প্রবন্ধ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
প্রবন্ধ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
কি লেখছেন কিছুইতো বুঝি নাই, এইটা কবিতা? ।। দেবাশীষ মজুমদার

কি লেখছেন কিছুইতো বুঝি নাই, এইটা কবিতা? ।। দেবাশীষ মজুমদার

যেই মানুষ কবিতা লেখে লোকে তারে কবি কয়, এখন কথা হইল কোনোভাবে দুই চাইরটা লাইন হাবিজাবি লেইখা ছাইড়া দিলেই কি কবি?  আরে এই ভারতীয় চুল মার্কা কী সব লেখে কিছুইতো বুঝি না।
ইদানীং এইরকম কথাবার্তা প্রচুর শুনা যাইতাছে। এখন এই যে আপনে এই কবিতাডা বুঝলেন না, তার মানে কী দাঁড়াইল? এই লেখক কবিতা বইলা যেইগুলা গিলাইবার চেষ্টা করতাছে সেইগুলা আসলে মোটেই কবিতা হয় নাই, তাই তো? আবার এমনও হইতে পারে না যে - আপনে আসলে কবিতা পাঠের কোন যোগ্যতাই রাখেন না? জ্বী, ঠিকই পড়ছেন, যোগ্যতা তুইলা কথা কইছি। কী কইলেন - আপনের টাইম নাই?  তাইলে হুদাই আপনে কবিতা পড়তে আইছেন ক্যান,  অন্য কামে যান, সইরা খাড়ান, হাওয়া আসতে দ্যান।
সেই ছোট বেলায় পাঠ্য বইয়ে পড়েন নাই, কবি আল মাহমুদ চেতনার মণি বলতে কি বুঝিয়েছেন?
  
‘আর ত্রাস দেখিয়েই করবে ভাবছো বিধির শক্তি হ্রাস!!’ -  বিদ্রোহী কবি এখানে “বিধি' বলতে আসলে কি বুঝিয়েছেন? 

এইগুলা পড়ছেন তো, ক্যান পড়ছিলেন, খালি পরীক্ষায় পাশ করনের লাইগা? কবিতা পড়ার, কবিতা বুঝার একটা প্রাথমিক ট্রেনিং আপনেরে দেয়া হইছিল তো। সেইসব আছিল সৃজনশীলতার ট্রেনিং। কিন্তু খালি পরীক্ষার খাতায় নম্বর তুলনের লাইগা আপনি মুখস্ত করছিলেন, আদতে শিখেন নাই কিছুই। এখন আমি এইরকম কইলে আমার দোষ?  আমি খারাপ, অহংকারী, আঁতেল ভং ধইরা আছি, আসলে ভিতরে কিছু নাই, মাকাল ফল – এই তো?  



আপনে কইবেন – ক্যান! আমি অমুকের কবিতাতো বুঝি, উনি সহজভাবে সবকিছু লেখেন, সব একদম ফকফকা। আপনের কবিতা দুর্বোধ্য, বহুবার পইড়াও কোন মর্মোদ্ধার করা যায় না। আসলেই কি বহুবার পড়ছিলেন? সাহিত্যিক  ডেভিড ফস্টার কি কইছে দেখেন- 

‘সাহিত্য শুধু মগজের বস্তু নয়, হৃদয়েরও এবং অনুপাতে হৃদয়ের ভাগটাতেই বেশি পড়া উচিত’

ব্যাপারটা এই রকমই, কবিতাও আপনে খালি চোখ বুলাইয়া গেলে হইব না তো, হৃদয় দিয়া অনুভব করতে হইব। আসলে পাঠক হি্সাবে আপনের উপর আমি ক্ষোভ ঝাড়তাছি না, কারণ হইলো, এই যে আপনের না বুঝা, বা না বুঝতে চাওয়া এর লাইগা দায়ী আমগো বর্তমান দিনকাল। আমরা এখন সব কিছু সহজে চাই, শর্ট কাট চাই। প্রযুক্তি চাইপা ধরছে জীবনডারে, সৃজনশীলতা কইমা গেছে মানুষের। হ মানে আপনের এত ভাইবা কাম কী স্যার, আপনে নাকে তৈল দিয়া ঘুমাইয়া থাকেন, আপনের হইয়া আমরা ভাইবা দিতাছি – বিজ্ঞাপনগুলাতো এই রকমই, তাইনা? সব চাইতে বড় কথা মানুষেরতো এখন এত সময় নাই, আলাদা কইরা কবিতা নিয়া ভাবার। লাইফে সফল হইতে হবে, এখন এই সফলতা যে আসলে কি বস্তু এইটা কেউ জানে না, তাই ছুটতেই আছে। এর মইধ্যে আবার দিনের একটা বিরাট সময় যায় ফেসবুকে এরে তারে লাইক, হাহাহা, মন খারাপ, ইশ দুঃখ পাইছি এইসব কামে ব্যয় করতে হয়। হাতে একটু বেশী সময় থাকলে – আহা দারুণ লেখনী, বাহ কি সুন্দর, আপনের তুলনা নাই এইসব লেইখা দায় সাইরা ফেলতে হয়। এই এতো ব্যস্ততার মইধ্যে মনোযোগ দিয়া কবিতা পড়নের টাইম কই! কথা সত্য, আসলেও নাই। তাইলে, দোষ কার? সময়ের, সফলতার, লড়াইয়ের, নাকি শুধুই কবির?

এই সব ইন্টারনেট, ফেসবুক ইত্যাদি আসার আগে অবস্থাটা কি আছিল? যারা কবিতার পাঠক তারা বই টই কিন্যা কবিতা পড়তো। পইড়া আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-কষ্ট এইসব অনুভব করবার চেষ্টা করতো। কখনো হয়তো কোন প্রিন্ট ম্যাগাজিনে বা পত্রিকায় সেই কবিতার রিভিউ বাইর হইতো, কিংবা কবিরই কোন সাক্ষাতকারে সেই কবিতা নিয়া আলোচনা হইতো। আর এখন হইল ডাইরেক্ট একশনের যুগ, কবি কবিতা লেইখাই তার ফেসবুক ওয়ালে এইটা টাঙ্গাইয়া দিতাছে, পাঠকও তাড়াতাড়ি পইড়া লাইক কমেন্ট কইরা ফটাফট জানাইয়া দিতাছে তার প্রতিক্রিয়া, পুরাই তিনমিনিটের ম্যাগী ইনস্ট্যান্ট নুডলস। তো এই ঝটপটের যুগে কোন কবির কোন দিন সময় খারাপ গেলে সেইদিন কোন কোন পাঠক এইরকম মন্তব্য কইরা বসে -  কি লেখছেন কিছুতো বুঝি না। হইয়া গেল, এইবার বাকিটা ইনবক্সে - এ তারে কবে, এই লোক কি লেখে কিচ্ছু বুঝছ? সে ওরে কবে, আর কইস না, কি সব লেখে সব মাথার উপ্রে দিয়া যায়। আবার ও কয়, কিন্তু তুই দেখলাম লাইক দিছস। সে কয়, আহা লাইকতো এমনেই সবাইরে দেই, যা সামনে পাই তাতেই লাইক দেই। কিন্তু তুইতো দেখলাম, কমেন্ট করছস। ও হেহেহে কইরা হাইসা কয়, আরে ধুর, হুদাই কমেন্ট করি, পাম্প দেই আর কি একটু, বুঝোস নাই! এই কবিতার দুর্বোধ্যতার ইস্যুটা এখন বার্নিং ইস্যু। প্রতিদিন এই কেইস ঘটতাছে, প্রতিদিন নতুন নতুন ঝগড়া, মন কষাকষি চলতাছে। এইটার দায় কার? কবিরা না পাঠকের – এই বিতর্ক চলতেই থাকব অনন্ত কাল। এই ভেজাল আগেও আছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
এই দুর্বোধ্য ব্যাপারডা আসলে কী? মানে কোন শব্দ বোঝা যাইতেছে না, অর্থ জানা নাই? হইতেই পারে, বাংলা ভাষায় প্রচুর সমার্থক শব্দ আছে, এখন পাঠকের যেইটা জানা নাই, তিনি সেইটা জাইনা নিলেইতো ল্যাঠা চুইকা গেল। হ তার কিছুটা খাটনি করতে হইব, কিন্তু এই খাটনির ফলতো ভাল, একটা নতুন শব্দ শেখা হইল। আবার এমনওতো দেখা যায় সহজ ভাষায় একটা কবিতা লেখা হইল কিন্তু তার মর্ম কঠিন, মানে সহজ ভাষায় বিমূর্ত একটা কবিতা। এখন পাঠক যদি আইসা বলে এইটাতো কিচ্ছু হয় নাই, প্লেন রে আপনে ধাতব পাখি বলছেন এইটুকু বুঝছি, কিন্তু প্লেন রে প্লেন বললেইতো পারতেন। আর এইটাতো তাও বুঝছি, কিন্তু বাকি যে কি বুঝাইতে চাইলেন কিচ্ছুইতো বুঝি নাই। বুঝাইয়া বলেন। কবিতাতো কোন কালেই এক রকম আছিল না, কবিতা আধুনিক হইছে যুগে যুগে এইটা না বইলা বলা যাইতে পারে কবিতা সমকালীন হইছে, যুগের সাথে তাল মিলাইয়া কবিতা তার কলেবর বৃদ্ধি করছে এবং এখনো নতুন নতুন সৃষ্টি হইতাছে।



কবিতার দুর্বোধ্যতা নিয়া কথা বলতে গেলে আরও কিছু বিষয় নিয়া ভাবতে হইব। এই দেশে কবিতা প্রেমীও যেমন আছে আবার কবিতা নিয়া তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবার মানুষেরও অভাব নাই। কবিতো সমাজে এক হাস্যকর মানুষ, মানে যারে দিয়া কিছু হইতাছে না, সে-ই ছ্যাঁকা খাইয়া কবিতা লেখে। বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মানুষরে কিন্তু এতোটা তাচ্ছিল্য করা হয় না, যতোটা কবিতা লেখকরে করা হয়। এখন সেই সমাজে কবিতা দুর্বোধ্য লাগাটা বিরাট আশ্চর্যজনক কোন ঘটনাতো না। এই দেশের বেশীরভাগ কবিই লুকাইয়া কবিতা লেখা শুরু করে, লজ্জায় প্রথম দিকে কাউরে দেখাইতে পারে না, কারণ, সেই একটাই, কবিতা লেখে ফালতু লোক। সমাজে এইটা একটা প্রতিষ্ঠিত ব্যাপার। তার পরেও যে এত এত কবিতা লেখা হইতেছে, এইটা বিরাট আশার ব্যাপার। 

নান্দনিকতা মানুষের বুকের ভিতর থাকে। তারে চাইপা রাখা যায় না, এক সময় ঠিকই সে পাখা মেলে।

কোনটা কবিতা হইল আর কোনটা কবিতা হইল না এই বিচার কে করবে? কবিতা লেখা যেমন কবির মননশীলতা, রুচি, পাঠ ইত্যাদির উপর নির্ভর করে, তেমনি পাঠকেরও এইসমস্ত গুণ থাকাটাইতো কাম্য। ফেসবুকের কল্যাণে এখন সবাই কবি – এইটাও একটা বহুল আলোচিত বিষয়। কাকের সংখ্যার লগে কবির সংখ্যার তুলনা এই দেশে একটা বহুল জনপ্রিয় বিষয়। আমি কই কি, হতাশ হবার কিছু নাই। হ্যাঁ প্রচুর লেখালেখি হইতাছে, মান ও পরিমাণ দুইটাই এক লগে বাড়তাছে কিন্তু। সত্য হোক মিথ্যা হোক কোন কোন প্রশংসায় - উৎসাহে, একজন নতুন লেখক পরবর্তীতে আরও পড়াশোনায় মনোযোগী হইতাছে, উদ্ভাবনের নেশা চাইপা ধরতেছে তারে, সেও নিজেরে নিবেদিত করতেছে কবিতায়। বৈচিত্র্য বাড়তেছে, নবীনরা আইসা দারুণ দারুণ সব কবিতা লেইখা ফেলতাছে, পুরানরাও সেই নতুনের সাথে মিশ্যা আরও নতুন সৃষ্টিতে মুখর হইতাছে। ব্যতিক্রম যে নাই তা না, কেউ কেউ গেল গেল রব তুইলা ফেলতাছে। যেন কবিতা বিরাট উচ্চবংশের জিনিস, আর তাতে অচ্ছুতের পা পড়ছে। এরা আসলে ফুরাইয়া গেছে, এই তর্ক আরেকদিন। আশা যেমন আছে, শঙ্কাও আছে। নতুনদের মধ্যে অনেকে কয়দিন পরেই নতুন সৃষ্টির চাপ সামলাতে না পাইরা ঝইরা যায়। আবার কেউ কেউ মেকি প্রশংসায় অন্ধ হইয়া পরবর্তী ধাপে যাওনের লাইগা যতটা শ্রম এবং সময় দেয়া দরকার সেইটারে অর্থহীন মনে করে। একটা আমি কি হনূরে ব্যাপার আর কি, কি আর করা যায়, যুগটাই এমন, শো অফের, হ্যাঁ ভাই এইতো এই দিকে, এই যে আমাকে দেখুন, আমিই সেই...... জীবনানন্দ দাশের সেই উক্তিতো আর বৃথা যাইতে পারে না, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’।

উপরে যা লেখলাম সেইটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা, এর দ্বিমত থাকতেই পারে। মোদ্দা কথা হইল আমি এইভাবেই কবি, কবিতা আর পাঠকরে নিয়া ভাবি। আমার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি মিল্যা যাবে এমন দুরাশা আমি করি না।


কবিতার জয় হোক।
একাত্তরের বীরত্বগাথা ।। ক্ষোভ ও কষ্টের কথা

একাত্তরের বীরত্বগাথা ।। ক্ষোভ ও কষ্টের কথা

বীর মুক্তিযোদ্ধা নুর হোসেন
হাই কোর্টের রায় প্রাপ্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা
ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নং ৩৯৪৬২১৮,ভারতীয় তালিকা নং:১৯২৯৬

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের দুই (০২) তারিখে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হরিনা আর্মি ক্যাম্পে ভর্তি হই। সেখানে দেড় (১.১/২)মাস প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ১নং সেক্টরের অধীনে ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন এনাম, ক্যাপ্টেন সামছুল হুদা মেজর রফিকুল ইসলাম এবং ল্যাপটেন্যান্ট ফারুখ এর নেতৃত্বে যুদ্ধের সবগুলো অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। বাংলাদেশ ভারত বর্ডারের পাশাপাশি ভারতের সাবরুম বাজার, মনু বাজার ও হরবাতলী এই তিন জায়গায় আমাদের ক্যাম্প গঠন করা হয়। সেখানে আমরা ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন এনাম, ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা, লেপ্টেন্যান্ট ফারুক, হাবিলদার মেজর নুরুল আলম, সুবেদার হাফিজ ও হাবিলদার সেরে বিল্লাল সহ এদের নেতৃত্বে আমরিঘাট, আন্দার মানিক, বাগান বাজার, হলদিয়া ডেবা, ছিকনছরা, রামগড়, তবলছড়ি, বিলাইছড়ি, কালাপানিং, ফংবাড়ি, চামলাইশ্যা, কইলা, কাঠাঁলছড়ি, ও চা বাগান সহ বিভিন্ন জায়গায় পাকবাহিনীর সাথ সম্মুখ যুদ্ধ করি। প্রায় সময় আমার নিজ নেতৃত্বে অপারেশন হতো। আমরা আমাদের ক্যাম্প হতে সন্ধ্যায় ৫টা-৬টা এবং বেশির ভাগ সময় ভোর ৩টা -৪টায় শত্রুপক্ষকে তছনছ করে দিতাম। পরে সিভিলিয়ানদের কাছে জানতে পারতাম যে এতে অনেক পাকবাহিনী নিহত ও আহত হয়েছে এবং আরো বিভিন্নভাবে খবর পেতাম যে, রাজাকার আলবদর, আলশামস, মুজাহিদরা হানাদার বাহিনীর কাছে বিভিন্নভাবে তুলে দিত আমাদের মা- বোনদেরকে। কোন অপারেশনের পূর্বে আমরা যখন পাঞ্জাবীদের অবস্থান সনাক্ত করতে ১০-১১ টার দিকে সিভিলিয়ান সেজে রেকি করতে যেতাম তখন দেখতাম স্কুল কলেজ পড়ুয়া ঐ ধরনের মেয়েদেরকে শুধুমাত্র আন্ডার ওয়ার পরিয়ে গোসল করাতে নিয়ে আসত। এই রকম আরো অনেক ঘটনা আছে যা বলে প্রকাশ করার মতো নয়। ঐ রাতে আমরা পাকবাহিনীর উপর ত্রিমুখী হামলা চালাইল তখন অনেক পাকবাহিনী আহত ও নিহত হয়। অনেক সময় আমরা কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে এম্বুসে থাকতাম। পাকবাহিনী যখন আমাদের জায়গায় উপস্থিত হত তখন আমরা একদিক থেকে হামলা চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিতাম। সেখানে তাদের অনেক সৈন্য নিহত হতো। যুদ্ধকালীন সময়ে হাবিলদার সেরে (বিল্লারের) নেতৃত্বে আন্দার মানিক স্থানে একটি এ্যাম্বুস বানাই। সেখানেও পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয় এবং ৭ জন পাঞ্জাবী নিহত হয়। এর কয়েকদিন পর আমরা সেখানে আবার এ্যাম্বুস বসাই। তখন ঐ এ্যাম্বুসের কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন হাবিলদার মেজর মজিবর। কিন্তু ঘটনা চক্রে হাবিলদার মেজর মজিবর সেখান থেকে পালিয়ে যায়। তখন সেখানে আমরা নিজ নেতৃত্বে যুদ্ধ হয়। ঐ ঘটনার কারণে কিছুদিন পর ক্যাপ্টেন শামশুল হুদা শহীদ হন। আমরি ঘাট নামক স্থানে আমরা একটি এ্যাম্বুস বসাই। সেখানে কয়েকজন পাঞ্জাবী নিহত হয়। সেখান থেকে একজন পাঞ্জাবীকে মৃত অবস্থায় মুনবাজার ক্যাম্পে আনা হয়। এভাবে এ্যাম্বুসে অনেক জায়গায় পাঞ্জাবীদেরকে মারা হয়। একদিন ক্যাপ্টেন মাহফুজ আমাদেরকে ডেকে বললেন যে, ছিকন ছড়ায় যদি কোন এ্যাম্বুস বসানো হয় তাহলে আমাদের কোন জওয়ান ঐখান থেকে ফিরে আসতে পারবেনা। কারণ নকশা অনুযায়ী ঐ জায়গাটা ছিল খুবই বিপদজনক। তখন লেঃ ফারুক সুবেদার হাফেজ সাহেবকে বললেন, ঐ ছিকন ছড়ায় আমার জওয়ানেরা এ্যাম্বুস বসাবে। কিন্তু সুবেদার হাফেজ সাহেব তাহা প্রত্যাখ্যান করলেন। প্রত্যাখ্যানের পর লেঃ ফারুক তাহা মানলেন না। তখন লেঃ ফারুকের নির্দেশে আমি হাবিলদার মেজর নুরুল আলমকে ডেকে আনলাম। অবশেষে হাবিলদার মেজর নুরুল আলম তার প্রস্তাব মানলেন। তখন আমরা বিকাল ৫টার দিকে ছিকন ছরার দিকে রওনা হলাম এবং খুবই গোপনে ও সতর্কভাবে এ্যাম্বুস বসাইলাম। আমাদের সাথে দুইজন সিভিলিয়ান ছিল। তারা আমাদেরকে পথ দেখিয়ে দিত। আমরা যে রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করেছিলাম ঐ রাস্তায় আমাদের পায়ের চিহ্ন দেখে হানাদার বাহিনীরা আমাদের ঘেরাও করে ফেলে। কিন্তু সেটা আমরা জানতাম না। যখন আমাদের উপর ত্রিমুখী হামলা শুরু হয় আমরা নিরুপায় হইয়া এ্যাম্বুস রাখিয়া একটি খামার বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। তখনও ত্রিমুখী হামলা চলছিল। তখন বুঝতে পারি যে, পাকবাহিনী আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। সেই দিন আমার সাথে হাবিলদার মেজর নুরুল আলম, আবুল মনসুর, আজিজুল হক বামনসুন্দরের বেলায়েত সহ আরো ১১ জন যোদ্ধা ছিল।

আমরা তখন বাঁচার কৌশল অবলম্বন করি। পাকবাহিনী যে পাহাড়ের যে ক্যাম্পে ছিল আমরা ঐ পাহাড়ের গোঁড়ায় আশ্রয় নিলাম। সেখানে দুরাত একদিন পাকিস্তানিদের ঘেরাওদের ছিলাম। সারাদিন সেই স্থানে থেকে রাত্রে ঐ জায়গায় জলিল নামের একজন লোক আসিয়া আমাদেরকে রাত্রের অন্ধকারে পথদেখাইয়া দেন এবং ভারতের মনু বাজার ক্যাম্পে পৌছাঁইয়া দেন। এর কয়েকদিন পর আমাদেরকে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের স্বীকৃতি দেয়। তখন আমরা বাজারে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে বাংলাদেশ প্রবেশ করি এবং বাংলাদেশের শুভপুর ব্রিজ, ছিনকি আস্তানা, জোরারগঞ্জ, মিরসরাই সহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করি।
বাঁশবাড়িয়া হইতে কুমিরা ঘাঁটঘর ও কুমিরা টিবি হাসপাতাল এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে আমাদের মুখোমুখি শেষ হয় যুদ্ধ হয়। সেই ১৪ই ডিসেম্বর। আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে হয়ে বাংলাদেশ আক্রমণের লক্ষ্যে তাদের সপ্তম নৌবহর নিয়ে বাংলাদেশের একটি সাগরে (যেটাকে আমরা বার সাগর বলতাম) অবস্থান নেয়। ঠিক ঐদিনই রাশিয়া তাদের অষ্টম নৌবহর নিয়ে সেখানে আসে। ফলে আমেরিকা আক্রমণ না করে ফিরে যায়। আর যদি রাশিয়া তাদের অষ্টম নৌবহর নিয়ে না আসত তাহলে আমেরিকা বাংলাদেশের উপর আক্রমণ চালিয়ে যেত। সেই দিন পাক বাহিনীর সাথে আমাদের বিমান হামলা, ট্যাংক হামলা সহ তুমুল যুদ্ধ হয়। সেইদিন আমাদের প্রায় ১৫০-২০০ গজ পিছনে থাকা মিত্র বাহিনীর ১৫০-২০০ সৈন্য নিহত হয়। এটি ছিল আমাদের স্মরণীয় যুদ্ধ। সেদিন আমিও মারাত্মক ভাবে আহত হই এবং আমাদের অনেক সৈন্যও আহত-নিহত হয়। সেদিন আমাদের ২(দুই) জন সৈন্যও শহীদ হন।একজন শহীদ কামাল অন্য শহীদ আবুল কালাম। তার দুইদিন পর অর্থাৎ ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

সাব সেক্টর-৩ এর ক্যাপ্টেন এনাম, ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন শাসসুল হুদা ও ল্যাপ্টেন্যান্ট ফারুখ এদের কমান্ডে মুনবাজার ক্যাম্প, হরবাতলী ও সাবরুম বাজার (চার বাগান) ক্যাম্পে ছিলাম। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসনেও সাব সেক্টর-৩ এ মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্বে ছিলেন।
যুদ্ধের ৪০ বছর পর এখন অনেক ঘটনাই মনে নেই, যা আছে তা লিখেও শেষ করা যাবে না।


বিভিন্ন তালিকায় আমার নম্বর গুলো দেওয়া হলোঃ মুক্তিবার্তা নং- ০২০৩০৪১০৭৯, গেজেট নং- ৪৬৩৪, ভারতীয় তালিকা নং- ১৯২৯৬, ই-বি নং- ২১৮, যুদ্ধকালীন ক্রমিক নং- ১০৭১, ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নং- ৩৯৪৬২১৮, সেনা গেজেট নং- ১৩৯৪১, যুদ্ধাহত গেজেট নং- ২২৯৫।
কিশোর স্মৃতি ।। ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ ।। মীরসরাই হানাদার মুক্ত দিবস

কিশোর স্মৃতি ।। ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ ।। মীরসরাই হানাদার মুক্ত দিবস

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ

তখন আমার বয়স ১২-১৩ বৎসর। ১৯৭১ এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসের অগ্নিঝরা দিনগুলিতে সৈদালী গ্রামসহ বড়তাকিয়া এলাকায় সংগঠিত ঘটনাবলি এখনো স্মৃতিতে অম্লান। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে বলেন। শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও দেশকে শত্রু মুক্ত করার জন্য আহবান করেন।বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশে আরম্ভ হল কৃষক- শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, আনসার পুলিশ, ইপিআর এর প্রতিরোধ। মীরসরাইয়েও বিভিন্ন স্থানে সড়ক মহাসড়ক ছাত্র-জনতা কৃষক-শ্রমিক অবরোধ সৃষ্টি করে লাঠি ছুরি দা সড়কি ইত্যাদি দেশিয় অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। 
বড়তাকিয়া দক্ষিণ বাজারে আবুতোরাব রোড়ের সংযোগ স্থলে গাছের বড় বড় ডাল কেটে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়। লাঠি সোটা দা ছুরি ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্রসস্ত্রসহ পাকিস্তানী হায়েনা হানাদারদের প্রতিরোধ এগিয়ে আসেন সৈদালী গ্রামসহ খইয়াছড়া দুয়ারু, মায়ানী ও মগাদিয়ার প্রতিবাদী আপামর জনতা।সম্ভবত দিনটি ছিল ২ এপ্রিল ১৯৭১, শুক্রবার। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে প্রতিরোধ স্পৃহায় প্রতীক্ষা করছিল প্রতিবাদী জনতা। বড়তাকিয়া জামেমসজিদের জুম্মার নামাজ শেষে মোসল্লীগণ বাড়ি ফিরছিল। এসময় কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে চট্টগ্রাম গামী পাকি হানাদারদের গাড়ির বহর প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। আধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লাঠির সোটার আক্রমণ ছিল দুঃসাহসী জীবনবাজী অসম যুদ্ধ। সেদিন 'জয়বাংলা' রণ মন্ত্রে দীক্ষিত বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা অকাতরে জীবন বিসর্জন দিতে এতটুকু কুণ্ঠা বোধ করে নাই। হানাদারের এলোপাথাড়ি গুলিতে হতাহত হল কয়েকজন।দিক্বিদিক ছোটাছুটি করে প্রতিরোধকারীরা সরে গেল নিরাপদ স্থানে।তখনো হায়েনাদের গোলাগুলি চলছিল। ভয়ে আতঙ্কে সৈদালী গ্রামের অনেক নারী পুরুষ আশ্রয় নিলো আমাদের বাড়িতে।সেদিন এই অসম যুদ্ধে মীরসরাইয়ে প্রথম শহীদ হন অকুতোভয়ী বঙ্গবন্ধু সৈনিক মগাদিয়া বদিউলা পাড়ার জনৈক রিকশাচালক। আহতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তদানীন্তন বড়তাকিয়া জামে মসজিদের পেশ ইমাম সৈদালী গ্রাম নিবাসী মরহুম মাওলানা আবু বকর। এর কয়েকদিন পর, তারিখ মনে নেই, গ্রামের কিশোররা আমাদের বাড়ির দক্ষিণে ধান ক্ষেত 'দইনা হাঁতরে' খেলা-ধুলা করছিলাম।আমি ঘুড়ি উড়াইতেছালাম, কেহ ডাণ্ডা গোল্লা, অন্যরা হা ডু ডু খেলছিল। পড়ন্ত বিকেলে আমি ছাড়া সব দুরন্ত কিশোররা যে যার বাড়ি ঘরে ছলে গেল। আমার ঘুড়ি নামাতে,সুতা বান্ডিল করতে সময় ক্ষেপণ হচ্ছিল। হঠাৎ দেখি একদম নিচ দিয়ে বিকট আওয়াজ করে একটি যুদ্ধবিমান উড়ে যাচ্ছে। তারপর শুনলাম গুলি ও বোমার আওয়াজ। আবার বিমানটি সোঁ সোঁ করে এসে আমার মাথার উপর দিয়ে কয়েক চক্কর গুরে চলে গেল।আমাদের এলাকায় আক্রমণ করলনা। আমি ভয়ে একটা গাছের নিছে গর্তের ভেতর আশ্রয় নিলাম। আমার জেঠা এসে আমাকে নিয়ে গেল। পরে জানা গেল পশ্চিমা হানাদার যেখানে যেখানে প্রতিরোধের শিকার হয়েছে, সেখানেই বিমান আক্রমণ করে বহু নিরস্ত্র সাধারণ লোককে হত্যা করে। বিমান আক্রমণ হয়েছে মীরসরাই, মিঠাছড়া, জোরালগঞ্জ সহ বিভিন্ন এলাকায়। সেদিন ছিল মঙ্গলবার, বড়তাকিয়া বাজার হাঁটের দিন। শত শত ক্রেতা বিক্রেতার সমাবেশ ।জনগণের ধারনা বড়তাকিয়া বাজারের অতি নিকটে একজন বড় আউলিয়ার মাজার থাকার কারণে বিমান বার বার চক্কর দেওয়ার পরও বোমা বর্ষণ করা সম্ভব হয় নাই।অজানা আশঙ্কায় সৈদালীবাসী ও বড়তাকিয়া এলাকার জনগণ আতঙ্কগ্রস্ত।যে কোন সময় ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যেতে পারে।
অবশেষে আসলো সে ভয়ঙ্কর সময়। ২০ এপ্রিল ১৯৭১। মীরসরাই সদর সামান্য দক্ষিণে ফেনাফুনি প্রতিরোধ যুদ্ধে হনাদার বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি সাধিত হয়। এ যুদ্ধে শহীদ হন দুই জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানী হায়েনাদের অবস্থান ছিল বড়তাকিয়া বাজারে।প্রতিশোধ স্পৃহায় পাকি হানাদার বড়তাকিয়া বাজার ও পার্শ্ববর্তী সৈদালী গ্রামে চালায় হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ।গ্রামে ও বাজারে লুটতরাজ চালানো হয়।সৈদালী গণহত্যার শিকার হয় ২৩ জন নিরিহ গ্রামবাসী, ধর্ষণ করা হয় কয়েকজন অবলা রমণীকে। গ্রামের সব বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে বিরানভূমিতে পরিণত করা হয়।
খোলা আকাশের নিচে অনেক দিন গ্রামবাসী মানবেতর জীবন যাপন করে। পরবর্তীতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পোড়া টিন আর বাঁশ দিয়ে কোন প্রকার আবাসনের ব্যবস্থা করে জীবন যাপন শুরু করে। জুন মাস থেকে আবারো রাজাকার, মোজাহিদ, আলবদর, বিহারী ও পাঞ্জাবী বাহিনী এক যোগে গ্রামে গ্রামে তল্লাশি অভিযান চালায়। পুরুষ শূন্য হয়ে যায় গ্রাম।বার বার চলে এ অভিযান।নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে ব্যর্থ যুবক ও তরুণদের ধরে নিয়ে হত্যা করত মীরসরাই তালবাড়িয়া স্ট্যাশন রোডের লোহার পোলের তলে। এ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি শুধু আমাদের সৈদালী গ্রামে ছিলনা মীরসরাইর প্রায় সকল গ্রামের একই পরিস্থিতি।
মীরসরাইর অন্যান্য বাজারের মত বড়তাকিয়া বাজার বোর্ড অফিসেও রাজাকার ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।বড়তাকিয়া রেল স্ট্যাশনের পূর্ব পোলমোগরা গ্রামের রাজাকার মোমাদ্দা ও তার দল হাটে মাঠে ঘাটে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।রাত্রি গভীর হলে তারা অনবরত গোলাগুলি করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করত। মুক্তিযুদ্ধে যতনা ক্ষতি করেছে পাকি হানাদার তার ছেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে এসব হানাদার দোসর রাজাকার আলবদর।এরা যদি হানাদারদের সহযোগিতা না করত, পথ চিনিয়ে না দিত তাহলে এত হত্যা, ধর্ষণ, খুন লুটতরাজ, জ্বালাও পোড়াও মানবতা বিরোধী অপরাধ সংগঠিত করা কখনো তাদের পক্ষে সম্ভব হতনা। জুলাই মাস থেকে আরম্ভ হল মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ। উদ্দেশ্য হানাদার রাজাকারদের আতঙ্কে রাখা ব্যতিব্যস্ত রাখা।এখন থেকে রাজাকারের দল গ্রামে নামলেই মুক্তিযোদ্ধার গেরিলা আক্রমণের শিকারে পরিণত হত। সম্ভবত আগস্টের শেষের দিকে ৭-৮ জন হানাদারসহ একদল রাজাকার আবুতোরাব বাজার এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের জন্য অভিযানে নামে। তারা চালাতে থাকে হত্যা খুন লুটতরাজ ও ধর্ষণ। তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধার গেরিলা কৌশলী জালে আটকা পরে। আবুতোরাব রোডের উভয় পাশের জমিতে চাষআবাদে ব্যস্ত ছিল কৃষকেরা।মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণে নাস্তানাবুদ হয়ে সাধারণ পোশাক পরিহিত কয়েকজন রাজাকার ধরা পড়ে। অন্যরা অস্ত্র ফেলে সাধারণের সাথে মিশে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ৭ -৮ জন পোশাক পরিহিত হানাদার প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছিল গেরিলাযোদ্ধার সাথে। গুলি ফুরিয়ে গেলে তারা প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াতে থাকে। পিছু নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। ধান ক্ষেতের কৃষি শ্রমিকের হাতের কাছে ছিল জালাবাই ( ধানচারা বহনে শক্ত মোটা লাঠি) কৃষি শ্রমিকেরাও জালাবাই হাতে হায়েনাদের ধাওয়া দিয়ে ধরে ধোলাই শুরু করল। একজন হানাদার দৌড়াতে দৌড়াতে পশ্চিম খইয়াছরা গ্রামে এক বাড়িতে ঢুকে গেল। তাকেও ধাওয়া দিয়ে ধরে পেললো মুক্তিযোদ্ধা জনতা, তারপর গণধোলাই।দুর্দর্শ গেরিলার এই বীরত্বপূর্ণ পাল্টাঘাতে জনমনে আশা সঞ্চারিত হল, কিছুটা আতঙ্কগ্রস্তও হল এর প্রতিক্রিয়ায় আবার কি ঘটে। ৩ - ৪ দিন পর রাজাকার,আলবদর মোজাহিদ,আর হানাদারের বিরাট বহর একযোগে হামলা চালালো মায়ানী, মগাদিয়া, চরসরত, খেয়ারহাট গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার অবাধ বিচরণ ভূমিতে। কিন্তু গেরিলা কৌশলের কাছে সফল হতে না ফেরে প্রতারণার আশ্রয় নিলো। ৪ জন রাজাকার অস্ত্র লুকিয়ে রেখে সাধারণ জনতার সাথে মিশে গিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে লড়াইরত অস্ত্রধারী এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে ফেলে দ্রুত হামলা স্থান ত্যাগ করে রাজাকার-হানাদার বহর। এখন থেকে নির্বিঘ্নে গ্রামে নামা রাজাকার হানাদার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যেখানে তাদের অভিযান সেখানেই গেরিলা আক্রমণ। বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মনোবল অনেকটা ভেঙ্গে দিয়েছে। বড়তাকিয়া ১২ নং খইয়াছড়া ইউনিয়ন বোর্ড অফিস রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ। রোজার মাস। সেহেরী খাওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত। এমন সময় দড়ম দড়ম বিকট শব্দ। তার পর ব্রাশ ফায়ার। মাত্র ১০ মিনিটের যুদ্ধে বোর্ড অফিস রাজাকার ক্যাম্প পতন। ১৫ - ২০ জন রাজাকার মাত্র ৮ জন বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার গ্রেনেড হামলায় কুপোকাত। সবাই অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল। ক্যাম্পের গুলিগোলা অস্ত্রশস্ত্র নিজেদের দখলে নিয়ে নিলো মুক্তিযোদ্ধারা।এর পর থেকে বাবার সাথে প্রতিদিনই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ জয়ের ঘটনা শুনে শিহরিত হয়ে উঠতাম, আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে যেতাম। এম আর আখতার মুকুলের 'চরম পত্র', রাজু আহাম্মদের ' জল্লাদের দরবার ' শুনে সাহস পেতাম স্বস্তি পেতাম।দুঃখ দুর্দশার মধ্যে থেকেও আনন্দ পেতাম। এইভাবেই ভয়ে- আতঙ্কে,দুঃখ-দুর্দশায় কেটে যাচ্ছিল ৭১' এর অগ্নিঝরা দিনগুলি। আর প্রতীক্ষার প্রহর গুনতাম অদম্য আকাঙ্ক্ষায় জালিমের জুলুম থেকে মুক্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য।
ডিসেম্বরের শুরু থেকে বিবিসি অলইন্ডিয়া রেডিও ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একেকটি অঞ্চল মুক্তির খবর জানাতে লাগল। আমাদের বিশ্বাসও দৃঢ় হতে থাকে, সহসায় আমরাও মুক্ত হতে যাচ্ছি। স্বপ্নের স্বাধীনতা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
১৯৭১, ডিসেম্বরের ৮ তারিখ। হাড় কাঁপানো শীত। সকাল থেকে উত্তর দিকে দূরের প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ শুনা যাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম না যুদ্ধ কোথায় হচ্ছে।ধারনা করে গ্রামের মুরব্বীদের কেহ বলে দূ্র্গাপুর- মাতবরহাট, কেহ বলে মিঠানালা- বামনসুন্দর, কেহ বলে মীরসরাই-তালবাড়িয়া ওয়ারলেস। একজন মুরব্বী বললো সর্বাত্মক যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেছে। পাহাড় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত এক যোগে লড়ে যাচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। দুপুর ২টার পর আমরা দুরন্ত কিশোররা আরব আলী মেস্তরী বাড়ির সামনে খেলার মাঠে শীতের রোদেলা দুপুরের তাপ উপভোগ করছিলাম। দূরের গোলাগুলির আওয়াজ যেন আরো নিকটে উচ্চস্বরে শোনা যাচ্ছে। প্রথম প্রথম ভয় পেতাম, এখন আর কামানের গোলার আওয়াজও আমরা ভয় করি না আমাদের এখান থেকে স্পষ্ট ঢাকা ট্রাঙ্করোডের চলন্ত যানবাহন দেখা যায়।হানাদারের সামরিক বহর ছাড়া আজকে আর কোন যান বাহন চলতে দেখা যায় নাই। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। শীতের মধুর রোদেলা তাপও ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখতে পারছি শতশত হানাদার সামরিক গাড়ির বহর একটার পর একটা লাইন ধরে চট্টগ্রাম শহরে দিকে চলে যাচ্ছে। এরা কি টহল দিচ্ছে নাকি স্থান পরিবর্তন করছে নাকি ক্যাম্প প্রত্যাহার করে পালিয়ে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলামনা।ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির শব্দের আরো উচ্চতর আওয়াজ এবং তার সাথে সাথে হাজারো মানুষের গগনবিদারী কণ্ঠের সম্মিলিত শ্লোগান। এই গগনবিদারী কণ্ঠ যতই কাছে আসতেছে ততই আওয়াজ বড় ও স্পষ্টতর হচ্ছে । কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিনা, একি আর্তনাদ নাকি জয়গান ? আমাদের সাথে ছিল মেস্তরী বাড়ির 'ননী'।হঠাৎ সে "জয়বাংলা"বলে চিৎকার করে উঠল।আমরা হতবাক, ভালো করে লক্ষ্য করে শোনতে লাগলাম ঐ গগনবিদারী শ্লোগানের মর্মকথা। ননী আবার বলে উঠল, ঐ ; ঐতো 'জয়বাংলা' 'জয় বঙ্গবন্ধু'। আমরাও তার সাথে জয়বাংলা - জয় বঙ্গবন্ধু বলে চিৎকার শুরু করলাম।মেস্তরী বাড়ির মুরব্বী 'কালা কাকু' ধমক দিয়ে বললো, " থাম,থাম অডা। ডর ভয় নাই। এত চিল্লসকা। তোরগোর লাই গেরামেত্তে আবার রাজাকার হান্দাইব "। না-এবার স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, ঐ হাজার কণ্ঠের গগনবিদারী আওয়াজ, আর্তনাদ নয় জয়গান।" জয়বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু " শ্লোগান তুলে আমরাও এগিয়ে যেতে লাগলাম ঐ বিজয়ের আনন্দ মিছিলে। আমাদের সাথে একত্রিত হল গ্রামের আরো অনেক শিশু, কিশোর, তরুণ বৃদ্ধ যুবক।বড়তাকিয়া বাজারে ঢাকা ট্রাঙ্করোডে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার আগত বিরাট বিজয় মিছিলকে স্বাগত জানিয়ে আমরাও যোগ দিলাম বহুল আকাঙ্ক্ষিত মুক্তির মিছিলে, স্বাধীনতার বিজয় মিছিলে।মুক্তিযোদ্ধারা আকাশের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে মেশিন গানের গুলি ছুড়ে জানান দিতে লাগল আজ হতে আমরা মুক্ত-স্বাধীন। মিছিল চলে গেল আবুতোরাব বাজারের দিকে। আমি বেশি দূর যেতে পারি নাই। কনকনে ঠাণ্ডা, শীতের সন্ধ্যা। আবুতোরাব রোডে আবু বকর মৌলভী বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে 'দইনা হাঁতর' পেরিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসি।রাত্রেই শোনা গেল বড়তাকিয়া এলাকার ত্রাস মোমাদ্দা রাজাকার ধরা পড়ল মুক্তিযোদ্ধা জনতার হাতে। গভীর রাত পর্যন্ত চাচাত জেঠাত ভাই বোন, চাচা-চাচী,জেঠা-জেঠি বাড়ির সবাই মিলে হৈ হল্লোল আর আনন্দ উৎসবে মেতে থাকলাম। আজ বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আশেক এলাহি কে মনে পড়ছে বার বার। জানিনা সে কোথায় আছে।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সে একবার গভীর রাতে এসেছিল, ভোর হবার পূর্বে আবার চলে যায়। কিছুতেই আজ ঘুম আসছেনা। উৎসাহ ও উত্তেজনা নিয়ে ভোরের অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটালাম। ভোরে বিছানা থেকে উঠে দেখি কালো পোশাক পরিহিত বীর মুক্তিযোদ্ধা রাব্বান মামা আমাদের বাড়িতে। তাঁর থেকে প্রথম জানতে পারলাম রাত ২ টার পর থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বড়তাকিয়া এলাকায় অবস্থান নিয়েছে।তিনি ওয়ারল্যাস অপারেটর হিসাবে তাদের সাথে এসেছেন।সামান্য নাস্তা সেরে উনি দ্রুত চলে গেলেন। আমরাও মামার সাথে বেরিয়ে পড়লাম।মামা গেলেন বড়তাকিয়ায় আর আমরা গেলাম দক্ষিণ দিকে আবু বকর মৌলভী বাড়িতে। ঐবাড়িতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর শতশত সেনা সদস্য অবস্থান নিয়েছে। বাড়ির সামনে খেলার মাঠ, পুকুর পাড়ে মাটি খুঁড়ে তারা বাঙ্কার তৈরি করছে।বাজারে এসে দেখলাম মিত্রবাহিনীর শত শত গাড়ি ভারী অস্ত্র-নিয়ে প্রস্তুত হাজার হাজার শিখ সেনা।তেলি পুকুর মঙ্গলা পুকুর পাড়সহ আরো অনেক জাগায় বাঙ্কার তৈরি করছে তারা। মুক্তিযোদ্ধা জনতা তাদের সহযোগিতা করছে। গ্রামের ছেলে-মেয়ে, শিশু কিশোর, পুরুষ-মহিলা কারো মনে আজ ভয়-আতঙ্ক নেই। সবাই মুক্তির আনন্দে আত্মহারা।৯ মাসের বন্দীশালার দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছে আমাদের সৈদালী গ্রামসহ পুরো মীরসরাই।মীরসরাই হানাদার মুক্ত করতে গিয়ে এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আহবানে লাল সবুজের পতাকা খচিত বাংলাদেশের বিজয় চিনিয়ে আনতে যারা অকাতরে তাজা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তাঁদের মীরসরাই হানাদার মুক্ত দিবসের দিনে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে জানাচ্ছি সালাম ও শুভেচ্ছা।
মাহবুবুল হক শাকিল : কবিতার স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর ।। রুদ্র সাইফুল

মাহবুবুল হক শাকিল : কবিতার স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর ।। রুদ্র সাইফুল


প্রত্যেক কবির কবিতায় একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর থাকে, আর সেই কবি যদি হন বড় মাপের কবি তাহলে তার সেই স্বাতন্ত্র্য বুঝে নিতে সচেতন পাঠক বা সমালোচকের কোনোই অসুবিধা হয় না তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, প্রত্যেকটি মানুষ যেমন ব্যক্তি হিসেবে ভিন্ন, তার চেহারা, তার রুচি ভিন্ন, তার কণ্ঠস্বর ভিন্ন, সেহেতু তার রচিত কবিতাও ভিন্ন হতে বাধ্য শিল্পের বিচারে এবং কণ্ঠস্বরের স্বাতন্ত্র্যে ভিন্ন ভিন্ন কবিরা তাই যুগ যুগ ধরে রাজ করে যাচ্ছেন বাঙলা কবিতায়

আমার আজকের আলোচ্য সূচিতে বিশেষ এক কবির কবিতাই প্রাধান্য পাচ্ছে, এই কবি পরিণত বয়সের কবি, এই কবি সকলের থেকে স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বরের অধিকারী; কারণ তিনি নবযৌবনের শুরুতে কবিতা লেখা শুরু করলেও, পরিণত বয়সে এসে তার আত্মজ কবিতাগুলোকে মলাটবদ্ধ করেছেন এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় হচ্ছেমন খারাপের গাড়ি কবি, মাহবুবুল হক শাকিল

শাকিল কবিতা লেখেন পরিণত শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে, কিন্তু তিনি রাজনীতির সাথে পারিবারিকসূত্রে জড়িয়ে আছেন সেই বাল্যকাল থেকেই; রাজনীতির ঘোরটোপে বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে শাকিলের কবি পরিচয় অনেককাল লুকিয়ে ছিলো বাঙলা কবিতার পাঠকদের কাছে; কবি পরিচয়ের বাইরে রাজনীতিক হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেন তিনি শাকিলের খুব কাছের মানুষ ছাড়া তেমন কেউ জানতেন না তার কবিতাচর্চার কথা 


আসলে কবিতা হচ্ছে ছাইচাপা তুষের আগুনের মতো কারো কারো ক্ষেত্রে আগ্নেয়গিরির আগুনের মতো; জ্বলতে জ্বলতে হঠাৎ করেই বিস্ফোরণ ঘটতে পারে 

শাকিলের ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটেছে অনেককাল আগে থেকেই শাকিল নিভৃতে কবিতা লিখলেও গ্রন্থভুক্ত কবি হিসেবে তার সরব উপস্থিতি সম্প্রতিকালে বোদ্ধা মহলে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হিসেবে কাজ করেছে তিনি এখন সকলের কাছে একজন রাজনীতিকের পাশাপাশি কবি হিসেবেও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন

প্রকৃতপক্ষে কবি হিসেবে শাকিলের এই গ্রন্থভুক্ত উত্তরণ অনেককেই কিছুটা বিস্মিত করেছে আমি মনে করি দেরিতে বিস্ফোরণ ঘটায় তা শাকিলের জন্য শাপে-বর হয়েছে তিনি পরিণত বয়সে যেহেতু তার কবিতার গ্রন্থভুক্ত প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেহেতু আটঘাট বেঁধে এই পথে নামার ক্ষেত্রে সচেতনভাবে অনেকগুলো বিষয় তাকে মাথায় রাখতে হয়েছে যদি তার প্রথম দিককার কবিগুলো পাঠ করা হয় তাহলে ধাপে ধাপে পরিণত কবি শাকিলের উত্তরণটি সহজেই চোখে পড়বে এটা শুধু শাকিলের ক্ষেত্রেই নয়, সকল কবির ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটে; প্রথম দিককার কবিতাকে ছাপিয়ে পরিণত হয়ে ওঠেন কবি

রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দের মতো কবিদের কথাই যদি ধরি, তাহলে তাদের পরিণত বয়সের প্রাজ্ঞতা কি প্রথম বয়সের কবিতায় খুঁজে পাওয়া যাবে? রবীন্দ্রনাথেরসন্ধ্যাসংগীতএবংপ্রভাতসংগীত’-এর কবিতার সঙ্গে তাঁর পরবর্তীকালের কবিতার তুলনা করা যাবে? অথবা জীবনানন্দ দাশেরঝরাপালক’-এর মতো কাব্যগ্রন্থকে কি পরবর্তীকালের কাব্যগ্রন্থসমূহের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে? ‘ঝরাপালক’-এর পরবর্তীকালের কাব্যগ্রন্থগুলোর কবিতাসমূহের মধ্যে যে বিপ্লবাত্মক বাঁকবদল, তা বাঙলা সাহিত্যে একটি বিস্ময়কর ঘটনা বলেই বোদ্ধা মহলকে স্বীকার করে নিতে হয়েছে জীবনানন্দের বাঁকবদলের সেইসব কবিতায় একজন পরিণত কবির আবির্ভাবের সম্ভাবনার বিদ্যুৎঝলক কারও দৃষ্টির অগোচর থাকেনি এই আলোকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে কবিতার জগতে শাকিলের পরিণত আবির্ভাবের সম্ভবনাও তার প্রথমদিকের কবিতায় আমাদের বুঝে নিতে কষ্ট হয়নি

মাটির সানকি মানেই ছুঁয়ে যাওয়া প্রেম, দেশ
কিংবা প্রবাস, বাল্যস্মৃতির জানালা

এক টুকরো লেবু, কাঁচা লঙ্কার সবুজ
ভাইয়ের ভালোবাসার মতো পাতের পাশে
                                     একদলা সাদা নুন
                   [ভুলে ভরা গল্প, (মন খারাপের গাড়ি)]

এই কবিতা পড়ে কি মনে হচ্ছে না, একজন সম্ভবনাময় পরিণত কবির আবির্ভাবের আভাস আমরা টের পাচ্ছি? আসলে কবি এভাবেই সামনের দিকে আগায় কবিতা যদি একজন কবির জীবনচর্চার আঁধার হয়, ধ্যানের বিষয় হয়, তাহলে সেই কবির পক্ষে ক্রমপরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়া সাফল্যের সঙ্গেই সম্ভব

রাজনীতির পাশাপাশি যখন একজন কবি কবিতা লেখা শুরু করেন, তখন তিনি অন্য কবিদের থেকে অনেক বেশি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে ওঠেন কবিরা যা দেখেন কল্পনায়, রাজনীতিবিদ তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকেন বলেই কল্পনা বাস্তবের মিশেলে একটি ঘনঘোর আবহ সৃষ্টি করে কবিতাকে ঊচ্চমার্গে পৌঁছে দেওয়া রাজনীতিবিদ কবিদের পক্ষে অনায়াসেই সম্ভব হয় আর তাই তাদের কবিতা অনিবার্যভাবেই হয়ে ওঠে অন্তর্গতভাবে সুদূরপ্রসারী আমরা যদি অক্টাভিও পাস কিংবা পাবলো নেরুদার কথা ভাবি, তাহলে দেখবো চেতনার অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অস্তিত্বের বিপুল অাঁধার সঞ্জীবিত থাকলেও তাকে গভীর গূঢ়তর কবিতা করে তুলতে এই দুজনের কারোরই কোনো কষ্ট হয়নি যদিও অক্টাভিও পাস একটি সময়ের পরাবাস্তব আন্দোলনের এক ধরনের মোহাবিষ্ট ধাঁধার মধ্যে নিজের কবিতাকে সংশ্লিষ্ট করেছেন, কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে তাঁর কবিতা যে মানবিকীকরণের এক ধরনের গূঢ় অহঙ্কারের অাঁধার হয়ে উঠেছে; এটা অস্বীকার করা কারো পক্ষে সম্ভব নয় আর পাবলো নেরুদা তো ছিলেন রাজনীতিরই লোক, তাঁর কবিতা রাজনীতির সংশ্লেষে অন্যদের কবিতার চেয়ে একটি গভীর তাৎপর্য নিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে সমাদৃত হয়েছে, কথা বলার অপেক্ষা রাখে না

এত কথা বলার মূল কারণ, মাহবুবুল হক শাকিল তার কাব্যিক মনোভূমিতে নিজেকে যে ক্রমাগত সম্প্রসারিত পরিণত করে তুলেছেন, তা তার আলোচিত কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো পাঠ করলে সহজেই অনুমান করা যাবে কয়েকটি কবিতাংশের উদাহরণ না টেনে পারছি না:

উজ্জ্বল দুপুরজুড়ে পিঁড়ি পেতে বসে মধ্যসূর্যের আলো;
অন্ধকার ফিরে যায় বৃদ্ধ সন্তের মতো ন্যুব্জমান
                পাড়ি দেয় ভাঙা সাঁকো, মেঠোপথ

ফিনকি দিয়ে রক্ত নামে, লাল, ইমপ্রেশনিস্ট ক্যাম্পাসে;
রঙের মেলায় সবাই নাচে নিজের মতো করে
ঢাকির জাদুকরী কাঠি বাজে, ঢেকে ফেলে পতনের শব্দ
                 [আলো কিংবা নাচের মুদ্রায়, (মন খারাপের গাড়ি)]

খুব বেশি দেখতে নেই ভালোবাসা, জানতে নেই কত বেশি
জীবনের ভুল মাঝরাতে খুঁজে ফিরি ভুল কবিতা, বিষণ্ন অনুবাদ
মন খারাপের গাড়ি অভিমানের এভিনিউয়ে খুঁজে ফেরে দূর সমুদ্দুর
                     [মন খারাপের গাড়ি, (মন খারাপের গাড়ি)]

তুমি চলে গেলে মন পুড়ে যায়, পুড়ে যায় বন
পুড়ে যায় প্রজাপতি, ঘাস, উড়ে যায় বাউল বাতাস
পুড়ে যায় স্বপ্নচুম্বী জয়রথ, রয়ে যায় বিষণ্ন বিলাপ
                 [অন্য পাড়ায় বাড়ি, (মন খারাপের গাড়ি)]

মরে যাওয়া মানুষ তুমি আর কতদূর যাবে?
খাটিয়ার গতি কি ছুঁতে পারে জীবনের সাম্পান?
                       [অগস্ত্য যাত্রা, (মন খারাপের গাড়ি)]

রোদ ছিল না এক রত্তি, আকাশজুড়ে কান্না
গ্রিক পুরাণের পাখির মতো আপনি ফিরে এলেন
নির্বাসনের অশ্রু পেরিয়ে, পিতার শ্যামল মাটিতে

তেরো শত নদীজুড়ে বয়ে গেল স্রোত
                        ধানশালিকের উদ্দাম ওড়াউড়ি
              [শেখ হাসিনা, আপনি এলেন (মন খারাপের গাড়ি)]

জুড়ে থাকে ভালোবাসা, অভিশাপ, বিষাদ,
মৃত্যু এবং প্রেমের রাত, স্বপ্ন-টলোমল করিডর
জুড়ে চান্দের সাম্পান, অপবাদের নষ্ট জল
                   [ভালোবাসার সাদাবাড়ি, (মন খারাপের গাড়ি)]

এই ধরনের কবিতা লিখতে গিয়ে কবি হিসেবে রাজনীতিক শাকিলের তেমন কোনো দ্বৈরথ তৈরি হয়নি তার আত্মদর্শন কিংবা তার তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এক ধরনের সমন্বয় সাধন করে তিনি কবিতাকে একটি গভীর গূঢ়তর সৃষ্টিশীলতার মধ্যে সাঙ্গীকৃত করতে পেরেছেন, কবি হিসেবে এখানেই তার ভিন্নতা এবং সার্থকতা শাকিলের কবিতাকে বুঝতে গেলে ব্যক্তি শাকিলকেও বোঝার দরকার আছে রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন, ‘কবিরে পাবে না তার জীবনচরিতে’; কিন্তু আমার মনে হয় কবির কবিতাকে সূক্ষ্মভাবে বোঝার জন্য কবিরজীবনচরিতবোঝাও খুবই প্রাসঙ্গিক

শাকিলেরমন খারাপের গাড়িতে বিস্মিত হয়েছি এই জন্য যে, তিনি তার কবিতার পরিণতির জন্য যেই কয়টি অনিবার্য সত্য পুরণ করা জরুরি, তা খুব সাহসের সঙ্গে পুরণ করার চেষ্টা করেছেন তার মধ্যে কবিতার রহস্যময়তা, দর্শন, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, মিথ পুরাণের নিপুন এবং যথাযথ ব্যবহার কখনো কখনো তার কবিতাকে শক্তিশালী সৃষ্টি হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে

কবিতা লেখার সময় আধুনিক কবিতার যে দাবি, তা পুরণের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতার সাথে এগিয়েছেন তিনি সেটি চেতনার দিক থেকে যেমন সত্য, ঠিক তেমনি অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রেও সত্য শাকিল খুব সতর্কভাবে বাঙলা কবিতার ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে পরিভ্রমণ করেছেন শাকিলের এই পর্যটনপ্রিয় পরিভ্রণে সতর্কভাবে তার সঙ্গী হয়েছেনরবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে কিংবা বিনয়ের মতো বাঙলা কবিতার রাজ পরিব্রাজকেরা


মাহবুবুল হক শাকিলের কবিতা নিয়ে সামগ্রিক পূর্ণাঙ্গ আলোচনার ইচ্ছে থাকলেও সময়হীনতার কারণে সেটা সম্ভব হলো না নিয়ে ভবিষ্যতে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছে রইলো তবে যেটুকু আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছি তাতে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, মাহবুবুল হক শাকিল মলাটবদ্ধ কবি হিসেবে যখন এবং যেখান থেকেই যাত্রা শুরু করে থাকুন না কেনো, তাতে কিছুই আসে যায় না কবিতার আলপথ যে তার জন্য ক্রমশ রাজপথ হয়ে উঠতে শুরু করেছে, ব্যাপারে বোদ্ধা মহলের কোনো সন্দেহ নেই শাকিলের কবিতার রাজপথ, বাঙলা কবিতার ভিণ্নপথে কতোদূর বিস্তৃত হয় তা দেখার জন্য সম্ভবত আমাদের আরও একটি মলাটবদ্ধ প্রয়াসের জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে