করাতকল
বিবিধ গন্তব্যের দিকে হাঁটি,একই সাথে, সন্ধ্যার আজানের মতো ধীরে ধীরে কেঁপে কেঁপে, যেদিকে যাই,যত পথে যাই,অসংখ্য করাতকল অবিরাম কাঠ চেরাইয়ের শব্দ শুনি সমস্ত দুপুর, চেরাই হচ্ছে দিনমান লেবু আর আঙুরের কাঠ, মৃদু,মৃদুতর আর ও কত গুঞ্জন,বিঁধে থাকে ভাবনায়, মগজের ম্যামব্রেনে,ডুবে থাকি ক্রমাগত শব্দের ভেতর, আর এইভাবে চিরকাল রয়ে যাই অলস ইচ্ছার অধীনে,
তবে কি,প্রচলিত সব পথই গিয়েছে বহুতল সমাধির দিকে?
মুখোশ
কে জানে লোকোত্তর এই ডানার উড়াল
কতদূর নিয়ে যাবে আমাদের দিনশেষে
নিরন্তর এই সৌর-ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে হয়ে
তবু কেন বয়ে বেড়াই নিষ্প্রাণ ছায়াটির শব
নিশ্চুপে পেরিয়ে ছায়াঘন অলিভ বাগান
এসো আজ স্থির হই নিজ নিজ ঘুমে
প্রশ্নের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার আগে
জিজ্ঞেস করে জেনে নেবো বিবিক্ত আঙুলের পরিচয়
যেহেতু অচেনা মুখোশের নিচে পড়ে থাকে
আরও অজ্ঞাত আমাদের মুখ
চিরকাল দেখেছি শতচূর্ণ আয়নার বিভ্রমে
স্বর্ণশৃঙ্খলে বাঁধা কেবলই আমাদের আত্মা
দূরাগত মুসাফির পাখির মত
হাতঘড়ি
বস্তুত, শূন্যতা অসম্ভব নয়,এই ভেবে
আরও ঘনিষ্ঠ হতে চাই বহমান সময়ের সাথে
খুব ধীরে 'কিছু নেই' থেকে সবকিছু
অপার হাওয়ালোকে ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে
অস্ফুট আলো ও সুর,মৃদু তরঙ্গের মতো
আমি কি তবে অস্ফুট আলো,অজানা?
মহাশূন্যে বেজে উঠা অশ্রুত গান?
যখন জন্মায়নি সময়,তারও বহু আগে
সৃষ্ট কেবল এক বিকল হাতঘড়ি
নেড়ে চেড়ে দেখেছিল প্রিয় ফেরেশতারা।
গমক্ষেতের স্মৃতি
( অনুপম মণ্ডল কে:-নিকটতম দূরের বন্ধু)
বিলীন কোন ভাবনার মতো ম্লান একেকটি বিকেল,
স্থির,হাওয়া এসে নাড়িয়ে যায়,নাশপাতি বনে,
কখনো হাতি আসে শিশুদের শহরে,
বেদনা মন্থনকারী উজ্জ্বল ঐরাবত,
তার অন্ধ মাহুতের খুঁজে,আনমনে হাঁটে,
গলার ঘুঙুর বাজে দিনমান,টুংটাং টুংটাং.
. ঘরে ঘরে ছড়ায় যেন ঘুমের জাদু।
যতটা সম্ভব ঝুঁকে থাকি মাটি ও ছায়ার দিকে,
অচল আধুলি হাতে যতবার গিয়েছি অন্ধকার রুটিদোকানে,
দেখেছি ধূলির মত করে উড়ে শুধু পুরনো যবের দানা,
আর উপকথার মতো মানুষের মুখে মুখে ফেরে
বিগত গমক্ষেতের স্মৃতি।
জাদুকর শহরে, হাতি তবু বার বার আসে
তার অন্ধ মাহুতের খুঁজে...
দুপুর বিষয়ক
যেন বহু স্বপ্নজালের অন্তরালে লুকানো
নির্জন নিদ্রিত কালো ফ্রক,
গোপনে তবু দেখে ফেলি
মিহিন সেলাইয়ের ভাঁজে জমানো
চৈত্রের মেঘ,পরিযায়ী পাখিদের দিনলিপি,
আর রেশমের উড়নাটি,একাকী উড়ে যাচ্ছে
ঘ্রাণচূর্ণ দুপুরের রোদে,ঈষৎ দুলে দুলে,
এইসব পরা-দৃশ্য পরোক্ষে দেখি ফেলি তবু,
পড়ন্ত পাতার ছায়ায় ফণা তোলা মনসার ঘুম,
যেন কেউ মুছে দিয়েছে আকাশ- বিস্তীর্ণ ডেটলাইন
আর পৃথিবী ঢেকে যাচ্ছে এই উদাস চির-রবিবারে!
এলিজি ও দীর্ঘবর্ষা
এই বিপন্ন বর্ষাতির নিচে মেঘে ভিজে ভিজে
কেটে গেছে আমাদের দীর্ঘ বর্ষার দিন,
ক্রুশকাঠের কফিনে পেরেক ঠুকার শব্দ শুনে শুনে
ক্রমশ সজীব হয়েছে কবরখানার ঘাস
এপিটাফ লিপির শোকার্ত অক্ষরমালা,
অবিরাম বর্ষণদিন শেষে,হাওয়ার ঘূর্ণনে ভাসে
মরফিন ঘ্রাণ,নতুনত্বর শব,শবযাত্রার ধনি
নিগূঢ় আর্তনাদ হয়ে উঠছে বেজে
আর দেখো,আমাকেও এই দীর্ঘ বর্ষার দিনে
প্রাণপণে খুঁজে ফেরে মৃত্যুদূতের ঘোড়া
কেশর ফোলানো হাওয়ায় তার ছড়ানো হ্রেসারবে
কেঁপে উঠি বারবার,নিজেকে হারানোর ভয়ে,
ভাবি,মৃত্যুকে স্বাগত জানানোর মত সুন্দরতম
দিন কি এসেছে কভু আমাদের,জেসাস!
জন্মান্ধ
এই চির মৌনতা গম্ভীর পাহাড়ের স্বভাব
প্রার্থনার নতভঙ্গিই যার একমাত্র ভাষা
নিজেকে সমর্পণ করি এইভাবে,
যেন কোথাও যাওয়ার নেই,ছিলওনা কোনদিন,
চিরায়ত ভ্রমণ মূলত নিজেরই ভেতর,
পৃথিবী ব্যাপ্ত এক দুপুরের দেবদারু বন,
দিনমান পাতার মর্মরে বাজে অপার ভায়োলিন,
শোনো,আরো কোন এক লোকোত্তর গানের সুরে
ধীরে ধীরে বধীর হয়ে পড়ছেন বিঠোভেন,
নিজের মতো করে কিছুই দেখিনা আর,
হে জন্মান্ধ পাথর,কালোর চেয়ে গভীর
কোন রঙ নেই আর পৃথিবীতে,
যদি পারতাম,সহস্র নক্ষত্রের আলো জ্বেলে দিতে
তোমার চির অন্ধতায়! চির স্তব্ধতার ভেতর!
প্যাগাসাস
ডুবে যাচ্ছে সূর্য,পাখিদের ব্যবহৃত উড়ালপথ,
আমিও ডুবছি খুব বিষণ্ণ কোন গানের ভেতর,
ওই লোহিত অস্তদৃশ্যের এতটা কাছে যেয়না
হে দুরন্ত উড্ডীন প্যাগাসাস,
যেকোনো আভা আমাকে অন্ধ করে দেয়
কিংবা খসে পড়বে তোমার স্বর্ণ-ডানা,
বরং থামো,এই অসুস্থ বিকেলের ভেতর,যখন
তারও চেয়ে গভীর কোন অসুখেস্থির হয়ে আসে
আমাদের প্রাণ,গাঢ় কোন বেদনার মত,
নড়বড়ে সাঁকোগুলো পেরোতে পারবনা কোনদিন,
যেমন মানুষেরা যায়,যেতে যেতে ভেঙেপড়ে,
হায়,অক্ষম ইচ্ছার নেই কোন অবসান!
প্যাগাসাস,দেখো দূর অলিম্পাসের স্বর্ণ চূড়া,
হারিয়ে যাচ্ছে এক ঘোলাটে রাত্রির ভেতর!