রাসেল রায়হান এর দশ কবিতা

রাসেল রায়হান এর দশ কবিতা 
           তবে কি অন্ধকার জরায়ু থেকে আরেক অন্ধকারেই আসছে মানুষ?

নিদ্রা, সাপ ও মোহর

ঘুমিয়ে আছ অন্য কোনো পুরুষের পাশে,
আর আমার পা ছিদ্র করে ঢুকে যাচ্ছে
কোমল হরিৎ সাপ।
আমিও অন্য শহরে ঘুমিয়ে আছি,
অন্য নারীর পাশে। সে নারী
সাপ-সম্মোহনীবিদ্যা জানে না।
তার হাতে নেই আকিক পাথরের আংটি
কিংবা বাহুতে বাঁধা নেই দরবেশের তাবিজ।
ফলে সাপ আমার শরীর বেয়ে
মাথার নিকটে আসতে চায়।

এই যে ঘাস আর ঈষৎ হেলে পড়া টবের ফুল
হাসছে,
একলা সিগারেট টানছি বারান্দায়,
দূরে বিদ্রুপ ছড়াতে ছড়াতে
শ্লথ উড়ে যাচ্ছে একঝাঁক বাদুড়
শহরের বাইরে অশ্বথ গাছের নিকট,
রাস্তার হলুদ বাতিতে আটকে আছে
শত শত গাড়ি, সদরঘাটগামী ঘোড়াযুগল,
তাদের পেছনে ছড়ি হাতে ঘোড়ার মালিক
আর যাত্রীশূন্য গাড়ি
সকলই নিরর্থক মনে হয়।

তোমার উপহার দেওয়া চাবির রিং
হাওয়ায় উড়ছে,
তার আওয়াজ পৃথক করে দিচ্ছে
আমার ছায়াকে।
ছড়িয়ে দিচ্ছে তীব্রভাবে।
আমাকে পরিত্যাগ করে
তারা উড়ে যাচ্ছে তেপান্তরে,
কড়া রোদে সমুদ্রের গন্ধের দিকে,
আর অবধারিত অন্ধকারের জন্য কেঁদে মরছে
শশব্যস্ত শরীর।
আকাশে ছিটে ছিটে হোসেনের রক্ত
আর হাসানের কণ্ঠের রঙ
এই সব আয়োজনই নিরর্থক।

এই অসংযত চিহ্নগুলি ধরে
কোনো শক্তিশালী ডানার মানুষ
উড়ে বেড়াবে না কোনোদিন।
প্রখর রোদে তার ডানার ছায়ায়
দৌড়ে বেড়ানোর কাক্সক্ষাও নেই আর।

তুমি যাওয়ার পর
শিখে নিয়েছি ইনহেলারের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার।

আমার অর্ধেকটাই গিলে নিয়েছিল
তোমার নিষিদ্ধ ফলেরা,

সেই তীব্র স্রোত থেকে
বের হবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি।
নাড়াচ্ছি তোমাকে চুম্বন করা জিভ।
আর জানো তো, জিভ শুধু
সাপই নাড়ায় না,
ক্ষেত্রবিশেষে
সাপুড়েও সে বিদ্যা অর্জন করে।

আমি জানি, পাশে যাকে নিয়ে
ঘুমিয়ে আছি,
এই সাপ ধরার বিদ্যা তার আয়ত্তে নেই
তুমি চলে যাওয়ার পর
খসে পড়েছে যার নির্মোক।

টের পাই, নির্মোকবিহীন সাপ
উঠে আসছে আমার শরীর বেয়ে।
তুমি এই সাপ হলে
নির্দ্বিধায় নিজেকে নির্মোক বলা যেত
ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরে
আমি প্রবেশ করব গাঢ় নিদ্রায়।
জাগব না,
এমনকি মোহরের লোভ দেখালেও।
জন্মবধিরের আর মোহরের শব্দে বলো
কী-ই বা যায় আসে?

গন্তব্য

তবে কি অন্ধকার জরায়ু থেকে আরেক অন্ধকারেই আসছে মানুষ?

পথ ও দরবেশ

যাপন করব বলে ভাবছি, তোমার জীবন।
এই রঙিন কাচের এপাশ থেকে
বাইরে তাকালে মনে হয়
সমস্ত দিনই গোধুলি;
ওপাশে বাতাস মগ্ন হয়ে আছে।
ফুলগুলি নৃত্য করছে অরলা-মুদ্রায়, আয়েশে।
পাখির মুদ্রাগুলিও প্রায় ধরে ফেলি।
তাদের এই রাজহাঁসের মুদ্রা মানে যে ভগাঙ্কুর খুঁজে বেড়ানো
এটা কি সব দর্শক জানে?

শুনেছি, যেকোনো অজানা পথই জঙ্গলের দিকে যায়।
গন্তব্যে যাওয়ার আগে মনে হয় সূর্যের দিকে
মুখ করে আছে ধ্যানস্থ এক ধনুর্বিদ;
অথচ তার লক্ষ্য প্রতিটি অলস মানুষ।
ভুল ঘাসে পা রাখলেই এই প্রাথমিক ধ্যান
ভেঙে যাবে তার।
সে মানুষ জীবনে শেষবার শুনতে পাবে টঙ্কার।

তুমি হেঁটে যাও সমুদ্র বেয়ে আসা
নোনা বাতাসের গন্ধের দিকে।
গচ্ছিত টাকায় লেগে থাকা আঁইশ ছাড়াতে ভুলে গেছ,
আর ঐ আঁইশ লেগে যাচ্ছে তোমার বুকে।
এবার কি তুমি যাপন করবে কোনো এক জেলের জীবন?
তোমার পথ কি এখনো যাচ্ছে জঙ্গল অভিমুখে?

শুনেছি, গন্তব্যহীন সমস্ত জীবনই দরবেশের জীবন

পুনরায় মনোপলি

এই রাজকীয় শপিংমলের সামনে যে ভিখিরিনী দাঁড়িয়ে আছে       একদা কি
তারই দুধ পান করেছিলাম আমি?          তাকেই কবরে শোয়াতে গিয়ে টের
পেয়েছিলাম,     প্রিয় কারো মৃত্যুও একটি পিঁপড়ের কামড়কে অগ্রাহ্য করার
মতো শক্তি দেয় না?   তবে আজমির শরিফে হিজাব পরিহিত অবস্থায় দেখা
সেই নারী কে ছিলেন,       যার মুখের ভাঁজে আদি সমতল পৃথিবীর মানচিত্র
আঁকা ছিলযে পৃথিবী দাঁড়িয়ে থাকে জোড়াকচ্ছপের পিঠেআর তুরস্কের
গির্জা ধুয়ে দিত যে মহিলা রোজ,     তার মুখের সাথেও এই নারীর এত মিল
কেনকেন এই নারী হুবহু চব্বিশ বছর বয়সে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো
সোফিয়া লোরেনের মতন দৃঢ়?    আত্মহত্যার পাঁচ মিনিট আগের সিলভিয়া
প্লাথ, প্রথম ঘাগড়া পরার পর আটত্রিশ বছরের হুমা কোরেশি, সহসা একটি
প্রেমের কবিতার অনুবাদ ঠিকঠাক সম্পন্ন করা     সতেরো বছরের শিরিন,    
আর শেষ সুঁইটি তুলে ফেলার পর তেতাল্লিশ বছরের কাজলরেখার মুখই বা
কীভাবে ধারণ করেন তিনি?

...প্রসূতিসদনে আজ আমার স্ত্রী বুঝি পুনর্বার তাকে জন্ম দিলো

আবিদা খানমের গজল

আবিদা খানমের গজল  প্রিয় তোমার। রোজ  শুনতে  শুনতে ঘুমিয়ে পড়ো।
তার কণ্ঠ  শুনলে এমন  মনে হয় যে রিজওয়ান  ফেরেশতা স্বীয় ডানা দিয়ে
বাতাস করছে তোমায়একবার বলেছিলে শিরিন। তাদের প্রসারিত ডানার
হাওয়া খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ো রোজ। আর তোমার ঘুমের ভঙ্গি বড় বাজে,
শরীরে হাত-পা উঠিয়ে দাও। তার উপরে আবিদা খানম আমার পছন্দের নয়।

তীব্র গরমে আমি ঘামতে থাকি। ঘূর্ণায়মান  ফ্যানের দিকে  তাকিয়ে তাকিয়ে
সারারাত আবিদা খানমের গজল শুনি।
আর ঘামতে ভালো লাগতে থাকে আমার, আবিদা খানম ভাল লাগতে থাকে।

পাখি, দৈত্য ও শিরিন

সমস্ত বসন্ত নিজের ছবি আঁকার  নাম করে শিরিন  আঁকল আঙুরবাগানের
পাহারাদার দৈত্যটিকে, গত বসন্ত  থেকে যে  আর বেঁচে নেই। আমরা যখন
শিশু, মৃত্যুর আগে দৈত্য আমাদের একজোড়া কালো আঙুরের গল্প বলেছিল।
বলেছিল সেসব পাখিদের কথা, যারা উড়ে এসেছিল অপরের আঙুরবাগানে।
যেহেতু এই বাগান  দৈত্য পাহারা দেয়সুতরাং  নিজেকে অন্তত পাখিগুলির
মালিক ভাবতে ভাবতে  পরবর্তী শীত এসে  যায় আর পাখিগুলি উড়ে যায়
বসন্ত পর্যন্ত, পরবর্তী শীত পর্যন্ত।

মৃত্যুর আগে দৈত্য শিরিনকে বলেছিল, ‘বৃষ্টিকালীন উড়ন্ত উজ্জ্বল পাখির মতো
ঝকঝকে চোখ তোমার। তারপর  প্রতি বসন্তে শিরিন যখনই  কালো শরীরের
দৈত্যকে আঁকে, আমি তার চোখের দিকে তাকাই; দেখি, একজোড়া বৃষ্টিকালীন
পাখি পালিয়ে যাচ্ছে।

আংটি

শিরিন, নির্দিষ্ট এই ডালিমের সর্বোচ্চ সাফল্য তোমার হাতের ছুরিতে ফালি ফালি
হয়ে প্লেটে ছড়িয়ে যাওয়া। তার দানাগুলিও পাখির ডানার ভঙ্গিতেই ধারণাতীত
ক্ষিপ্র গতিময়তায় ছড়িয়ে পড়ে, যখন দেখে তোমার ওষ্ঠ ঈষৎ খোলা।

আর অব্যবহৃত  খোসাউচ্ছিষ্ট  হওয়াই যার নিয়তিনষ্ট হয়ে যাওয়ার পূর্বমুহূর্ত
পর্যন্ত তার স্মৃতিতে থাকে তোমার বিনিদ্র দশটি আঙুল, আর অনামিকায়
বিবাহকালীন আকিক পাথর বসানো আংটি

টেলিফোন বুথ

বান্ধবীদের কেউ আমার বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলেই বলি আমলাপাড়া এসে
পরিত্যক্ত লাল টেলিফোন বুথটা খুঁজে নিবি। ডান পাশের বাড়িটাই আমার।
সোজা ঢুকে যাবি।
বাড়ির কাছাকাছি এসে সবাই আগে লাল একটি টেলিফোন বুথ খোঁজে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমি দেখি, একটি পরিত্যক্ত লাল টেলিফোন বুথ
আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে।

পদার্থবিজ্ঞান

পদার্থবিজ্ঞানে পাস করা এক ছাত্রের রাত বারোটায় শহরের বাইরে বাসার কাছে 
নেমে মনে হলো, আজ কারও জন্মদিন। 
সব দোকান বন্ধ। শুধু এক রুমালবিক্রেতা তখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছে 'রুমাল রুমাল
বলে। কাকাতুয়া, ময়ূরসদৃশ একেকটি উড়ন্ত রুমাল কিনতে গিয়েও সে কিনল না। 
...রুমাল দিলে সম্পর্ক ভেঙে যায়


সুফি, মাহুত, সুবেহ তারা

মাগরিবের পর পর রাতে
আমরা হেঁটে যাব সুফির ডেরায়

তার আগে বলো সুবেহ তারা,
কত অধঃপাতে নেমেছিলে?
এই যে অভিজ্ঞ মাহুত,
সেও কি নেমেছিল

জরায়ুতে স্রোত নেমে এলে যে নাশপাতিগর্ভে
প্রবেশ করেছিলে,
সেটি কতটা লঘু ছিল?
তার ডাকে এতটা ভয়ার্ত সাড়া কেন ছিল তোমার

পদক্ষেপ ধীর করো।
আরও ধীর।
প্রলম্বিত লয়ে ডেকে যাচ্ছে
ক্ষীণ্ন যে ঝিঁঝিঁ,
তার ভাষা বোঝো।
সেই সুখী ধনুর্বিদ হও,
তির ছোড়াতেই যার সমূহ আনন্দ।
মৌমাছির বাসার দিকে তির ছুড়লে যার তির
সোনার গম্বুজ ভেদ করার সাহস দেখাতে পারে।
তারপরই কোনো পরিজনহীন
সাক্ষাৎ পায় এই সুফির

সুবেহ তারা,

তার আগে বলো সেই ম্রিয়মাণ মাহুতের নাম



SHARE THIS

Author: