Previous
Next
দীর্ঘ কবিতা • পানিকাউর • হাসান রোবায়েত

দীর্ঘ কবিতা • পানিকাউর • হাসান রোবায়েত






কোথাও অন্ধকার ছুড়ে দেয়
আলকাতরার বহু লীন স্মৃতি, দূরে চিমনির পোড়া নীল, ক্রমার্দ্র ধোঁয়া
ঘুমন্ত বয়লার ঘিরে কালো পোকা
বয়ে যাচ্ছে শরীর, রাত্রির লাশ—বাষ্পের মিথ
তার তামাটে চোখের ভেতর জ্বালায় হু হু গরাদের ফাঁকা সুর

এমন সময়, হে পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
বৃষ্টির রাতে
ছায়া-বিদ্যুতে, ঘনলীন তির, শীর্ষে ইলেকট্রনে
বসে থাকো—যেন ইয়াজুজ-মাজুজের সুষুম্না চিরে
এই নদী, খাল, স্ফটিক পানির যত উন্মূল চক্রাবর্ত
ফিরে ফিরে আসে
অনন্ত হাওয়া-বিচ্ছুরিত যে স্বেদ
পাক খায়, দোলে
সেখানে গভীর তারাম-লি আলোর অশ্রু ধরে থাক থাক
রাতের-সোপান পেরিয়ে নামছে এই চরাচরে, তারই তীক্ষ্ণ চূড়াটিতে তুমি
দৈবনখরে ধরে আছো আলো—
দেখছো, পাশার সারি সারি খেত
মানুষের ঘুমে ঢুকে মহিষেরা উড়িয়েছে ধুলা
গানের লুপ্ত সুর তারা খুঁজে খুঁজে হয়রান—
নম্র পাথর ও পাখি, তোমার কালো হর্মের ভেতর বাজছে
অনাদিকালের উনুনের বীথি
ডুবোনৌকার মোনামুনিবন
এমন গভীর তামাটে রাতের সৌর-অন্ধকারে
শুনেছো পানোখি—
শুয়োর...মাদার চোদ বলে বলে কয়েকটা চোর
উন্মাদ খোর
যাচ্ছে কোথায়
ক্রুর শঠতায়
বিস্মরণের এই ফোঁটা ফোঁটা ভিজে বৃষ্টিতে—

নোনতা দুপুর, গাধার সঙ্গে ফিরে আসা তারা
বাস ড্রাইভার—
শনি-রবি-সোম
ভেসে যায় মল, ফাঁপা কন্ডোম
ফিরে ফিরে আসে, পাক খায় আর
এই কানা বুধ, শুক্রের বার—
এমন সময়, ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
ভিজে ভিজে একা
দাঁড়িয়ে থেকেছো নদীখালবিলে
সূর্যের শত রশ্মি বিফলে
উরু ফাঁক করে ঢুকিয়ে নিয়েছে
শ্রান্ত সন্ধ্যা যেন কবেকার
ঢেকে দিছে গেছে গোধূলির হেম
সব ডুবে যাবে—
শীলিভূত হয়ে জীবাশ্মে, গানে
ওই দূর দূর
চক্রাবর্তে যেখানে বসন্তেরা শুয়ে আছে
নৌকায় খাঁড়িপাড়ে
বিকালের পুঁজ, ঝকঝকে খুঁত, মায়া-শ্লেষ-হাহাকার
আব্বার ভাঙা সাইকেলে বসা পেছনের ক্যারিয়ার—
তবু হে পানোখি
তোমার রয়েছে দিগন্ত উড়বার—
এখানে পচন, কূট মিথ্যা ও বীজানুর অধিকারে
রাত্রি ফুরিয়ে যাচ্ছে বাদামী ভেড়াদের অধিকারে
ফোঁপা কান্নায়, তামাকারবারি, জাতিয়তাবাদী এবং অশোক
গাছটার ডালে
বেওয়ারিশ কেউ, কয়েকটা চোর, লাশ-ব্যবসায়ী
প্রত্যেকে একা
করছিল পান তারার আরক
ছোট ছোট ঢেউ
ঢেউয়ের উপর আলোছায়াময় রাত
মাদী কুকুরের যৌন সে ঘ্রাণ
অন্ধকারের ডাক—
‘এই শাউয়ার চাঁদে এত ফাঁক!’

কী যেন বলছে গভীর আয়েশে বাতাসের দিকে চেয়ে

এমন সময়, ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
জানো, এ রাতের অবিশ্রান্ত করোটিতে
আমাদের দেখা হবে না কখনো—

সেই বিস্কুট ফ্যাক্টিরি থেকে বৃষ্টির দিনে আসতেছে ঘ্রাণ
অথবা জোছনা পিছে পিছে রাতে
হয়েছে সঙ্গী, কুশারের বন
আব্বা রয়েছে
আর ছোট বোন
আমরা নৌকা তুলেছি ডুবানো
আমাদের ছিল ভুখা পেট, গানও
গেয়েছি সে রাতে, ওপারে মাঝির ডাক নাম গেছি ভুলে
‘আর কতদূর’ বলে ছোট বোন
আব্বা তখন
নৌকার ঘ্রাণ
ছোট সে বোনটি ভাটিয়ালি গান
বহুদূর পথ হেঁটে গেছি ঝরা ধানখেত দিয়ে দূরে
আমাকে ডাকছে মাটিডালিপথ
সাবানের কারখানা—
তুমি হে পানোখি রাতের ডিভানে
আর ফিরে আনিয়ো না
সেইসব নাচ, ডুমুরের সারি, আপাত বিষাদ

ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—

ও পাখি, পানোখি, কালো মেঘদূত
তুমি—তুমি—তুমি—
উড়ে যাও দূরে
যেখানে চাকা হিংসা-বলয়ে ঘুরতেছে ক্রমাগত

জন্মদিনের শুভেচ্ছা সহ হাফিজ রশিদ খান এর কয়েকটি কবিতা

জন্মদিনের শুভেচ্ছা সহ হাফিজ রশিদ খান এর কয়েকটি কবিতা







হাফিজ রশিদ খান
জন্ম : ২৩ জুন ১৯৬১, চট্টগ্রাম।


বিগত শতকের আশির দশক থেকে হাফিজ রশিদ খান বাংলা কবিতার অস্তিত্বে এক জায়মান সত্তা হিশেবে নিজের বিকাশ ঘটিয়েছেন। প্রায় তিন দশকের পথচলায় একটা নিজস্ব কবি ভাষার মিনার গড়ে তুলেছেন নীরবে নিভৃতে। নব্বই দশকের গোড়ার দিক থেকে কাব্যে ও গদ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিসমূহের তৃণমূল সংস্কৃতি ও জীবনাচারকে তার অনন্য ভাষিক বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করছেন সমান তালে। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তার 'আদিবাসী কাব্য' বাংলাদেশে তাকে পরিচিতি দেয় আদিবাসী জীবনের প্রথম কাব্যকাররূপে। ভালবাসা-বেদনা-কষ্ট-বিরহ এইসব হৃদয়দ্রাবী অনুভূতি যে কারাে একার সম্পত্তি নয়, সেটা উন্মোচিত হওয়ার এই তো সময় যখন সমস্ত অপেক্ষা কিংবা সংগ্রাম পাশাপাশি জাগিয়ে রাখে এক জাগ্রত চেতনা। বাইরে থেকে দৃষ্টিপাতের বিলাসী ভূমিকায় না থেকে ভেতরের একজন হয়ে ওঠার স্বাক্ষর হাফিজ রশিদ খানের কবিতা।

আজ কবির জন্মদিনে জলফড়িং এ পড়া যাক কয়েকটি কবিতা।

সংখ্যাগুরুর ক্রোধ

ব্যক্তি আর সংস্থা কতো গেল শান্তির সড়ক
তবু কতো ক্ষুদ্রজাতি নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে
                                                  বুকে নিয়ে কষ্টের নরক

নাফ সীমান্তে রোহিঙ্গা মরে
                   পারমাণবিক আস্ফালনে পৃথিবীটা কাঁপে ডরে

বোমাভর্তি বিমানের কুণ্ডলিত আগুনের জিবে
                    তামিল গ্রামের ঘরে-ঘরে মানুষেরা গেছে নিবে

কুর্দিদের বাসভূমে
              সংখ্যাগুরুর ক্রোধের ধূমে
                    তরুণ কবির শরীর নিথর হয়ে যায়

শাস্তি, থাকে উহা কাহাদের জোব্বার কোনায়...


বাইরে সৌন্দর্য নাইরে

মুগ্ধ হবো বলে তাকিয়ে রয়েছি
                      শ্রীমুখের নন্দনকাননে

চোখ ফেরাবো না আর
                       পুড়িব ভিজিব ওই ঝাউবনে

গগনে-গগনে তুমিই আমার সন্ধ্যাতারা
                         লাল ঠোঁটের আঙিনাজুড়ে সুর
                                   তোলা আমপারা

এই সব দৃশ্যের বাইরে
                           আর কোনো সৌন্দর্য নাইরে...


তারাছার শাদাফুল

তারাছার পথে যারা যায় পাহাড় ডিঙোবে বলে
তাদের ভেতরে দুর্বার আলেকজান্ডারের
                                               অশ্বারোহী বেগ
জ্ঞানদীপ্ত মাহিয়ানের তেজস্বী বৌদ্ধমন
নির্ভীক খালিদ বিন ওয়ালিদের উজ্জ্বল
                                               নিকষিত হৃৎপিণ্ড
ঋষি অরবিন্দের গভীর মেজাজ প্রতিস্থাপিত
                                               প্রত্যেকের চালু করোটিতে

আসলে ওরা তো অলখপিপাসু সূর্যের সন্তান
                           পায়ের প্রবল চাপ পাথরের বুকে
                               ঝরনার স্বচ্ছজলে জীবনের শুদ্ধ তাপ
                                     ঘূর্ণি হাওয়া
উড়ে যাওয়া দিগ্বিবিক

ক্লান্তিহারা সামুরাই দল
                         পাহাড় পেরিয়ে
পাখিদের গান শুনতে-শুনতে এলো
                           জুমঘরে সন্ধ্যার বৈঠকে

ঝোপের সবুজ খোঁপা থেকে
                             শাদাফুল নিয়ে হাতে
                                    দাঁড়ায় সমুখে আদিবাসী নারী

আঁধার তাড়াতে যেনো শক্তিশালী আলোর পেখম...

ও ঝিরিজল মৎস্য দিয়ো

হৃদয় সলতে পাপড়ি মেলো
এখন আলো আসবে অমল হাতের ছোঁয়ায়
লুসাই পাড়ার তস্বী উঠোন
                                মাদুর পাতো
                                       আজকে শীতের
                                                ঠাণ্ডা আমেজ হাওয়ায়...

সেই মেয়েটা মৎস্যপ্রিয়
সন্ধ্যা হলে পিনোনভরা
                         ও ঝিরিজল
                                মৎস্য দিয়ো...

আমি এবং বন্ধু আমার
আরো অনেক টাটকা সখা
শিশির অবগাহন শেষে
খুঁজতে যাবো
বাতুল পথের ঝোপে-ঝোপে
                                লক্ষ-লক্ষ
                                       রাত্রিপোকা...

সকল যুবক-যুবতিগণ আয়ুষ্মতী দেশলাই জ্বেলো...
অ্যালেক্স সিরিজ ।। চঞ্চল মাহমুদ

অ্যালেক্স সিরিজ ।। চঞ্চল মাহমুদ






অ্যালেক্স, আমাদের যে-জীবনের উপর ইউরোপ দাঁড়িয়ে আছে সে-জীবনকে আমরা মৃত ঘোষণা করেছি। ওরা মরা মানুষের শরীরকে নাচের স্কুল ভেবে নাচ শিখছে…

উচ্চতা-বিষয়ক

এই অনুর্বর মাটিতে পাথরের চাষ করে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি অ্যালেক্স। দিন শেষ হয়ে এলে আমরা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছি। দূর থেকে কেউ কেউ ভাবছে শুয়োরের খামার জেগে উঠেছে পৃথিবীতে। আমাদের সেইসব তরঙ্গ উৎপাদনের দিন হেঁটে গেছি পাহাড়-ঘেঁষা রাস্তা বেয়ে। আর নিয়মিত পাহাড় ধসে গেছে আমাদের উপর।
অ্যালেক্স, আমরা চাপা পড়ে গেছি উচ্চতার নিচে। 

কার্পেট

অ্যালেক্স, আমাদের চামড়া কার্পেট হয়ে গেছে;
মেদ বিছানো আছে তার নিচে।
সন্ধ্যার পরেও যে-রাজহাঁস ফিরতে পারেনি ঘরে,
সেই রাজহাঁস খুঁজবে মানুষ
আমাদের কার্পেটে হেঁটে …

অ্যালেক্স, তোর ক্ষুধার্ত দাঁত আমাকে রক্তাক্ত করে চলে

অ্যালেক্স, ক্ষুধার্ত বন্ধু আমার, চল ভাত ছিটিয়ে চলি। বেলাভূমিতে পড়ে-থাকা ঝিনুকের মতো ভাতের বদলে ধর্ম কুড়িয়ে আনি। সভ্যতার ভাঙন আমাদের দোরগোড়ায়। চল, ভেঙে যাই, জেগে উঠি অন্য কোথাও সভ্য হয়ে।

অ্যালেক্স, পেটে এক হাত রাখ, অন্য হাত কপালে; পেট আর কপাল কতদূর অ্যালেক্স? মিটারস্কেল আর কম্পাস রক্তাক্ত করে মাপি। ভাগ্যবদল হয় না দেখে জীবন প্রায়ই উঠে আসে চটের ব্যাগে। অন্ধকারে স্বেচ্ছানির্বাসিত হয়ে সভ্যতা পড়ে থাকে পার্কের বেঞ্চিতে।

জেগে ওঠ মানবতা, শুয়োরের বাচ্চার মতো কোলাহল করে। আমার বন্ধুর বিক্ষত হাত কাঁদছে, বিস্রস্ত চুল, ভুরুতে ঘাম, পায়ের কালশিটে নির্মম হয়ে উঠছে ক্ষুধায়, চিৎকার করছে আলজিভ; শুনতে পাসনি?

অ্যালেক্সের হাসিতে ডুবে যাচ্ছে ইউরোপ

মনে পড়ে তখন বিকেলই ছিল। চগোর ওপর দাঁড়িয়ে যতখানি উপরে ওঠা যায়, ঠিক ততখানি উপরে উঠে আমি ঘোষণা করেছিলাম ইউরোপ এখন রাতের উদ্যান। এখানে মানুষ নেই! মানুষের মতো দেখতে কতগুলো ক্যাকটাস আর কিছু বিষাক্ত ফুলে ভরে আছে এ উদ্যান।

ভূমধ্যসাগরের নিচে যে বালিচাপা পড়ে আছে, তারও নিচে চাপা পড়ে গেছে এ অঞ্চলের আদিম-মানুষ-সংস্করণ। আর এতখানি উপরে উঠে এসেও অ্যালেক্স ঘুমিয়ে আছে কবরে। দেখো, কবরও জোনাকির মতো উড়ছে। ও রাত, ও উদ্যান — এই শেষ আলো। দেখে নিতে পারো পথ!

হাসতে হাসতে আমার মেদ কেটে যায়। যে সভ্যতা ডুবে গেছে বালির নিচে, কতদূর পেরিয়ে অ্যালেক্স এসেছে কবরে শুতে! কতদূর পেরিয়ে অ্যালেক্স এসেছে জোনাকি হতে!
জাদুকর, জাদু দ্যাখ এবার —
অ্যালেক্স বিদ্রুপ করে যখন ঘুংরি হাসি দেয়, পাক খেতে খেতে ইউরোপ তলিয়ে যায় আরো একবার অ্যালেক্সের উচ্চতার সমান। অ্যালেক্স, যে-সংগীত কোনোদিনই শুনিনি, সে-সংগীত পাঠ করে চার্চের উঠোনে গড়াগড়ি খাব দু’জন। ঘাসের ভেতর থেকে মাথা জাগিয়ে বলব — আমরা দেখে ফেলেছি চার্চের উঠোনে তোমাদের ডুবে-যাওয়ার দৃশ্য।

পাল খাড়া করে দাও অ্যালেক্স

পৃথিবীর সব মধু খেয়ে অ্যালেক্স যে তীর খাড়া করে দিল বাতাসে, সেই ভাংদ-কে পাল বানিয়ে বয়ে যাচ্ছে সময়।
বোঝোনি নিকোশিয়া!
তোমার চোখে পাল বেঁধে অ্যালেক্স খুঁজেছে এশিয়া।

উর্বর ভূমিতে গানের মৌসুম শেষ হয় নি কখনো

অ্যালেক্স, আমার এখানে ক্ষুধার মৌসুম। আমিও ক্ষুধার্ত। সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যার বুকে উঠে হাঁটি। ইদানীং অফিসের সময় এবং অফিস-পরবর্তী সময়কে আমার পাশাপাশি দুটি রাষ্ট্র মনে হচ্ছে। সন্ধ্যাটাকে মনে হয় বর্ডার। অ্যালেক্স, আমি যখন অফিস থেকে বের হই তখন সন্ধ্যারা বর্ডার হয়ে আমার পায়ের কাছে জড়ো হতে থাকে। আমি আলগোছে বর্ডার ক্রস হয়ে স্বজনদের কাছে ফিরি। আমার ক্লান্ত শরীর কলতলায় যায়, কল ছেড়ে হাতে-মুখে পানি ঢেলে নেয়।

অ্যালেক্স, চোখে-মুখে পানি নিতে নিতে মনে হয়, পৃথিবীর নগরপিতারা আমার ক্লান্ত শরীরের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুতে দিচ্ছে।

মাথাটা ঝাঁকি দাও রোদেকা

রোদেকা, অ্যালেক্সের হাঁপানি ছিল। অ্যালেক্স হাসি দিলে যে-তরঙ্গ, সে-তরঙ্গের ঝাঁকি পেড়ে আনতো জয়তুন ফলের মাঠ। জয়তুন শীতকালে পাকে। জয়তুনের আচার লবণ-পানির চেয়েও কিছুটা লবণ। লবণ খেলে অ্যালেক্সের হাঁপানি বাড়ে।
রোদেকা, অ্যালেক্স সাঁতার থেকে ঢেউ তুলে বিছানা পেতে ঘুমাত। অ্যালেক্স সাঁতারে যেত।

রোদেকা এখনো আমরা গভীরতায় ডুবে আছি

রোদেকা তুই তো জানিস, পৃথিবী কতখানি দুর্বল। তারও বেশি দুর্বলতা নিয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তোর পায়ের কাছে এসে। একদিন দুর্বলতা কেটে যাবে, ঘুম ভাঙবে। তোর দু-উরুর মাঝ থেকে টেনে বের করব ধারালো কাঁচি। রোদেকা, দু’জন মিলে আগাছা কেটে ধ্যানের জমি বাড়াব পৃথিবীতে। গুদামজাতকরণ হবে না কোনো বোধের। ভূমির ওপর বিছানো যে দেড়ফিট ভাবের গভীরতা, তা ঠোঁটে নিয়ে বাতাসে ভেসে যাবে কাকাতুয়া।
আর কাক ও শকুনের জন্য পচে উঠবে আগাছার স্তূপ।

সমুদ্র ও উচ্চতা বিষয়ক

রোদেকা, তোমার যৌনাঙ্গে পেতে দাও মই। পিচ্ছিল পথে সাবধানতা নিয়ে একটা উচ্চতা পাক পৃথিবী। মই সহ তুমি ডুবে থাকো উচ্চতার নিচে। হাতে ছাই নিয়ে যত উপরেই উঠে আসুক, অন্য উচ্চতার মানুষ একদিন ঠিকই বুঝে যাবে, তারা বন পুড়িয়ে উঠে এসেছে এখানে। বন মানেই তো সৌখিনলতার ঝোঁপে বাঘ ও দাঁতের হিংস্রতার দিকে খরগোশের এলিয়ে-দেওয়া চোখ ।

এত উঁচুতে হিংস্রতা থাকে না। কিছু অলসতা কাটিয়ে বাতাসে দাগ কাটতে কাটতে হারিয়ে যায় খরগোশ। যেখানে বন নেই, সেখানে বাঘ নেই। সেখানে খরগোশও থাকে না।

রোদেকা, জয়তুনক্ষেতে যে-রোদ জানিয়ে গেল — আধিপত্য অর্জনের কিছু নয়, সে-রোদে আমরা ফেলে দিয়েছিলাম আমাদের খালি-হয়ে-যাওয়া স্যুটকেস আর তোমার কপালের সমান একখানা ভাঙা আয়না।

আহ রোদেকা,
রোদে আয়নায় রপ্ত হলো দিন!
চাপা পড়ে যাও পৃথিবীর শীতকাল। আমরা উষ্ণ হতে থাকি।
মেলায় পাওয়া যাচ্ছে শশী হিমু'র কাব্যগ্রন্থ 'বৃ'

মেলায় পাওয়া যাচ্ছে শশী হিমু'র কাব্যগ্রন্থ 'বৃ'







ছবি:বিশ্বজিৎ দে
বৃ। কবি শশী হিমু'র প্রথম বই। প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ এ চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনীর ব্যানারে। দীর্ঘ কবিতা যাপনের পর কবির মনে হলো কিছু কবিতা ছাপাখানায় পাঠানোর এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। শশী হিমুর নতুন বই 'বৃ' সম্পর্কে জানতে চাইলে কবি বলেন: 'কবিতার বই বৃ, আড়ালে একটা গল্পের বই।

কখনো কখনো গল্প কবিতার জন্ম দেয়। আবার কখনো কখনো কবিতায় কবিতায় গল্পও গড়ে উঠতে পারে। এই বইটাতে দুটো ব্যাপারই ঘটেছে। বইটির অনেক কবিতাই আছে যা ভিভিন্ন গল্পের কথা বলে। আবার সবগুলো কবিতাও একই সুরে একটা গল্পের উপসংহারের দিকে ছুটে যায়।'

জলফড়িং পাঠকদের জন্য শশী হিমু'র নতুন বই থেকে পাঁচটি কবিতা:

প্রেমিকার সাথে বাক্যালাপ- ১

"তুমি কতো রকম করে চোখে কাজল দিতে পারো?"
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে, সে গুনতে গুনতে
সংখ্যার ক্রম হারিয়ে ফেলে। আঙ্গুলের কর শেষ হয়ে যায়;
তার চোখে যেন বিধাতার প্রিয় সৃষ্টি।

যতবার দেখা হয়েছে ততবারই
তার অনুপম চোখের দিকে প্রথমে তাকিয়েছি।
প্রতিবারই ভিন্নভিন্ন ভাবে কাজল আঁকা চোখ দেখেছি।
এমন কখনো হয়নি তার চোখে কাজল নেই।
যেন তার চোখের বয়স বাড়ে না।

আবারো জিজ্ঞেস করলাম,
"তুমি কতো রকম করে চোখে কাজল দিতে পারো?"
সে কিচ্ছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, কিছু বলল না।
আমিও কিছু বললাম না, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম।
কিছু সময় এভাবে নিশ্চুপ ও নীরবতার সম্মোহনে কেটে গেল।
এরপর শব্দেরা ডানা মেলল তার কণ্ঠে।
পাল্টা প্রশ্নের জানতে চাইলো,
"তুমি কতোগুলো কবিতা লিখেছো আমার জন্য?
সে জানে,
এই প্রশ্নের উত্তরে আমিও গুনতে গুনতে
সংখ্যার ক্রম হারিয়ে ফেলছি,
আঙ্গুলের কর শেষ হয়ে যায় বার বার।
আমার কবিতাই যেন তার প্রিয় সৃষ্টি।

আমি তার নীরবতা কবলিত কবি,
যতবার একসাথে মিশে গেছি নাগরিক বিকেলে
কবিতার আকুতি দেখেছি চোখে চোখ মিলে গেলে
যেন নীরবতায় চেয়ে নেয় অলিখিত ঋণ।
যতবার একসাথে মিশে গেছি নাগরিক বিকেলে
কবিতার হাহাকারে হাত রেখি হৃদয়ের কাছে,
এমন কখনো হয়নি,কবিতা নেই চিরকুটে।

চোখ বুঁজলেই তুমি আমার

হুটহাট কিছু ছবি সামনে চলে আসে।
তোমাকে দেখার জন্য আমার ছবি দরকার হয়না,
স্মৃতির পাতা হাতড়াতে হয়না ক্যালেন্ডার দেখে।
বাসের জানালার ফাঁকে, ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে,
বারান্দার কোলে, খোলা মাঠে, গাছের পাতার ফাঁকে,
সারিসারি নাগরিক কংক্রিটের মাঝে টুকরো টুকরো
আকাশের দিকে তাকালেই তোমার চিহ্ন দেখি ।
বর্ষা হলেই যেন শুধু তোমারই ধূসর আগ্রাসন,
আর শরতদিনে আকাশ হয়ে ওঠে নাগরিক নীলনদ,
চোখ বুজলেও চোখে কেবল তোমার চোখটাই ভাসে;

চোখ বুঁজলেই তুমি আমার।

কবি ও কর্পোরেট দাসত্ব 
আটটা-পাঁচটার রুটিন ছুঁড়ে ফেলে রাস্তায় নামি,
কলারের বোতাম খুলতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়।
বাতাসে তখনো রঙহীন সুর্যোলোক মিলিয়ে যাচ্ছে,
শার্টের হাতার সাথে সাথে গুটিয়ে নেই দাসত্বের ছাপ।
মুঠোফোনে চোখ মেলে দেখি তোমার নির্লিপ্ততার বার্তা,
যান্ত্রিক জীবনের ভিড়েও খুজি তোমার অস্তিত্বের আভাস।
তারপর একটা সন্ধ্যার স্মৃতি পেছন থেকে অনাহুতের মতো
দুহাতে আকড়ে ধরে আমার নির্নিমেষ দুটো চোখ।
আমি একটা লোকাল বাসের জানালা খুঁজতে খুঁজতে,
ইতিহাসের পেছনের চাকায় উঠে যাই। এটোসেটো সিটে
বসে ভাবি, জীবনটা যেন বিরতিহীন পথে লোকাল সার্ভিস।
ইতিহাসের বদ্ধ জানালায় চোখ পড়তেই দেখি নিজের প্রতিবিম্ব,
অপরিচিত যাত্রীরা নেমে গেলে, ব্যক্তিগত সব দুঃখবোধ আর
জীবনের অপূর্ণতা পাশে এসে বসে-একই তো গন্তব্য!
বুকের মধ্যে অক্ষরগুলো মুহুর্মুহু ডানা ঝাপটায়,
কর্পোরেট দাসত্ব অস্বীকার করি কবিতায় কবিতায়।

অভিনয়

তুমি চলে যাবে ভাবতেই আমার দুহাত মুষড়ে পড়ে।
যে হাতে হাতে রেখে তরজমা করেছি যৌথ অনুভূতি,
সে হাত চলে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে - ভাবলেই
কবিতাগুলোর জন্য অসহায় লাগে, নতমুখে
চেয়ে থাকি মাটির দিকে নিস্পলক।
তুমিহীনা ভালবাসার মতো এই অনাথ কবিতাগুলো
নিয়ে কোথায় যাব? এই দুশ্চিন্তায় রাতগুলো নির্ঘুম;
বুকের মধ্যে খাঁখাঁ করতে থাকা একটা বিরান জাগে।
তুমি চলে যাবে ভাবতেই আমার নিঃশ্বাসগুলো
সহসাই দীর্ঘশ্বাস হয়ে ওঠে।

যে চোখে চোখ রেখে জেনেছি হৃদয়ে কাকে বলে
সে চোখ আর কোনোদিন দেখবোনা- ভাবলেই
স্মৃতিগুলো সাদাকালো বায়স্কোপের মতো
দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে বারবার অবিরাম অবিরত।
চাঁদের কলঙ্কের মতো আমাদের অতীত নিয়ে
কোথায় যাব? আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করার অভ্যেস
তোমার বুকেও তো জাগাবে ব্যাথার চর, চাঁদ জাগলে!
তোমার অস্তিত্বে আমি বেঁচে থাকার অনন্দ পাই
তুমি চলে গেলে বেঁচে থাকার অভিনয়ে বাঁচি।

বৃ-৫

হিরোশিমা আর নাগাসাকি
হৃদয়ে নিয়ে বিন্দাস ঘুরছি

স্মৃতি

তোমাদের স্মৃতিকাতরতা বড্ড অদূরবর্তী;
বিগত প্রেম, কিম্বা প্রথম প্রেমিকার স্মৃতি হাতরে
সহজেই তোমাদের মাঝে জেগে ওঠে ব্যাথার নদী।
স্মৃতি হাতরে বড়জোর ফিরে যেতে পারো কৈশোরে,
খুব বেশি হলে শৈশবে ফিরে আনন্দ রোমন্থন।
স্মৃতি বলতে আমি ফিরে যাই মাতৃগর্ভে,
ধরিত্রীর বুকে আনন্দ-দুঃখ
কিম্বা পরোকালের স্বর্গ-নরক
কোনটিই আমি অস্বীকার করিনা।
তবুও ওই জঠরকেন্দ্রিক স্মৃতি আমি এড়াতে পারিনা
আমার দুঃখ ছিল না,আনন্দ ছিল না।
ভয় ছিল না, মৃত্যু ছিল না কান্না ছিল না,জীবনের ।