাপড় পরতে পছন্দ করি, তাও একেক সময় একেকটা। নিত্যদিন স্কুলে কাজে যেতেও পোশাক লাগে বেশকিছু। আমি যতোই সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেটে যেতে চাই, আমার ড্রাইভার নাজারিও ততোই আমাকে নিষেধ করে বলে, “ মাদার, যেও না। ওরা বিদেশ থেকে মরা মানুষের কাপড় এনে এখানে বিক্রি করে। “ প্রায় ২ বছর লেগেছিলো আমার নাজারিওর এই নিষেধাজ্ঞার ভয় কাটিয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেটে পা রাখতে। অনেক সুন্দর সুন্দর ওয়েস্টার্ন পোশাক বিক্রি হতো সেখানে। আমি কয়েকটা কিনেছিলাম। এছাড়া তো ছিলোই প্রতি ৩ মাস অন্তর ইন্দোনেশিয়ার বালি আর ৬ মাস পর পর বাংলাদেশে এসে নতুন পোশাক কেনার ধুম। নিউজিল্যান্ডে এসে এই ৪ বছর পরেও আমার এমন অনেক ড্রেস আছে, রুডলফো তিমুর থেকে ইস্ত্রি করে দিয়েছে, আর ভাজ খুলে পড়া হয়নি।
এছাড়া ও তিমুর বাসের ৫ বছরে কখনো ২/৩ দিন ছুটি পেলেই চলে যেতাম ডিলি থেকে বেশ দূরের এক জেলা বাউকাউ এ। পর্তুগীজ আমলে করা প্রাসাদোপম স্বল্প শয্যার অভিজাত আবাসিক হোটেল “ পাউসাডা” যেন নীরবে বয়ে চলেছে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের ভোগবিলাস আর ঐতিহ্যের প্রতিরূপ। বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে প্রায় দোতলা সমান উচ্চতা পার হয়ে পাহাড় কেটে বানানো হোটেল। বিশালাকৃতির দরজা - জানালার সুপ্রশস্ত হলরুম, সুদৃশ্য আলমারি ভর্তি পর্তুগীজ আর ইংলিশ বইপত্র, দেয়ালে পর্তুগীজ শাসক আর তিমুরীজ বীরদের ফোটোগ্রাফ, ডাইনিং, খোলা টেরেসে ছাতার নীচে ভারী কাঠের আসবাব সজ্জিত বসার জায়গা, বার, বেডরুমের নরম দুগ্ধফেননিভ শয্যাবিলাস, পর্তুগীজ খাবারের মেন্যু, সদা প্রস্তুত পর্তুগীজ মিষ্টান্ন, হোটেলের সামনে রাস্তা পেরিয়ে কয়েক ধাপ নীচে নেমে বাগান ঘেরা বিশাল সুইমিংপুল, জানালা দিয়ে দেখা কাছের পাহাড়ের বুকে বৃক্ষের শোভা আর দূরের সুনীল সমুদ্রজল, রাস্তার পাশে পাশে বিশাল গুড়ির আদ্যিকালের ছায়াঘন গাছের সারি, সমুদ্র সৈকতে পরিত্যক্ত পর্তুগীজ দুর্গ আর স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ, না কুড়ানো নারিকেলে গজানো চারাগাছ, বালির বিছানায় বীচ টাওয়েলে বিকিনি সুন্দরীদের রৌদ্রস্নান, খুব বড় বড় গাছে ঘেরা শানবাঁধানো খাবার হোটেল “ আমালিয়া “ র প্রাঙ্গণে ফুটে থাকা নাম না জানা ফুলের সুবাস, সেমেটারীর হরেক ডিজাইনের সমাধিসৌধের পাদদেশে প্রিয়জনের অর্পিত থোকা থোকা আসল - নকল বাহারি ফুল - সব মিলে ভিন্ন এক জগতের হাতছানি।
তিমুরের ভৌগলিক সীমারেখার একেবারে শেষ প্রান্তে কোম বীচের উঁচু পাথুরে পাহাড় ঘেরা জেটির পাশে পাথরেই তৈরি হোটেল কেবিনে রাত্রি যাপন, স্বচ্ছ জলের জন্য সুবিখ্যাত জ্যাকো আইল্যান্ডে ভ্রমণ, বহুবর্ণ তক্ষক - গিরিগিটীদের সাথে হঠাৎ সাক্ষাৎ, মেয়ে অদ্বিতীয়ার হুবহু তক্ষকের ডাক নকল করার মুগ্ধকর প্রতিভা, আকাশ ভরা তারার আলোয় ডিনার শেষে উত্তাল সমুদ্র পাড়ের পাকা রাস্তা ধরে হাঁটাহাটি, নদী থেকে খাবারের অভাবে সমুদ্রে চলে আসা কুমীরের ভয়ে সান্ধ্যকালীন নিত্য সৈকত পরিভ্রমণ বন্ধের আক্ষেপ, কয়েক মাইল জোড়া সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে পাহাড় চূড়ায় জেসাস ক্রাইস্টের দু’বাহু প্রসারিত খোলা সাগর পানে তাকানো স্ট্যাচু, মেঘ-বৃষ্টির লুকোচুরিতে বর্ণিল দ্বিস্তর রঙধনু — এইসব মিলে জীবনের পেয়ালা উপচিয়ে পড়া মাধুর্যের সুর-সুধাপান, ইচ্ছে করে মুঠিভরে ভাগ করে নিই তোমাদের সাথে। পরমাত্মীয়ের মতোন হাতখানি ধরে নিয়ে চলি সেই সে নিসর্গ নিঝুম নিমগ্নতার দৃশ্যপটে, যেখানে জীবন পেরিয়ে যায় যাপনের সীমাবদ্ধতার শোক অরূপের ঝিমধরানো নেশার হাতছানিতে। যাবে বলো এক রৌদ্রমুখর দিনে তুমিও সেই অবাক পৃথিবীর পথে?