কবির কল্লোল এর কবিতা

শেষ চাওয়া


এই নাও মাত্রাবৃত্ত চুম্বন,
          স্নায়বিক যুদ্ধ শেষের সফল ঠোঁটছাপ
কোমল এই শব্দটা দেখো-
    দ্বি-পর্বের মাঝে কেমন ঠিকরে আছে নির্মল;
                          এটা টিপ
আর এই যে, এই নির্বাঁধ নিবিড় চরণ-
   বাসন্তী নদীর মরা সোঁতার মতোন
   কিংবা সবুজ পল্লী চিরে একহারা মেঠোপথ যেনো,
                         এটা সিঁথি


অক্ষরবৃত্ত উষ্ণতা কিছু চাও?
ঠিক বুক বরাবর দু'টো সমস্যমান পদ,
                  বিভক্তিহীন;
                      এ দু'টো রাখো
অক্ষরবৃত্তে কেমন মানিয়ে গেলো দেখেছো!


এই যে শূন্যতা
    বিষণ্ণ সময়
        দীর্ঘশ্বাস, বেদনা কিংবা ক্লান্তি
                      এ হলো স্তবক

এইসব দ্বিধা, ভয় কিংবা মুক ভাবনারাজি
                     একান্তই আমার
পাললিক তটের মতো এই শূন্যতার ইতিহাস কিংবা স্তবক
                      শুধুই আমার


এই নাও নিক্বন মাত্রাবৃত্ত
     অক্ষরবৃত্ত নাভি
           চতুর্দশপদী শাড়ি
                                              অষ্টক কুচি
                                              ষষ্টক আঁচল
                   ত্রিপদ ঘোমটা নাও
শব্দের দুল, সন্ধির মালা পরে তারপর-
সম্পাদকের লোলুপ আঙুলে মেলে ধরো বিশুদ্ধ যৌবন


তারপর বাজারের অলিগলি ভিড়ের ভেতর
কোনো এক কামুক যুবক যদি
সাধ করে ছিঁড়ে ফেলে শাড়ির আঁচল,
                   আমাকে ভুলে যেও


      হয়তোবা আমি তখন মেঘ,
          কিংবা পাখি
  অথবা বাগদাদের কোনো এক ভাঙা প্রাচীর
  কিংবা কাশ্মিরী শালে মোড়া ভূমিহীন শিশু;
   হতে পারে- আমি তখন চীনের বিপ্লব
        ফিলিস্তিনের গ্রেনেড
       আফ্রিকার কালো কুকুর
  কিংবা শ্যালা নদীর ভাসমান মরা কাঁকড়া


                  আমাকে ভুলে যেও


আমাদের নিয়তিই এমন
   পরিচয়ের পূর্বেই আমাদের ভালবাসা,
   আলাপেই আমাদের সংগম;
   তারপর দ্রুতই ভুলে যাওয়ার প্রতিযোগিতা
   রাতপোড়া কোনো যুবকের এঁটো ঠোঁট
   কিংবা সমকামী কোনো নারীর বিষাক্ত বুকে
                     তোমার আশ্রয়


   আর আমি?
       আমি ছন্দের দ্রোহে খুঁজি কুমারী কবিতা


তবু ব্যাসবৃত্ত যে ব্লাউজ আমি পরিয়ে দিয়েছি
খুব বেশি ভালবাসা জমে গেলে বুকে
           ফাল্গুনে চলে এসো শহীদ মিনারে


ঐশ্বর্য অনল


আমার ভেতরে এক সহচরী ঈশ্বর আছে,
ভীষণ দাম্ভিক, একচোখা খেয়ালি ঈশ্বর
মাঝে মাঝে আমিও ঈশ্বরের মতো
বিপুল ক্ষমতা পেয়ে হয়ে যাই সাহসী নাস্তিক।
আসমান ফুঁটো করে আমিও উপরে উঠি,
ইশারায় আগুনে দোযখ নামে
আর যারা তোষামোদী, পা ছোঁয় আমার
সীমাহীন সৌরভে ভরে যায় ওদের সংসার


আমার দেবতাগুলো প্রভুপ্রাণ খয়ের কুকুর;
প্রতিটা স্বার্থপর ওহী অক্ষরে অক্ষরে নির্ভুল
পৌঁছায় জনে জনে, মাঠে-ঘাটে, কারখানায়
আর সেইসব নির্বোধ বান্দারা, যারা
অনন্তর খেটেখুঁটে রাতদিন ফলায় ফসল;
ঈশ্বরের মতো আমি দ্বিধাহীন গ্রাস করি সব,
ঈশ্বরের মতো আমিও উদ্ধত, চোখবুজে বলি-
এইসব কেবলি আমার


তারপর রাত নামে যখন,
মাঠে-ঘাটে, কারখানায়, নদীতে - খনিতে
নির্বোধ পাপীরা পরিশ্রান্ত ইবাদত শেষে
সারি সারি লাশের মতো ঘুমোয় নিষাঢ়
অন্বেষী দেবতাও রাতজাগা যিকির যপে
ঢুলুঢুলু শুয়ে পড়ে যে যার ডেরায়
শুধু নাস্তিক ঈশ্বরের মতো আমিই নির্ঘুম


নষ্ট শহর


জানিস হেনা, স্বপ্ন আমার গুম হয়েছে,
এই শহরের রং-মহলের রং-তামাশায়
ইচ্ছে আমার রঙ পিপাসায় নীল হয়েছে;
জানিস হেনা, ইচ্ছে আমায় ভেংচি কাটে,
স্বপ্ন আমার অন্ধকারের অচিন সেলে
ওষ্ঠাগত; স্বপ্ন আমার ডুকরে কাঁদে


বাবার দেয়া পাঞ্জাবিটা ট্রাংকে ঘুমায়,
মায়ের দেয়া দুই টাকাতেমা’ লেখা সেই
দোয়েল পাখির মাথার উপর ঘুন ধরেছে,
ভাঁজ করা লাল শহীদ মিনার ধূসর এখন
জানিস হেনা, আমি এখন মিছিল করি,
স্লোগান মুখর কণ্ঠ আমার বজ্র-সাঁনাই,
জানিস, এখন স্লোগান দিলে কয় টাকা পাই!


এবার পুজোয় লাল পেড়ে নয়, রঙিন শাড়ি
একটা যদি পাঠাই তোকে, পরবি হেনা?
লাল পেড়ে সেই স্বপ্ন আমার গুম হয়েছে,
এই টাকাতে সেই শাড়িটা যায়না কেনা

চোখের অটোগ্রাফ


সেন্ট্রালে দেখা হবে
সেইদিন শিশিরাভ ফুল রেখো হাতে
যদিও এ্যালার্জি আছে,
            তবু
গদখালী, যশোরের লাল টকটকে দু'টো মিথুন গোলাপ
                        সাথে রেখো
ফিরোজিয়া ফ্রক পরে বা'দিকের দ্বিতীয় সিঁড়িতে
    তেইশে জুলাই ঠিক যেভাবে দাঁড়িয়েছিলে,
                          নির্বাক;
তেমনি অশ্রু ভেজা ঠোঁটে-
রোদের তামাক মেখে আবার দাঁড়িও
            বেদীতে আবার এসো, দেখা হবে


এবার ফেব্রুয়ারি
অথবা মীনের শেষ মার্চ;

      এই ফাল্গুনে তুমি বেনী কোরো
   এইদিন এলোচুলে তোমার বিষণ্ণতা যদি
        চুরি করে দেখে ফেলে-
         অকাশের মেহগনি
          পুবের পলাশ
কিংবা আইন ঘেঁষা সিঁদুর কৃষ্ণচূড়া, ঢাউস শিমুল!

প্রকৃতিরও চোখ আছে, জানো?
প্রকৃতির চোখে যদি ধরা পড়ে লুকোনো আবেগ,
                    বাতাসে রাষ্ট্র হবে
বরং এবার তুমি বেণী কোরো


ওড়না বেগুনী হোক,
সূর্যে তাঁতিয়ে উঠা হলুদ ললাটে  শুধু
বিশাখা মেঘের মতো গোলগাল টিপ পোরো কালো

উনিশে জুলাই রাতে- মনে আছে?
               সেজেছিলে খুব
সাবধান!
এবার ভুলেও চোখে কাজল দিওনা
            দুপুরে বেদীতে এসো, দেখা হবে


সেন্ট্রালে দেখা হবে
যদিও বাতাস জুড়ে কর্পূর-লোবানের ঘ্রাণ
কাঙাল দু'চোখ তবু জেগে রবে
           আবার বেদীতে এসো, দেখা হবে

  আন্দোলিত আনন্দের কষ্ট

একটা পুকুর চোখ করে শর -  শ্রাবণমাসি মেঘগুলোকে
     এমন সঘন দৃষ্টিবাণে আর বিধোনা
            ভাল্লাগেনা


  শাপলা ফুলের রঙটি মেখে মাঝদুপুরে সূর্যস্নানে
    খলখলিয়ে ভীষণ মায়ায় আর হেসোনা
            ভাল্লাগেনা


 ইচ্ছে করে নিলাজ চোখে ড্যাবড্যেবিয়ে অনন্তকাল
   তোমার চোখে চোখটি রেখে তাকিয়ে থাকি
 শাপলা ফুলের গন্ধ মেখে তোমার হাসির রঙধনুতে
    চুপটি করে মন সারাক্ষণ ডুবিয়ে রাখি
         অন্য কিছু ভাল্লাগেনা


  সন্ধ্যেবেলার চন্দ্রকলা চাঁদের মতন ঠোঁট বাঁকিয়ে
    মন ভোলানো মিষ্টি কথার ঝড় তুলোনা
    আমার তখন কিচ্ছুটি আর ভাল্লাগেনা


  হলুদ গাঁদা-শিউলী-কদম-শুভ্র বকুল ফুল বাগানে
        যেমন আছে তেমনি থাকুক
  খোপায় গুজে অলুক্ষণে শ্রাবণমাসে চুল বেধোনা


  ভূঁইচাপাটি পায় মাড়িয়ে অন্ধ বাতাস মন্ত্র করে
 তুচ্ছ ভরে ভোরবিহনে আবার যদি শিশির মাড়াও
  বিস্ফোরণে বুকটা ফাঁটে, দশজগতে মন বসেনা
            ভাল্লাগেনা


ঠিক বারোটায় হঠাৎ হাওয়ায় আলুথালু কেশকাজরে
     নরম হাতের খুনসুটিতে দোল দিওনা
     মনের ভেতর হালটডালট, ভাল্লাগেনা


ক্যান বোঝোনা চার পাড়াময়  চিলের মতন দৃষ্টি হানে
 বিকেল বেলা একতলাটির ছাদের 'পরে আর এসোনা
     কী প্রয়োজন বুকটা খুঁড়ে রক্ত দেখার?
         আমি বরং ঝিনুক হবো
   বুক পকেটে মুক্ত হয়ে লুকিয়ে থেকো অনন্তকাল
     অন্য কিছু ভাবতে আমার ভাল্লাগে না


     নইলে দেখো- সত্যি সত্যি পাগল হবো
    পাগলা বেশে  নিরুদ্দ্যেশে হারিয়ে যাবো
    মিষ্টি করে পাগলা বলার  লোক পাবেনা




SHARE THIS

Author: